গত আট বছরে ভারতে বিমানবন্দরের সংখ্যা ৭৪ থেকে বেড়ে ১৪০ হয়েছে
সম্প্রতি ভারতীয় এয়ারলাইন্স সংস্থাগুলো ১,১০০ এর অধিক বিমানের অর্ডার দিয়েছে। যার কারনে অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি বা যাত্রীবাহী বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হয়ে উঠছে। আজ বিশ্বের কোনও দেশই ভারতের মতো এত বেশী বিমান কিনছেনা। গত আটবছরে ভারতে বিমানবন্দরের সংখ্যা ৭৪ থেকে বেড়ে ১৪০ হয়ে গেছে। কিন্ত এরসাথেই আরও একটি ব্যাপার হল ভারতের অধিকাংশ যাত্রী আজও ভ্রমনের জন্য সড়ক ও ট্রেন ব্যবহার করে কিন্তু তা সত্বেও ভারত যাত্রীবাহী বিমান সেক্টরে বিপুল বিনিয়োগ করছে। বিগত আট বছরে ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে।
বিসনেজ টুডের তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় সংস্থাগুলি ১,১০০ এর অধিক বিমানের অর্ডার দিয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ সালে এয়ার ইন্ডিয়া আমেরিকার বোয়িং ও এয়ারবাসের সাথে ৪৭০ টি বিমানের চুক্তি করেছে। ভারতের যাত্রীবাহী বিমানের ইতিহাসে এটা সবচেয়ে বড় অর্ডার ছিল। ২০০৫ সালের পর এটাই এয়ার ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় অর্ডার। এয়ার ইন্ডিয়া এমন সময়ে এই অর্ডার করেছে যখন ভারতের বিমান পরিবহনে যাত্রীসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের সবচেয়ে বড় বিমান সংস্থা ইন্ডিগোও এয়ারবাসের সাথে পাঁচশো বিমানের ঐতিহাসিক চুক্তি করেছে। ইন্ডিগোর তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন তাদের ২০০০ এর বেশী বিমান ১১৮ টি জায়গায় যাত্রা করছে যার মধ্যে দশ শতাংশ বিমান আন্তর্জাতিক যাত্রা করে। সিডনির সেন্টার ফর এসিয়া প্যাসিফিক অ্যাভিয়েশন বা সিএপিএ এর তথ্য অনুযায়ী খুব শীঘ্রই ভারতের বিমান পরিবহন বাজার এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে সার্ভিসে থাকা একটি বিমান পীছু ভারতের আরও ২.২ বিমান অর্ডারে থাকবে। এয়ার ইন্ডিয়া যে ৪৭০ টি বিমান অর্ডার দিয়েছে তার মধ্যে ৭০ টি বিমান বড় আয়তনের বিমান হবে যেগুলো কোথাও না থেমে সরাসরি আমেরিকা যেতে সক্ষম হবে। অর্থাৎ এয়ার ইন্ডিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ করে ভারত থেকে আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানে যাত্রীবাহী বিমানের সংখ্যা বাড়াতে চলেছে। এয়ার ইন্ডিয়া যে ৪৭০ টি বিমান অর্ডার করেছে তার মধ্যে রয়েছে ৩৪ টি এ৩৫০- ১০০০, ৬ টি এ৩৫০- ৯০০, ২০ টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এবং ১০ টি বোয়িং ৭৭৭এক্স বিমান, সেইসাথে ১৪০ টি এয়ারবাস এ৩২০ নিও, ৭০ টি এয়ারবাস এ৩২১ নিও এবং ১৯০ টি বোয়িং ৭৩৭ম্যাক্স বিমান।
গতবছরের ফেব্রুয়ারী মাসেই এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছিল ৭০ বিলিয়ন ডলার মূল্যে তারা বিমানবহর বাড়াবে, প্যারিস এয়ারশোতে এয়ারবাস ও বোয়িং এর সাথে করা এই ডিল সেই ৭০ বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্টেরই অংশ। এয়ার ইন্ডিয়া স্বদেশী বিমান পরিবহনের ক্ষেত্রে দারুন কাজ করলেও এতদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্তরে বিশেষ করে জরুরী পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের অন্যদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা কিংবা উদ্ধারকার্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো কাতার এয়ারলাইন্স ও এতিহাদ এয়ারলাইন্সের মতোন শক্তিশালী বিদেশী সংস্থা গুলোর তুলনায় কীছুটা পিছিয়ে ছিল বিমনের সংখ্যার বিচারে। কিন্তু ভারতীয় বিমানসংস্থা গুলো যে হারে বিমান অর্ডার করছে তাতে অচিরেই ভারতের অ্যাভিয়েশন সেক্টর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম হয়ে উঠবে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কেনার চুক্তিটি এত গুরুত্বপূর্ন ছিল যে এই চুক্তির সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোন উভয়েই উপস্থিত ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানান এয়ারবাসের সাথে এই চুক্তি ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে কুটনৈতিক ও স্ট্রাটেজিক সম্পর্কও আরও মজবুত করবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও এয়ার ইন্ডিয়ার এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক বলেছেন। ভারত যত অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তত ভারতের অ্যাভিয়েশন সেক্টরও উন্নত হচ্ছে। সিএপিএ এর ভারতীয় সিইও কপিল কওল জানিয়েছেন আগামী দুই, তিন বছরে ভারতের অ্যাভিয়েশন সেক্টর আরও মজবুত হবে। শুধু যাত্রী পরিবহনই নয় পন্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও বিমান গুরুত্বপূর্ন। কোনও দেশ অর্থনৈতিক ভাবে সুপার পাওয়ার হলে তার অ্যাভিয়েশন সেক্টরেও প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ আসে, যেটা বর্তমানে ভারতের সাথে হচ্ছে। পর্যটন শিল্প যেকোনও দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। ভারত একটি এমনদেশ যার বিভিন্ন প্রান্তে অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য দেখা যায়। ভারতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার, সমস্ত ধর্মের মানুষ বাস করে এবং প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এইজন্য ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতকে বলেছিলেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এরকম বৈচিত্র্যময় দেশের আকর্ষনে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর বিদেশী পর্যটক ভারতে আসে। বিমান কেনার পাশপাশি তাই ভারত সরকার ভারতে বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির জন্য অনেক বিমানবন্দর তৈরি করছে।
ভারত থেকে কেনিয়া, ভিয়েতনাম, আজারবাইজানের মতোন দেশেও বিমানের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। জার্মান সংস্থা স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে ভারতে বিমান যাত্রায় যাত্রীর সংখ্যা ১৬৩.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ প্রতিবছর ১৬ শতাংশ হারে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে। তবে করোনা মহামারীর কারনে ২০২০ সালে এই সংখ্যা কমে ২.৭ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে ২০৩০ এর মধ্যে ভারত আমেরিকা ও চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিমান যাত্রীর বাজারে পরিনত হবে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের নবম বৃহত্তম অ্যাভিয়েশন বাজার, প্রতিবছর ভারতে ১২১ মিলিয়ন যাত্রী দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৪১ মিলিয়ন যাত্রী বিমানে যাতায়াত করে। ভারত সরকারের বানিজ্যিক বিমান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারতের জিডিপিতে ৩০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করেছে এই বিমান পরিবহন বিভাগ, যেখানে ২০২০ সালে ২০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছিল এই বিভাগ। ইন্ডিয়া ব্রান্ড ইকুইটি ফাউন্ডেশন বা আইবিইএফের তথ্য অনুযায়ী আগামী চার বছরে ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগে ৩৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। আগামী কয়েক বছরে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের জন্য পন্যবাহী বিমান বা কার্গো বিমানের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৩ টি করা হবে।
ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগে এই মূহুর্তে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ কাজ করছে, ২০২৪ এর মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে হবে সাড়ে তিন লাখ। আইবিইএফের তথ্য অনুযায়ী ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগ চার মিলিয়ন বা চল্লিশ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে, এছাড়া আগামী আঠারো থেকে ত্রিশ মাসে আরও কয়েক লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ২০২২ সালে ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগে দেশীয় বিমান পরিবহনে সবচেয়ে বেশী ৫৬.১ শতাংশ শেয়ার ছিল। এছাড়া ভিস্তারার ৯.২ শতাংশ, গো ফাস্টের ৮.৮ শতাংশ, এয়ার ইন্ডিয়া ও গো ফাস্টের ৮.৭ শতাংশ, এয়ার এশিয়ার ৬.২ শতাংশ ও অন্যান্য সংস্থার ২.৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। অর্থাৎ ভারতের বিমান চলাচল ক্ষেত্রে ইন্ডিগো এই মূহুর্তে সবচেয়ে বড় সংস্থা। ভিস্তারা, গো ফাস্টের মতোন সংস্থার আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের ক্ষেত্রেও শেয়ার বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত সরকার ভারতের অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে মজবুত করবার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত সরকার কেন্দ্রীয় বেসামরিক বিমান মন্ত্রককে ২০২৩- ২৪ এর অর্থবর্ষে ৩,২২৪ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছে। ভারত সরকার আঞ্চলিক বিমান চলাচল ও দেশের অভ্যন্তরে বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে একশো শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে। বিমানবন্দর, হেলিপোর্টস, উভচর বিমান সহ পঞ্চাশটি বিমান অবতরন ক্ষেত্রর উন্নয়ন করছে ভারত সরকার যাতে আঞ্চলিক বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। বিগত আট বছরে ভারতে বিমানবন্দরের সংখ্যা ৭৪ থেকে বেড়ে ১৪০ হয়েছে, ভারত সরকার আগামী কয়েক বছরে এই সংখ্যা ২২০ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন ৩৩ টি কার্গো টার্মিনাল ও ১৫ টি নতুন বিমান চলাচল প্রশিক্ষন স্কুল তৈরিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। ভারত সরকার আগামী পাঁচ বছরে বিমানবন্দরে অন্তত ৯৮,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমান করছে। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০৩০ এর মধ্যে ভারতে ২২০ টি বিমানবন্দরের পাশপাশি, বিমানের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে ১,৫০০ এবং যাত্রীসংখ্যা তিনগুন বৃদ্ধি পেয়ে ৪২.৫ কোটি হবে।
২০১৬ সালে ভারত সরকার এনসিএপি বা রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প শুরু করে যার আওতায় উডান বা উড়ে দেশ কা আম নাগরিক প্রকল্প শুরু করা হয় যার লক্ষ্য হয় দেশের সাধারন মানুষের জন্য বিমান যাত্রার খরচকে সাশ্রয়ী করা। ২০২২ সালের জুন মাসে জাতীয় বিমানবন্দর নীতি শুরু করে লক্ষ্য ২০৩০ এর মধ্যে ভারতের অ্যাভিয়েশন বিভাগকে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে পরিনত করা। আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য ভারত সরকার ১,২৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।