নেপোলিয়ন ও হিটলার দুজনই রাশিয়া দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কি এমন ভুল নীতির কারনে?
বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, অর্থাৎ মাঝে মাঝে অতীতের কোনও ঘটনাই বর্তমানেও একইরকম ভাবে ঘটে। এই একই শর্ত সামরিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে সামরিক ইতিহাসে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একই রকম দুটি ঘটনা ততটা দেখা যায়না। তবে ইতিহাসে এমনদুটি যুদ্ধ অভিযান রয়েছে যেটি হুবহু একই রকমের। একটি হচ্ছে ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান এবং ১৯৪১ সালে জার্মান নাজি সেনার রাশিয়া আক্রমন। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞগনের মতে রাশিয়াকে কখনও জেতা সম্ভব নয় এই ধারনা ভুল কারন অতীতে ভাইকিংরা রাশিয়াকে জিতেছিল এবং মোঙ্গলরা রাশিয়া দখল করে একশো বছর শাসন করেছিল। কিন্তু নেপোলিয়ন ও হিটলার রাশিয়া দখল করতে ব্যার্থ হয় তাদের ভুল নীতির জন্য। বিশেষ করে ১২৯ বছর আগে নেপোলিয়ন ঠিক যে ভুল করেছিল, ১৯৪১ সালে হিটলারও সেই ভুলটাই করে।
২৪ জুন, ১৮১২ সালে ফ্রেঞ্চ সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার সেনাবাহিনী নিয়ে রাশিয়া অভিযান শুরু করে। নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার বিস্তীর্ন অঞ্চল দখল করা যাতে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার তার সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। নেপোলিয়ন প্রথমে রাশিয়ার ভিলনা আক্রমন করে যুদ্ধ করবার জন্য। কিন্তু রাশিয়ান সেনবাহিনী নেপোলিয়নের আসার খবর পেয়ে পিছিয়ে উইটেবস্ক চলে আসে। বাধ্য হয়ে জুলাই মাসে নেপোলিয়ন উইটেবস্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্ত এখান থেকেও রাশিয়ান সেনা পেছনে সরে গিয়েছিল। আসলে রাশিয়ার জার নির্দেশ দিয়েছিল সরাসরি নেপোলিয়নের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ না করে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে যাতে নেপালিয়নের সেনাবাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের রসদ কমে যায়। রাশিয়ান সেনাবাহিনী পিছিয়ে যাওয়ার আগে রাস্তায় সমস্ত ফসল, পানীয় জল নষ্ট করে দিয়ে যাচ্ছিল যাতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী কোনও রসদ না পায়, এই নীতিকে স্কচর্ড আর্থ নীতি বলে যেখানে নিজের দেশের ক্ষতি করে শত্রুকে আটকানো হয়। উইটেবস্কেও রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে না পেয়ে নেপোলিয়ন আরও আগে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু তাকে কিছু সামরিক কর্মকর্তা আরও আগে যেতে নিষেধ করেছিল কিন্তু নেপোলিয়ন শোনেনি। এরপর নেপোলিয়ন স্মোলেন্সক শহরের দিকে যায়। ১৮ আগস্ট স্মোলেন্সক শহরে নেপোলিয়ন পৌঁছে দেখে গোটা শহর আগুনে জ্বলছে এবং সেখানেও কোনও রাশিয়ান সেনা নেই। স্মোলেন্সক পৌঁছে নেপোলিয়নের মোনোবল ভেঙে যায় কারন তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। ৩,৬০,০০০ এর বিশাল সেনা নিয়ে নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমনে এসেছিল। কিন্তু স্মোলেন্সক পৌঁছাতে পৌঁছাতে নেপোলিয়নের সেনার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ১,৮৫,০০০ জনে। পথিমধ্যে খাদ্যের অভাবে, পরিশ্রমে ও রোগে অর্ধেক সেনার মৃত্যু হয়েছিল। বাধ্য হয়ে বাকী সবার অনুরোধে নেপোলিয়ন রাশিয়ার জারকে চুক্তি করার জন্য চিঠি লেখে। কিন্তু জার চিঠির কোনও জবাব দেয়নি। নেপোলিয়নের কাছে এই সময় দুটি পথ ছিল প্রথমত স্মোলেন্সক থেকে ফ্রান্স ফিরে গিয়ে ভবিষ্যৎএ আবার আক্রমনে আসা দ্বিতীয় স্মোলেন্সক থেকে মস্কোর দিকে যাওয়া। নেপোলিয়ন সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে মস্কোর দিকে যাওয়া শুরু করে। কারন মস্কো রাশিয়ার বড় শহর সেখানকার নিরাপত্তায় থাকবেই রাশিয়ান সেনাবাহিনী। বাস্তবেও মস্কোর কাছেই ছিল রাশিয়ান সেনাবাহিনী। ৬ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ান সেনাবাহিনী ও নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীর মধ্যে বোরোডিনোর যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ নেপোলিয়ন জিতে যায় কিন্তু তার ২৮,০০০ সেনা আহত ও নিহত হয়। অন্যদিকে রাশিয়ার ৪০,০০০ সেনা হতাহত হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর মস্কো গিয়ে উপস্থিত হয় নেপোলিয়ন। কিন্তু শহরে পৌঁছে নেপোলিয়ন অবাক হয়ে যায় দেখে মস্কোর মতোন বড় শহর পুরো জনশূন্য উপরন্তু শহরের বেশ কীছু অংশে আগুন জ্বলছে। নেপোলিয়ন ২০ সেপ্টেম্বর আবারও জারকে চিঠি লেখে সন্ধির জন্য। কিন্তু জার কোনও উত্তর দেয়নি। বাধ্য হয়ে ৫ অক্টোবর নেপোলিয়ন সিদ্ধান্ত নেয় মস্কো থেকে স্মোলেন্সক হয়ে ফ্রান্স ফিরে যাবে। নেপোলিয়ন যখন ফ্রান্স ফিরে আসে তখন তার কাছে সামান্য কিছু সেনাই ছিল। নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান সম্পূর্নরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। এই রাশিয়া অভিযানই পরবর্তীকালে নেপোলিয়নের পতনের সূচনা করে।
১৯৪১ সাল আসতে আসতে অধিকাংশ ইউরোপই হিটলারের নাজি সেনার অধীনে চলে যায়। ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নই শুধুমাত্র হিটলারের অধীনে ছিলনা সেসময়। সেজন্য হিটলার ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের পরিকল্পনা করে। ১৯৪১ সালের ২২ জুন হিটলার অপারেশন বারবারোসার সূচনা করে। এই অপারেশনে জার্মান সেনাবাহিনীকে তিনভাগে বিভক্ত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড ও ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের মতোন শক্তিশালী দেশ দখল করে নেওয়ায় হিটলারের ধারনা ছিল তিন মাসের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও দখল করে নেবে জার্মানি। কিন্তু হিটলার ভুলে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বিশাল দেশ। তবে অপারেশন বারবারোসার প্রথম একমাসে জার্মান সেনাবাহিনী ব্যাপক সাফল্য পায়। ৭ আগস্ট জার্মান নাজিসেনা স্মোলেন্সক দখল করে নেয়। সেপ্টেম্বর মাস আসতে আসতে সম্পূর্ন ইউক্রেনীয় অঞ্চলও জার্মানির অধীনে চলে আসে। ২ অক্টোবর মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হয় জার্মান সেনাবাহিনী। কিন্তু ততদিনে রাশিয়াতে বৃষ্টির কারনে পথ পিচ্ছল ও কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিল। যার জন্য জার্মানির ট্যাঙ্ক বহরের যেতে খুবই সমস্যা হচ্ছিল। তাছাড়া জার্মান সেনাও যুদ্ধের ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া ট্যাঙ্কের জন্য তেল আসতেও বেশী সময় লাগছিলো। এসব কারনে জার্মান সেনাবাহিনীর গতি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতেই নভেম্বর মাস শুরু হয়ে যায়। নভেম্বর মাস থেকে রাশিয়াতে শীতকাল শুরু হয়ে যায়। শীতকালে রাশিয়ায় ব্যাপক ঠান্ডা পড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান সাইবেরিয়া রাশিয়াতেই অবস্থিত। শীতকালে রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রিতে নেমে যায়। এরকম ভয়ানক ঠান্ডার জন্য প্রস্তত ছিলনা জার্মান নাজিসেনা কারন তাদের কাছে শীতের পোষাক ছিলনা কোনও। হিটলার ভেবেছিল তিনমাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নেওয়া হবে সেজন্য ঠান্ডার পোষাক পাঠায়নি সেনাবাহিনীর সাথে। নাজিসেনার অফিসাররা চাইছিলো রাশিয়া তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পিছিয়ে পোল্যান্ডে চলে যেতে এবং ঠান্ডা কমলে পুনরায় সোভিয়েতে আক্রমন করা হবে। কিন্তু হিটালার স্পষ্ট নির্দেশ দেয় যেভাবেই হোক মস্কো অভিযান করতেই হবে। বাধ্য হয়ে জার্মান সেনা এগোতে শুরু করে। নভেম্বরের শেষ হতে হতে জার্মান সেনাবাহিনীর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তীব্র ঠান্ডায় বহু সেনার মৃত্যু হয়েছিল। ৫ ডিসেম্বর, মস্কো থেকে ত্রিশ মাইল দূরে এসে পৌঁছায় জার্মান সেনাবাহিনী। এই সময় হঠাৎই সোভিয়েত সেনা তীব্র আক্রমন করে জার্মান সেনাবাহিনীর উপর। দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্ত জার্মান সেনা সোভিয়েত আক্রমনের সামনে পীছু হটতে বাধ্য হয়। এভাবে নেপোলিয়নের মতো অ্যাডলফ হিটলারেরও রাশিয়া অভিযান ব্যর্থ হয়। নেপোলিয়ন ও হিটালারের রাশিয়া অভিযানের মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে। নেপোলিয়ন রাশিয়া অভিযান শুরু করেছিল ২৪ জুন, যদিও অনেক ঐতিহাসিক বলেন তারিখটা ২২ জুন ছিল এবং হিটলারও ২২ জুনই সোভিয়েত অভিযান শুরু করে। অর্থাৎ নেপোলিয়ন ও হিটালার একই দিনে রাশিয়া অভিযান করেছিল। নেপোলিয়ন স্মোলেন্সক দখল করেছিল ১৮ আগস্ট, হিটলার স্মোলেন্সক দখল করেছিল ৭ আগস্ট। নেপোলিয়ন ও হিটলার উভয়েই তার সেনা কর্মকর্তাদের বারন সত্ত্বেও মস্কো অভিযান করেছিল। নেপোলিয়ন যদিও মস্কো পৌঁছাতে পেরেছিল কিন্তু হিটলারের সেনাবাহিনী মস্কো পৌঁছাতেই পারেনি। দুই সেনাবাহিনীই প্রয়োজনীয় রসদের সমস্যায় পড়েছিল। নেপোলিয়ন ও হিটলারের সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনীর থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল, কিন্তু রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডা এই দুই মহা শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেই পরাস্ত করেছিল।