পৃথিবীর সবথেকে বড় সংস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিভাবে ভারতে এসেছিল জানেন?
এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা বলতে প্রথমেই নাম আসে অ্যাপেল, গুগল, মাইক্রোসফট, ওয়ালমার্টের মতোন বড় বড় বহুদেশীয় সংস্থা গুলির। কিন্ত একটা সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা ছিল ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ষোলো শতকে তৈরি হওয়া এই ব্রিটিশ সংস্থা বানিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতে আসে, ধীরে ধীরে বনিকের মানদন্ড রাজদন্ডের রূপ নেয় এবং ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজ প্রতিষ্ঠা করে।
১৫৯৯ সালে ইংল্যান্ডের একদল ব্যবসায়ী ঠিক করলো তারা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে বা ইস্ট ইন্ডিজে বানিজ্য করবে। ২২ সেপ্টেম্বর ওই দলটি ঠিক করল ইস্ট ইন্ডিজে তারা ৩০,১৩৩ পাউন্ড বিনিয়োগ করবে, যা আজকের হিসাবে প্রায় চল্লিশ লাখ পাউন্ড। এর দুদিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর তারা ইংল্যান্ডের মহারানীর কাছে যায় বানিজ্যের অনুমতি নিতে কিন্ত সেইসময় তাদের বানিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে এই ব্যবসায়ী দলটি থেমে যায়নি তারা বানিজ্যিক জাহাজ কেনে এবং বিনিয়োগ পূর্বের থেকে বাড়িয়ে ৬৮,৩৭৩ পাউন্ড করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই ব্যাবসায়ী দলটি ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবারও মহারানীর কাছে যায় নতুন করে অনুমতি নিতে। এবার তাদের ব্যবসার জন্য রাজকীয় আদেশ দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের মহারানী এলিজাবেথ প্রথম একটি আদেশপত্রে ওই ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীকে পরবর্তী পনেরো বছরের জন্য বানিজ্যক ছাড়পত্র দেয়। এভাবে জন্ম হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। সংস্থাটির প্রথম গভর্নর হয় থমাস স্মিথ এবং কোম্পানির গুরুত্বপূর্ন পদে নিযুক্ত হয় ২৪ জন বিশেষ ব্যক্তি। এই ঘটনার ১৩ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকজন সদস্য দিল্লিতে জাহাঙ্গীরের সভায় এসে উপস্থিত হয়। জাহাঙ্গীর সেসময় মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক ছিল। জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বানিজ্যের অনুমতি দিয়ে দেয়। সুরাটে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম ব্যবসা শুরু করে। প্রথমদিকে তারা মশলার ব্যবসা করতো ভারতে। সেসময় ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাশাপাশি ডাচ অর্থাৎ নেদারল্যান্ডসের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও সক্রিয় ছিল মশলার ব্যবসায়। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ে ব্রিটিশরা। ভারতে মশলার ব্যবসায় রীতিমতো মোনোপলি তৈরি করে ডাচরা। বাধ্য হয়ে ব্রিটিশরা মশলার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে ভারতে তুলো ও রেশমের ব্যবসা শুরু করে। এই ব্যবসায় প্রচুর লাভ হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। প্রথমদিকে ভারতে ব্যবসা করাই লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের। কিন্ত ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশদের মোনোভাব পুরো পরিবর্তন হয়ে যায়। এই বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসার রবার্ট ক্লাইভ পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে পরাজিত করে। পালশির যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় কারন এই যুদ্ধের পরই ব্রিটিশরা ভারতে শাসনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। পলাশির যুদ্ধের পর বাংলায় কর আদায় ব্রিটিশরা শুরু করে। যেকোনও দেশে কর আদায় করে দেশটির সরকার, একটি বেসরকারি সংস্থার ক্ষমতা কতটা বেশী হলে তারা অন্য একটি দেশে কর আদায় করতে পারে, এর থেকেই বোঝা যায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলা থেকে কর আদায় করে সেই টাকা দিয়ে স্থানীয় জিনিস কিনে অত্যাধিক দামে ইংল্যান্ডে বিক্রি করা শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যার কারনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থ ভান্ডার এতটাই বেড়ে যায় যে সংস্থাটি ভারতে সেনাবাহিনী গঠন শুরু করে।
১৭৫৭ সালের পরে ভারতে ফ্রেঞ্চ ও ডাচদের সাথে বানিজ্যিক প্রতিযোগিতা প্রায় শেষ করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বাংলার পর আশেপাশের রাজ্য গুলোর সাথেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যুদ্ধ করে জোর করে সেসব এলাকা দখল করে, যেখানে ব্রিটিশরা হেরে যেত সেখানে তারা সন্ধি করতো। ভারতে সাধারন মানুষের উপর অত্যাচার করে, শোষন করে এবং বানিজ্যের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এত মুনাফা অর্জন করেছিল যে তাদের কাছে ২,৬০,০০০ সদস্য বিশিষ্ট বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ভারতীয় ছিল। বলা হয় সেসময় ব্রিটেনের সেনার প্রায় দ্বিগুন সেনা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে।
১৭৬০ থেকে ১৮২০ এর মধ্যে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব হয়। ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব পড়ে ভারতেও। কারন ১৭৬০ সালের আগে ভারত থেকে পোষাক ব্রিটেনে রপ্তানি হত, ব্রিটিশরা ভারতীয় পোষাক পচ্ছন্দ করতো। কিন্ত শিল্প বিপ্লবের পর মেশিনেই সমস্ত জিনিস তৈরি হতে থাকে। ব্রিটেনে ভারতীয় পোষাকের চাহিদা বেশী থাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে সস্তা দামে তুলো ইংল্যান্ডে পাঠাতে থাকে। এর ফলে ক্ষতি হয় ভারতীয় তুলো চাষীদের এবং পোষাক শিল্পীদের। ব্রিটেনে এত বেশী পোষাক উৎপন্ন হতে থাকে কম সময়ে যার কারনে পোষাকের দামও কমে যায়। সেই পোষাকই আবার ভারতে এনে বেশী দামে বিক্রি করতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থাৎ দুদিক দিয়েই ভারতের ক্ষতি হচ্ছিল। ভারতে রীতিমতো প্রভাব বিস্তারের পর ব্রিটিশরা ভারতের আশেপাশের দেশ গুলোর সাথেও বানিজ্য শুরু করে।
এইসময় ব্রিটিশরা চীনের থেকে চা কিনত, ইংল্যান্ডে সেসময় চা ব্যাপক ভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। চীন থেকে চা কেনা হত রূপোর মু্দ্রার মাধ্যমে কিন্ত ব্রিটিশরা দেখলো পর্যাপ্ত রূপোর মুদ্রা দেওয়া সবসময় সম্ভব নয় যার কারনে ব্রিটিশরা চীনে আফিম রপ্তানি করা শুরু করে। ব্রিটিশরা ভারতীয় কৃষকদের জোর করে, অত্যাচার করে আফিম চাষ করিয়ে তা চীনে রপ্তানি করে চা কিনত। কিন্ত একটা সময় পর চীন আফিমের বদলে চা বিক্রি করতে অস্বীকার করে তখন ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয় যাকে প্রথম আফিমের যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটেন জিতে যায়। ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে আরও একবার যুদ্ধ হয় যাকে দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধ বলা হয়। এবারেও ব্রিটেনই বিজয়ী হয়। এরপর চীন বাধ্য হয় আফিমের বদলে চা বিক্রি করত এবং ভারতীয় কৃষকরা বাধ্য হয় আফিম চাষ করতে।
ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ৮০ শতাংশই ভারতীয় সেনা ছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহ হয় যাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়। এই প্রথম ব্রিটিশ ইস্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যার্থ হয় তবে এই বিদ্রোহ ভারতে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার করে চলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শেষ করে দেয়। কারন এই বিদ্রোহের এক বছর পরেই ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজপরিবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ভারতে শেষ করে এবং ভারতে সরাসরি ব্রিটেনের রাজার শাসন শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে সমস্ত সম্পত্তি, সেনা ব্রিটেনের অধীনে চলে যায় সরাসরি। একটা সময় ভারতকে সোনার পাখি বলা হত কিন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের প্রচুর সম্পত্তি লুঠ করে নিয়ে যায়। ভারতের তুলো, মশলা সহ কর সহ প্রচুর অর্থ লুঠ করে কোম্পানি। অবশেষে ১৮৭৪ সালের ১ জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।