দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাজি যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া বাদেও কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল? কতোটা কষ্টের ছিল জানা আছে?
৮ মে, ১৯৪৫ দিনটা ইতিহাসে বিখ্যাত কারন ওই দিনে জার্মানি আত্মসমর্পন করে এবং ইউরোপে ১৯৩৯ সাল থেকে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এরপরেই মিত্রশক্তির নেতারা এবং জনগনও চাইছিলো জার্মান নাজিসেনার সদস্যদের ও হিটলারের সহযোগীদের শাস্তি দিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির নাজি সেনা যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল তার জন্য জার্মান সেনাদের উপর কারও কোনও সহমর্মিতা ছিলনা। তবে মিত্রশক্তির নেতাদের নাজি সেনাদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন রকম মনোভাব ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্টালিন ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল চাইছিলো সমস্ত নাজি যুদ্ধবন্দীদের কোনওরকম বিচার ছাড়াই হত্যা করা হোক। কিন্তু আমেরিকা চাইছিলো একটা নির্দিষ্ট বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাজি যুদ্ধবন্দীদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমেরিকার বিচার ব্যাবস্থার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়ার পেছনে দুটো কারন ছিল। প্রথমত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মনাির পরাজয়ের ব্যাপারে জার্মানির জনতাকে ভুল বুঝিয়েছিল হিটলার। হিটলার জার্মানির জনগনকে বুঝিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জর্মানি জয়ী হচ্ছিল কিন্তু জর্মান নেতারা জনগনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আত্মসমর্পন করে। সেজন্য আমেরিকা চাইছিলো একটি সুষ্ঠ বিচার প্রক্রিয়া হোক যাতে জার্মান জনগনও বুঝতে পারে তাদের সেনাবাহিনী কী কী অপরাধ করেছে। দ্বিতীয়ত আমেরিকা একটি নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া করা হবে যার সমস্ত তথ্য প্রমান হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হবে যতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জর্মান নাজি সেনার অপারাধের কথা জানতে পারে। জর্মানির নুরেমবার্গ শহরে এই বিচার চলবে বলে ঠিক করা হয়। নুরেমবার্গ শহরকেই বিচারস্থল হিসাবে বেছে নেওয়া হয় কারন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই শহর থেকেই হিটলার জার্মানি জুড়ে অপপ্রচার চালাতো। তাছাড়া নুরেমবার্গ শহরে বিশাল বিচার বিভাগ ছিল যেখানে একসাথে ১,২০০ কয়েদিকে রাখা যেত।
৮ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কিছু নির্বাচিত বিচারকদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সামরিক বিচারসংস্থা তৈরি করা হয়। এই সংস্থার দায়িত্ব ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতা বিরোধী কাজকর্মে জড়িত নাজি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। অক্টোবর ১৮, ১৯৪৫এ মিত্রশক্তির প্রধান চার দেশের চার জন বিচারক কোন কোন অপরাধের জন্য কী কী শাস্তি হবে তা ঘোষনা করে। নাজি যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে জার্মান বায়ুসেনার প্রধান হার্মান গোরিং, নাজিদলের ডেপুটি প্রধান রুডল্ফ হেস, জার্মানির বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপ, জার্মান নৌবাহিনীর সাবমেরিন বা ইউবোট বিভাগের প্রধান কার্ল ডোনিটজ, যাকে হিটলারের উত্তরাধিকার বলা হত, জার্মান সেনাবাহিনীর প্রধান উইলিয়াম কাইটেল, কম্যান্ডার অ্যালবার্ট স্পিয়ারের মতোন নাজি অফিসার ছিল। এছাড়াও আরও একজন কুখ্যাত নাজি সদস্য মার্টিন বোরমানের বিরুদ্ধেও বিচার চলেছিল। এই মার্টিন বোরমাম বেশীরভাগ সময় হিটলারের সাথেই থাকতো। মার্টিন বোরমানই নাজি কম্যান্ডদের আদেশ দিত হিটলারের নির্দেশনা সম্পর্কে। তবে মিত্রশক্তি মার্টিন বোরমানকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি কিন্তু সে যুদ্ধে মারাও যায়নি। যার জন্য তার বিরুদ্ধেও নুরেমবার্গে বিচার হয়। নাজি যুদ্ধপরাধীরা ছাড়াও কিছু সংস্থা যেমন জার্মানির গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপো, সিকিউরিটি সার্ভিস বা এসএসের বিরুদ্ধেও বিচার হয় এখানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু নাজি কর্মকর্তাই ধরা পড়েছিল কিন্তু নাজি সেনার তিনজন প্রমুখ ব্যক্তি অ্যাডলফ হিটলার, জোসেফ গবেলস ও হেইনরিখ হিমলারের বিরুদ্ধে কোনও বিচার হয়নি কারন এই তিনজনই আত্মহত্যা করেছিল। তবে নুরেমনার্গে বিচার এতটা সহজ ছিলনা কারন মানব ইতিহাসে এত বেশী সংখ্যক যুদ্ধপরাধীদের বিচার আগে কখনও একসাথে হয়নি। অনেক চিন্তাভাবনার পর ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী এই নুরেমবার্গ বিচার চলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বিচার প্রক্রিয়ায় নাজি বন্দীদেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য উকিল দেওয়া হয়েছিল। এই বিচার প্রক্রিয়ার মুখ্য বিচারক ছিল আমেরিকার রবার্ট এইচ জ্যাকশন। নুরেমবার্গ বিচার প্রক্রিয়ায় মিত্রশক্তি নজি সেনার যুদ্ধপরাধের বিরুদ্ধে একাধিক প্রমান দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি সেনা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করেছিল ইউরোপ জুড়ে এসব ক্যাম্পে ইহুদি সহ বহু মানুষের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হত, হত্যা করা হত।
মিত্রশক্তি নাজিসেনাকে পরাজিত করার পর সমস্ত ক্যাম্পের ছবি তুলে নেয় এবং এসব ক্যাম্পে বন্দী থাকা বহু বন্দীকে মুক্ত করে দেয়। এসব প্রমান নুরেমবার্গ বিচারে প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া মিত্রশক্তি নাজিসেনার বিভিন্ন কার্যালয় থেকেও প্রচুর প্রমান বিচারে প্রকাশ করে। এসব প্রমানের উপর ভিত্তি করে একবছর ধরে বিচার প্রক্রিয়া চলে।
অবশেষে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধপরাধে ১৯ জন প্রধান নাজি কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই ১৯ জনের মধ্যে ১২ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, চার জনকে ১০-১২ বছরের জেলের সাজা দেওয়া হয় এবং বাকী তিনজনকে আজীবন কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয়। জর্মান বায়ুসেনার প্রধান হার্মান গোরিংকেও ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়েছিল। তবে ফাঁসির আগের দিন রাতে সায়ানাইড পিলস খেয়ে আত্মহত্যা করে হার্মান গোরিং। তবে নুরেমবার্গ বিচার এখানেই শেষ হয়নি, ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বারোবার এই বিচার প্রক্রিয়া চলে যেখানে আরও নাজি যুদ্ধপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়।