অফবিট

ফ্রান্সকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত করার ছক প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই হয়েছিল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে জার্মানির পর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল ফ্রান্স। অ্যাডলফ হিটলারের জার্মান নাজি সেনা অসাধারন রননীতির মাধ্যমে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ফ্রান্সকে পরাজিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করার এই রননীতির সূত্রপাত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির আলফ্রেড ভন স্চিল্ফেন একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যে ইউরোপে আক্রমনের ক্ষেত্রে প্রথমেই বেলজিয়াম হয়ে ফ্রান্সকে আক্রমন করা হবে তারপর রাশিয়া আক্রমন করা হবে। একে স্চিল্ফেন প্ল্যান বলা হয়। সেসময় ইউরোপে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল ফ্রান্স যার কারনে ফ্রান্সকেই প্রথমে আক্রমন করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই পরিকল্পনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সফল হয়নি। জার্মানি যখন ফ্রান্স আক্রমন করে তখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মার্নের যুদ্ধে ফ্রান্স জার্মান সেনাকে আটকে দেয়। উভয় দেশ ট্রেঞ্চ খনন করে সেখানেই চার বছর ধরে যুদ্ধ করে। শেষপর্যন্ত জার্মানি পরাজিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার সেই স্চিল্ফেন প্ল্যানেরই একটি সংশোধিত রূপ তৈরি করে। যদি ইউরোপের মানচিত্র দেখা যায় তাহলে দেখা যাবে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে স্থল সীমান্ত অনেকটা রয়েছে। ফ্রান্সের একদম দক্ষিনে জার্মান সীমান্তে রাইন নদী এবং বড় পাহাড় রয়েছে যার কারনে এই অংশ প্রাকৃতিক ভাবে ঢাল হিসাবে কাজ করে ফ্রান্সের জন্য। এর উপরে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী সীমান্ত পুরো খোলা ছিল যার কারনে এই পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ফ্রান্স ম্যাজিনট লাইন তৈরি করে ভালোভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। ফ্রান্সের উপরের দিকে বেলজিয়াম রয়েছে। ফ্রান্স জানত একমাত্র জার্মান আক্রমন করতে পারে বেলজিয়াম হয়েই যেমনটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হয়েছিল। 

ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাদের সেনা ম্যাজিনট লাইন ও বেলজিয়াম সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে মোতায়েন রেখেছিল, যদি জার্মানি এই দুটো দিকের কোন দিক দিয়ে আক্রমন করতো তাহলে সেনা উভয়দিকেই সহজে যেতে পারতো। ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিশ্চিত ছিল যে জার্মান সেনা বেলজিয়াম হয়েই আসবে। হিটলারের একজন জেনারেল প্রথমে সেই স্চিল্ফেন প্ল্যান অনুসরন করার প্রস্তাবই দিয়েছিল কিন্তু হিটলার ওই প্ল্যান পচ্ছন্দ করছিলেন না। তখন আরেকজন নাজি জেনারেল এরিখ ভন মানস্টেইন একটা নতুন প্ল্যানের প্রস্তাব দেয়। এরিখ ভন জানায় স্চিল্ফেন প্ল্যানই অনুসরন করা হবে তবে তাতে একটু পরিবর্তন করা হবে। 

পুরো জার্মান সেনাকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হবে এ, বি ও সি। বি দল আক্রমন করবে বেলজিয়াম হয়ে যেটা আসল স্চিল্ফেন প্ল্যান, সি দল আক্রমন করে ম্যাজিনট লাইন হয়ে। জার্মানি সবচেয়ে ঘাতক আক্রমন করে আর্ডেনস জঙ্গল হয়ে। এ দলে ১৫ লাখ সেনা ও ১৫০০ ট্যাঙ্কের বিশাল বহর থাকবে। জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী অংশে যেখানে ম্যাজিনট লাইন ছিল সেখানে আর্ডেনস নামে একটি জঙ্গল ছিল। এতটাই ঘন জঙ্গল ছিল যে সেখান দিয়ে সেনা আক্রমনের সম্ভাবনার কথা ভাবেওনি ফ্রান্স, যার কারনে সেখানে তেমন নিরাপত্তা ছিলনা। এটারই সুযোগ নেয় জার্মানি। অ্যাডলফ হিটলার ৩৫ লাখ জার্মান সেনা, ৫,৫০০ বিমান ও দশটি ট্যাঙ্ক ডিভিশন নিয়ে ফ্রান্স আক্রমনের পরিকল্পনা করে। এরিখ ভনের প্ল্যান পচ্ছন্দ হয় হিটলারের এবং ফ্রান্স আক্রমনের নির্দেশ দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৪০ সালের ১০ মে জার্মানি প্রথমে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবার্গ আক্রমন করে যা ফ্রান্স আক্রমনেরই প্রথম ধাপ ছিল।

নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়ামে প্রথমে জার্মান বায়ুসেনার বোম্বার বিমান গুলো বোম্বিং করে গুরুত্বপূর্ন শহরে। সাথে জার্মান প্যারাট্রুপাররা শহরের গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল গুলো দখল করে তাদের সেনাবাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকে। ১০ মে, ১৯৪০ সালে নেদারল্যান্ডস আক্রমন করে জার্মানি,  ১৫ মে অর্থাৎ মাত্র ছয়দিনের মধ্যে নেদারল্যান্ডস আত্মসমর্পন করে দেয় জার্মানির কাছে। বেলজিয়ামে হ্যানেটের যুদ্ধ হয় জার্মানি ও প্রতিপক্ষের মধ্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ট্যাঙ্ক যুদ্ধ এটাই ছিল। বেলজিয়ামে আক্রমনের খবর পেয়েই ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাদের সেনা পাঠিয়ে দেয় বেলজিয়ামে। জার্মানির এটাই পরিকল্পনা ছিল যে অ্যালায়েড ফোর্সের সবচেয়ে বড় অংশকে বেলজিয়ামে ব্যস্ত রাখা, এই সুযোগে ১৫ মে জার্মানির এ দল আর্ডেনস জঙ্গল হয়ে সেনা অভিযান শুরু করে। এই অবিযানে জার্মানির গুরুত্বপূর্ন কম্যান্ডার ছিল হেইনজ গুডেরিয়ান। আর্ডেনস জঙ্গল থেকে প্রায় অরক্ষিত ফ্রান্সে জার্মান সেনা প্রবেশ করতে শুরু করে। হেইনজ গুডেরিয়ান এত দ্রুত তার দলকে নিয়ে এসেছিল যে ফ্রান্সের মিলিটারি জেনারেলদের কাছে কোনও জবাবই ছিলনা। হেইনজ গুডেরিয়ান ব্লিজক্রিগ নীতি প্রয়োগ করেছিল। শত্রুকে গতি ও চালাকির মাধ্যমে পরাস্ত করে বিনা বাধায় যুদ্ধজয়ের নীতিকেই ব্লিজক্রিগ নীতি বলা হয়। ব্লিজক্রিগ পদ্ধতিতে জার্মানি যুদ্ধে ব্যাপক সহয়তা পায়। ১৫ মে অভিযান শুরু করে ১৭ মে অর্থাৎ মাত্র দুইদিনে প্রায় অর্ধেক ফ্রান্স দখল করে নেয় জার্মানি। হেইনিজ গুডেরিয়ান ট্যাঙ্ক নিয়ে তীব্র গতিতে ক্রমশ ফ্রান্সের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিলো। সাধারনত যুদ্ধে সেনাবাহিনীর আগে ট্যাঙ্ক থাকে, ট্যাঙ্ক প্রথমে সামনের টার্গেটকে ধ্বংস করে তারপর সেনাবাহিনী সেই অঞ্চলের দখল নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেইনিজ গুডেরিয়ান তার ট্যাঙ্ক নিয়ে এত দ্রুত এগিয়ে চলছিলো যে সেনাবাহিনী অনেক পেছনে পড়ে যাছিল। অবস্থা এমন হয় যে হেইনিজ গুডেরিয়ান তার সেনাবাহিনী থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরে চলে আসে। ট্যাঙ্ক সেনাবাহিনী থেকে এত এগিয়ে চলে আসলে সাধারনত ট্যাঙ্কের উপর আক্রমনের সম্ভবনা বাড়ে। কিন্তু সেসময় জার্মান সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে ফ্রান্সের সেনারা এতটা ভয় পেয়ে যায় যে অনেকে সেনা ছাউনি ছেড়ে পালিয়ে যায়। জার্মান ট্যাঙ্কের উপর জোরালো পাল্টা আক্রমন করার সাহস কারও হয়নি। ২০ মে হেইনিজ গুডেরিয়ান বিনা বাধায় ইংলিশ চ্যানেলের কাছ পর্যন্ত চলে আসে। এদিকে বেলজিয়ামে থাকা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে পীছু হটতে শুরু করে। ফলে জার্মানি আরও দ্রুত আক্রমন শুরু করে বেলজিয়ামে। বেলজিয়াম সেনাবাহিনী শেষপর্যন্ত আত্মসমর্পন করে দেয় জার্মানির কাছে। ফলে ফ্রান্সে থাকা অ্যালায়েড ফোর্সে সেনা এবং বেলজিয়াম থেকে পীছু হটে আসা সেনা উভয়েই সামনে ও পিছনে জার্মান সেনার দ্বারা ঘেরাবন্দি হয়ে পড়ে। এসময় অ্যালায়েড ফোর্সের কাছে বাঁচবার দুটো উপায় ছিল প্রথমত জার্মানির সাথে যুদ্ধ করা যা বিশাল জার্মান সেনার সামনে আত্মহত্যার সমতুল্য ছিল এবং দ্বিতীয়ত ফ্রান্সের ক্যালায়িস এবং ডানক্রিক বন্দর হয়ে ব্রিটেনে পালিয়ে যাওয়া কারন এই বন্দর দুটো তখনও ফ্রান্সের অধীনে ছিল। 

শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনর প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অপারেশন ডায়নামোর পরিকল্পনা করে যাতে ফ্রান্সের ডানক্রিক বন্দর হয়ে সেনাকে ব্রিটেনে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু জার্মান সেনা যে দ্রুত গতিতে আসছিল তাতে উইনস্টন চার্চিল আশঙ্কা করছিল যে হয়ত অপারেশন শুরুর আগেই জার্মান সেনাবাহিনী এসে যাবে। 

২৪ মে ডানক্রিকে পৌঁছানোর কিছু আগেই হঠাৎ জার্মান সেনাবাহিনীর কাছে নির্দেশ আসে এখানেই থেমে যেতে আর না এগোতে। হিটলার কেন ডানক্রিকে সেনাবাহিনী পাঠায়নি তা আজও জানা যায়নি তবে বলা হয় হিটলার চাইছিলনা এত বিশাল সংখ্যায় ব্রিটিশ সেনাকে আত্মসমর্পন করাতে, কারন এতে ব্রিটেন সরাসরি জার্মানির উপর আক্রমন করতো। এবার এটাও বলা হয় হিটলারকে জার্মান বায়ুসেনার প্রধান বুঝিয়েছিল ট্যাঙ্কের রক্ষণাবেক্ষন দরকার এবং পেছনে থাকা সেনাবাহিনীর এসে পৌঁছানো দরকার, এরপর আক্রমন জার্মান বায়ুসেনা করবে। শেষপর্যন্ত ২৭ মে অপারেশন ডায়ানামো শুরু হয় যাতে ডানক্রিক বন্দর হয়ে ১,৯৮,০০০ ব্রিটিশ সেনা ও ১,৪০,০০০ ফ্রান্সের সেনাকে ৪ মে এর মধ্যে ব্রিটেনে নিয়ে আসা হয়। ব্রিটিশ বায়ুসেনা পুরো নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। এই পুরো অপারেশনে ব্রিটেন তাদের বেশ কিছু ডেস্ট্রয়ার ও যুদ্ধ জাহাজ হারায়। এই অপারেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি সেনার বিরুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সের ছোট বিজয় ছিল একটি তবে অ্যালয়েড ফোর্স বিপুল পরিমানে অস্ত্র, ট্যাঙ্ক সব ফ্রান্সেই ফেলে আসে যা জার্মানির সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়। 

ফ্রান্সের সব বন্দর দখলের পর জার্মান সেনা প্যারিসের দিকে যাত্রা শুরু করে। এদিকে ইটালি দেখল জার্মানি একাই ফ্রান্স দখল করে নেবে তখন ১০ জুন ইটালিও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে যাতে ফ্রান্সের কিছু অংশ তাদের দখলেও আসে। ১৪ জুন প্যারিস দখল করে নেয় জার্মান সেনা। ১৭ জুন ফ্রান্স আনুষ্ঠানিক ভাবে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দেয় জার্মানির কাছে। অবশেষে ২৫ জুন ফ্রান্স জার্মানি ও ইটালির সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের কাছে জার্মানি পরাজিত হয় এবং জার্মান সেনার প্রমুখ গন একটি রেলওয়ে কোচের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এবার হিটলার সেই একই পদ্ধতিতে ফ্রান্সকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পুরো ফ্রান্স দখল করেনি, জার্মানি মূলত উত্তর ফ্রান্স দখল করেছিল, বাকী ফ্রান্স স্বাধীনই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যালায়েড ফোর্সে দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স। যে ফ্রান্স প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে রুখে দিয়েছিল সেই ফ্রান্সই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে জার্মানির কাছে পরাজিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *