ব্রিটিশরাজ ও কোবরা সাপ। ইতিহাসের পাঁচটি ঘটনা, যা ভালোর জন্য শুরু হলেও ফল হয়েছিল বিপরীত
অনেক সময় ভালো উদ্দেশ্যের জন্য করা কোনও কাজের এমন বিপরীত ফল হয় যা কোনওদিন আশাও করা হয়নি। ইতিহাসে এমন পাঁচটি ঘটনা রয়েছে যেখানে মানুষের ভালোর জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু তার এমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয় যে যা কোনওদিন কল্পনাও করা যায়নি।
১) ব্রিটিশরাজ ও কোবরা সাপ:— কোবরা কথাটি পর্তুগাল থেকে এসেছে। পর্তুগীজ শব্দ কোবরা কথার অর্থ ফনা যুক্ত বিষধর সাপ। কোবরা সাপের অনেক প্রজাতি আছে। ভারতে গোখরো ও কেউটে সাপকে প্রধানত কোবরা শ্রেনীভুক্ত করা হয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় একটা সময় হঠাৎ দিল্লিতে কোবরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। কোবরা সাপের উৎপাত বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশরা একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। ব্রিটিশরা ঘোষনা করে যে ব্যক্তি কোবরা সাপের চামড়া এনে তাদের দেবে তাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু ব্রিটিশরা কিছুসময় পর লক্ষ্য করে প্রচুর মানুষ নির্দিষ্ট সময় অন্তর কোবরা সাপের চামড়া নিয়ে এসে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোবরা সাপের সংখ্যা কমছেনা কিছুতেই। ব্রিটিশরা এর অনুসন্ধান করে জানতে পারে দিল্লিতে মানুষ কোবরা সাপকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে রীতিমতো। মানুষজন কোবরা সাপ বাড়িতে প্রতিপালন করে কিছুসময় পর বড় সাপ গুলোকে হত্যা করে ব্রিটিশদের কাছে নিয়ে আসছিলো এবং বাচ্চা সাপগুলোকে প্রতিপালন করতো। এভাবে সাপের সংখ্যা কমার তুলনায় বেড়ে গেছে। ব্রিটিশরা বুঝতে পারে তাদের পরিকল্পনা উল্টে সাপের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তখন ব্রিটিশরা এই পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনারও উল্টো প্রভাব পড়ে। মানুষজন যখন দেখলো কোবরা সাপ থেকে কোনও পুরস্কার পাওয়া যাবেনা, তখন সবাই সাপ ছেড়ে দেয়, এতে দিল্লিতে সাপের উৎপাত আরও বেড়ে যায়। এই ঘটনাকে কোবরা এফেক্ট বলা হয়। শুধু ভারতেই নয় বিশ্বের অনেক জায়গায় এমন ঘটনা ঘটে। একবার ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যায়, যার জন্য স্থানীয় ফরাসি সরকার ঘোষনা করে যে যে ব্যক্তি ইঁদুরের লেজ এনে দেখাতে পারবে তাদের অর্থ দেওয়া হবে। সেসময় ভিয়েতনাম ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। কিছুসময় পর ফরাসি সরকার লক্ষ্য করে হ্যানয়ে প্রচুর ইঁদুর দেখা যাচ্ছে যাদের লেজ কাটা। তখন ফ্রান্স বুঝতে পারে আসলে স্থানীয়রা ইঁদুরকে না মেরে তার লেজ কেটে এনে অর্থ নিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে কোনও একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে শুরু করা কাজের যখন বিপরীত ফল পাওয়া যায় তাকে কোবরা এফেক্ট বলা হয়।
২) স্টিকি বোম্ব:— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪০ সালে জার্মানি ফ্রান্স আক্রমন করে। সেসময় বাকী দেশগুলো ভাবছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে জার্মানিকে আটকে দিয়েছিল ফ্রান্স সেভাবেই হয়ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও আটকে দেবে। কিন্তু জার্মান সেনাবাহিনীর সামনে মিত্রশক্তি অর্থাৎ ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ক্রমশ পীছু হটে ইংলিশ চ্যানেলের তীরে ফ্রান্সের ডানক্রিক বন্দরে এসে উপস্থিত হয়। এখান থেকে তিন লাখ মিত্রশক্তির সেনাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসা হয়। তিন লাখ সেনা ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায় কিন্তু তাদের সমস্ত ভারী অস্ত্র ডানক্রিকেই থেকে যায় যা জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ইংল্যান্ড তখন জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নতুন অস্ত্র তৈরি করতে থাকে যার একটি হল স্টিকি বোম্ব যার আসল নাম ছিল গ্রেনেড, হ্যান্ড, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক নং ৭৪. জার্মান ট্যাঙ্ক ধ্বংস করার জন্য এই বোম্ব তৈরি করেছিল ব্রিটিশরা। এই বোম্ব এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে জার্মান ট্যাঙ্কের উপর একজন সেনা লুকিয়ে এই বোম্ব আটকে দেবে এবং দশ সেকেন্ড পর বোম্ব বিস্ফোরিত হবে। কিন্তু বাস্তবে যুদ্ধক্ষেত্রে যখন এই বোম্বের ব্যবহার করা শুরু হয় তখন সমস্যা দেখা যায়। জার্মান ট্যাঙ্কের মধ্যে অনেক ধুলো, ময়লা থাকায় বোম্ব ট্যাঙ্কে আটকানো সম্ভব হচ্ছিলনা, যার কারনে ট্যাঙ্ক এগিয়ে যেত এবং বোম্ব মাটিতেই বিস্ফোরিত হত। এছাড়া এই বোম্বের আরও একটি সমস্যা ছিল যে এই বোম্ব থেকে তরল আঠা অনেক সময় গড়িয়ে পড়ে সেনা সদস্যদের পোষাকে লেগে যেত যার কারনে বোম্ব সেই ব্যক্তির পোষাকে আটকে যেত যা থেকে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা ছিল। যার কারনে স্টিকি বোম্বের ব্যবহার বন্ধ করে দেয় মিত্রশক্তি।
৩) ডেডলি প্যারেড:— সময়টা তখন ১৯১৮ সাল, দীর্ঘদিন ধরে চলা মহা বিনাশক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকান সেনারা সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ দেশে ফেরার প্রস্ততি নেয়। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া প্রদেশের সরকার ঠিক করে সেনাবাহিনীর বিজয়কে সম্মান জানাতে একটি বড় প্যারেডের আয়োজন করবে যাতে সাধারন মানুষও অংশ নেবে। ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯১৮ সালে ফিলাডেলফিয়ার ব্রড স্ট্রিটে প্রায় দুই লাখ মানুষ প্যারেডে অংশ নেয়। কিন্তু এর বাহাত্তর ঘন্টা পরে ফিলাডেলফিয়ার সমস্ত হসপিটাল রোগীতে ভরে যায়। আসলে এই সমস্ত মানুষ ভয়ানক স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ১৯১৮ সাল থেকেই আমেরিকাতে স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল যাতে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়। করোনা মহামারীর মতোই এই রোগ সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে ছড়িয়ে পড়ত। ফিলাডেলফিয়া সরকার এই রোগকে ততটা গুরুত্ব না দিয়েই বিশাল প্যারেডের আয়োজন করেছিল যেখানে এই রোগ অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়েছিল। প্যারেড হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ফিলাডেলফিয়াতে ৪,৫০০ মানুষের মৃত্যু হয় এই স্প্যানিশ ফ্লুতে। এভাবে যে প্যারেড বিজয়ের সম্মানে, সেনাবাহিনীর মোনোবল বৃদ্ধির জন্য করা হয়েছিল তা বহু মানুষের মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ায়।
৪) সু ফিটিং ফুলোরোস্কোপ:— আমরা যখন কোনও দোকানে জুতো কিনতে যাই, তখন জুতো পরে বুঝতে পারি সেটি আমাদের পায়ের মাপের কীনা। কিন্তু অনেক সময় মানুষ সহজ জিনিস অতিরিক্ত জটিল করে ব্যবহার করে যার ফলও হয় ক্ষতিকারক। ১৯২০ সালে ইউরোপ ও আমেরিকার জুতোর দোকানে এক ধরনের মেশিনের ব্যবহার শুরু হয় যাতে জুতো পায়ের মাপের কীনা সঠিক ভাবে বোঝা যায়। চার ফুট লম্বা এই মেশিনে এক্স রে ব্যবহার করা হত পায়ের মাপ বোঝার জন্য। কোনও ব্যক্তি এই মেশিনে যখন জুতো পরে পা দিত তখন এক্স রে এর মাধ্যমে বোঝা যেত পায়ের হাড় জুতোয় সঠিকভাবে মানানসই হয়েছে কীনা। সাধারনত চিকিৎসার সময় এক্স রে ব্যবহার করা হয় শরীরের নির্দিষ্ট অংশে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। মাত্রারিক্ত এক্স রে এর ব্যবহার মানুষের চামড়ায় ক্যানসার সৃষ্টি করে। কিন্তু ১৯২০ এর দশকে আমেরিকা ও ইউরোপের জুতোর দোকানে একজন মানুষ বহুক্ষন ধরে এক্স রে এর মাধ্যমে জুতোর মাপ দেখতো। সেইসময় মেশনি এক্স রে সঠিক ভাবে ব্যবহারও করা হতোনা যার কারনে জুতোর দোকানে থাকা কর্মচারীরাও এক্স রে এর ক্ষতিকারক প্রভাবের কবলে পড়ত।
১৯২০ থেকে ১৯৭০ সাল অবধি ইউরোপ ও আমেরিকাতে ব্যাপক ভাবে এই মেশিন ব্যবহার করা হতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে মানুষ এক্স রে এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে থাকলে এই মেশিনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৫) তিমির বিস্ফোরন:— আমেরিকার ওরেগন শহরের একটি ছোট উপকূল শহর হচ্ছে ফ্লোরেন্স। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে ফ্লোরেন্সের উপকূলে একটি বিশাল তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। এই তিমির দৈর্ঘ্য ছিল ৪৫ ফুট এবং ওজন ছিল আট টন। এই বিশাল তিমি মাছের মৃতদেহকে প্রথমে ওখানেই ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ফ্লোরেন্সের সরকার। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তিমি মাছের মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে দেওয়া হবে কারন সমুদ্র তীরে ফলে রাখলে মানুষের সমস্যা হবে। কিন্তু এত বিশাল আকৃতির তিমি মাছকে সরাসরি মাটিতে পুঁতে দিতে অনেক বড় গর্ত করতে হত। যার কারনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ডিনামাইটের মাধ্যমে তিমি মাছটিকে বিস্ফোরিত করে কয়েক টুকরো করা হবে।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বিকেল ৩:৪৫ নাগাদ কুড়িটি ডিনামাইট বিস্ফোরন করানো হয় তিমি মাছের শরীরে। এই স্থান থেকে পাঁচশো মিটার দূরে মানুষজন এই ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিলো। কিন্তু বিস্ফোরনের পরও তিমি মাছের অর্ধেকের বেশী শরীর অক্ষতই ছিল। উপরন্তু বিস্ফোরনের ফলে তিমি মাছের শরীরের অনেক অংশ ছোট ছোট টুকরো হয়ে অনেক জয়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ফ্লোরেন্স সরকার সেখানেই বাকী মাছটিকে পুঁতে দেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় ভবিষ্যতে এরকম হলে আর কখনও বোম্ব ব্যবহার করা হবেনা। এই ঘটনার নয় সাল পরে ১৯৭৯ সালে ফ্লোরেন্সে ৪১ টি তিমি মাছের মৃতদেহ ভেসে এসেছিল কিন্তু তখন আর বোম্ব বিস্ফোরন করা হয়নি বরং সেখানেই পুঁতে ফেলা হয় মাছগুলোকে।