ভারতে অ্যাভিয়েশন খাতে গবেষনার জন্য বিশাল কেন্দ্র তৈরি করছে বোয়িং
একবিংশ শতাব্দীতে কোনও দেশ ভূরাজনীতিতে কত বেশী শক্তিশালী তা শুধু দেশটির সামরিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করেনা বরং কোনও দেশের মজবুত অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে প্রভাবশালী করে তোলে বিশ্বমঞ্চে। এর স্পষ্ট উদাহারন চীন। প্রথমে চীন তার অর্থনীতি শক্তি করেছে, তারপর সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ভারতের পরম শত্রু দেশ পাকিস্তান নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়ন না করেই ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গিয়ে বর্তমানে দেওলিয়া হয়ে গিয়েছে। সেজন্য ভারত সবসময় নিজের আর্থিক পরিকাঠামো ও সামরিক ক্ষমতা উন্নয়নে একইসাথেই কাজ করে চলেছে।
২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ভারতকে আরও আর্থিক ভাবে শক্তিশালী করবার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। ভারত সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে একাধিক বিদেশী সংস্থা ভারতে বিনিয়োগ করছে যার সবচেয়ে বড় উদাহারন আমেরিকার প্রসিদ্ধ বিমান নির্মান সংস্থা বোয়িং এর ভারতে আগমন।
ভারতের অ্যাভিয়েশন বা বিমান যাত্রার বাজার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিমান নির্মান সংস্থা বোয়িং আমেরিকার বাইরে তাদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র তৈরি করেছে ব্যাঙ্গালোরে। গত ১৯ জানুয়ারী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যাঙ্গালোরে বোয়িং এর এই কেন্দ্রের উদ্ভোদন করেছেন।
আমেরিকার বাইরে বোয়িং ভারতের ব্যাঙ্গালোরেই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে। ৪৩ একর জায়গার উপর ১,৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি বোয়িং এর এই কেন্দ্রের নাম বোয়িং ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি সেন্টার। বোয়িং এর এই কেন্দ্রে বিমান তৈরি হবেনা, এখানে বিমানের প্রযুক্তির উপর গবেষান হবে। যেকোনও প্রযুক্তি তৈরি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে গবেষনা বিভাগের। বিশ্বের সমস্ত শক্তিশালী দেশই তার গবেষনা খাতে প্রচুর ব্যয় করে। ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগের জন্য বোয়িং এর এই কেন্দ্র ভারতের প্রতিভাবানদের জন্য উমুক্ত সবসময়। বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গনিত ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে মেয়েদের আরও বেশী সুযোগ দেওয়া হবে এখানে। বোয়িং ভারতের স্টার্টআপ সংস্থা, সরকারি সংস্থা গুলোর সাথে যৌথভাবে এখানে কাজ করবে। পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সহ যাত্রীবাহী বিমান সহ বিমান সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রযুক্তির উপর গবেষনা হবে এখানে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বোয়িং সুকন্যা প্রকল্পও শুরু করেছে যাতে দেশের প্রতিভাবান মহিলারা আরও বেশী করে অ্যাভিয়েশন বিভাগে সুযোগ পায়। বোয়িং ভারতের ১৫০টি বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গনিত ও ইঞ্জিনিয়ারিং এর গনিতের গবেষনাগার তৈরি করবে যেখানে মহিলাদের জটিল প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে যাতে তারা অ্যাভিয়েশন বিভাগে কাজ পায়। এছাড়া ভারত সরকারের এই প্রকল্প মহিলাদের বৃত্তি দেবে এবং পাইলট হওয়ার জন্যও প্রশিক্ষন দেবে। বোয়িং এর এই কেন্দ্রে তিন হাজারের বেশী ইঞ্জিনিয়ার গবেষনা করতে পারবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড সহ একাধিক আধুনিক প্রযুক্তির উপর গবেষনা হবে এখানে। বোয়িং ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথেও যৌথভাবে কাজ করবে যাতে ভারতের জন্য আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরি করা যায় যা আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বিলিং অ্যানালিস্ট, স্ট্রাকচারাল অ্যানালিস্ট ইঞ্জিনিয়ার, পোগ্রাম অ্যানালিস্ট, প্রোডাক্ট রিভিউ ইঞ্জিনিয়ার, ডিজিট্যাল ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাসোসিয়েট সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার সহ একাধিক বিভাগে ভারতের বিভিন্ন শহরে বোয়িং প্রাথমিক ভাবে ১০৭টি পদে নিয়োগ করেছে যার মধ্যে ব্যাঙ্গালোরেই ৯৭টি পদে নিয়োগ করা হয়েছে। বোয়িং সম্প্রতি বিল্ড বা বোয়িং ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট পোগ্রাম শুরু করেছে যাতে ২০২৩-২৪ বর্ষের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আইআইটির সাথে যুক্ত রয়েছে বোয়িং। ভারতের তিনশো সংস্থা বোয়িং এর সাথে যুক্ত রয়েছে। প্রতিবছর ভারত থেকে এক বিলিয়ন ডলারের জিনিস কেনে বোয়িং। একটি বিমান তৈরি করতে অনেক উপাদানের প্রয়োজন, বোয়িং এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের এরকম ভিন্ন ভিন্ন প্রচুর উপাদান বহু সংস্থার থেকে কেনে। ভারতে ছয় হাজর লোককে চাকরি দিয়েছে বোয়িং, এছাড়া অন্তত তেরো হাজার লোক বোয়িংকে বিভিন্ন দ্রব্য সরবরাহ করে। বোয়িং এর পাশাপাশি আরও একটি বিমান তৈরির সংস্থা এয়ারবাসও প্রতিবছর ভারতীয় সংস্থাগুলির কাজ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের উপাদান কেনে, তবে এয়ারবাস জানিয়েছে তারা খুব শীঘ্রই প্রতিবছর ১.৫ বিলিয়ন ডলারের জিনিস কিনবে ভারত থেকে।
হায়দ্রাবাদে ২০১৬ সালেই বোয়িং টাটার সাথে যৌথভাবে টাটা বোয়িং এরোস্পেস লিমিটেড বা টিবিএএল তৈরি করেছে। এই কেন্দ্র তৈরি করার জন্য ২০১৫ সালেই বোয়িং ও টাটার মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। এখানে বোয়িং এইচ ৬৪ হেলিকপ্টারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, সহ ফিউসলেজ তৈরি হয়। কোনও বিমানের সম্পূর্ন পরিকাঠামোকে ফিউসলেজ বলা হয়। ২০১৬ সালে সংস্থাটি শুরু হওয়ার পর ২০১৮ সালে প্রথম এইচ ৬৪ ফিউসলেজ তৈরি হয় এখানে।
জুলাই, ২০২১ সালের মধ্যে সংস্থাটি একশোতম ফিউসলেজ তৈরি করে ফেলে। এখানে ছয়শোর বেশী দক্ষ মানুষ কাজ করে, এই কেন্দ্রে তৈরি হওয়া ফিউসলেজের ৯০ শতাংশ উপাদানই ভারত থেকে কেনে বোয়িং। সম্প্রতি বোয়িং ৭৩৭ সিরিজের বিমানের কিছু অংশও এখানে তৈরি করছে। ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগকে বৃদ্ধি করতে টাটার এয়ার ইন্ডিয়া সহ ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। টাটার এয়ার ইন্ডিয়া গুরুগ্রামে দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষন কেন্দ্র তৈরি করতে চলেছে যেখানে পঞ্চাশ হাজার শিক্ষার্থীকে একসাথে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে অ্যাভিয়েশন বিভাগে কাজের জন্য। এয়ারবাস ও এয়ার ইন্ডিয়া যৌথভাবে পাইলট প্রশিক্ষন কেন্দ্র তৈরি করবে যেখানে আগামী দশকের জন্য ৫,০০০ পাইলটকে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। এই কেন্দ্রে ২০টি ফ্লাইট সিমুলেটর থাকবে যার মধ্যে দশটি এয়ারবাস ও এয়ার ইন্ডিয়া যৌথভাবে তৈরি করবে। বিমান চালানোর জন্য কৃত্রিম ককপিট তৈরি করে তাতে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়, একেই সিমুলেটর বলা হয় যাতে একজন শিক্ষার্থী আসল বিমান চালাচ্ছে বলেই মনে করে। এয়ারবাস জানিয়েছে ২০২৫ থেকেই এই প্রশিক্ষন কেন্দ্র শুরু হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ডাইরেক্টোরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন এন্ড ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সি টাটা এয়ারবাস প্রশিক্ষন কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। এছাড়া এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলও তৈরি করবে।
এয়ারবাস জানিয়েছে আগামী কুড়ি বছরে ভারতে অন্তত ২,৮৪০ নতুন বিমান ও ৪১,০০০ পাইলটের প্রয়োজন হবে। গত ১৯ জানুয়ারী আকাশা এয়ার ১৫০টি বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমানের অর্ডার দিয়েছে। এই হিসেব অনুযায়ী ইতিমধ্যেই ভারতীয় বিভিন্ন যাত্রীবাহী বিমান সংস্থা ১,৬১৮টি বিমানের অর্ডার দিয়েছে, আরও ৩৭০টি বিমানের অর্ডার দেওয়া হবে।
২০২৩ এর ফেব্রুয়ারীতে এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারবাস ও বোয়িং এর সাথে ৪৭০টি নতুন বিমান কেনার চুক্তি করেছে এবং ৩৭০টি আরও বিমান কিনবে এয়ার ইন্ডিয়া। অর্থাৎ ২০২৫ এর মধ্যে ভারতীয় সংস্থাগুলি অন্তত ২০০০ এর মতোন বিমান কিনতে চলেছে। যার অর্থ ভারতের অ্যাভিয়েশন বাজার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।