অফবিট

এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রিন ফিল্ড প্রোজেক্ট তৈরি হচ্ছে গুজরাটের ঢোলেরাতেই

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মাত্র পঞ্চাশ হাজার মানুষের বাসভূমি ছিল দক্ষিন পূর্ব চীনের সেনজেন শহর, সেসময় এই শহরের নামও হয়ত সবাই জানতোনা। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে সেনজেন শহরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী জনসংখ্যার দেশ চীনের চতুর্থ বৃহত্তম শহর সেনজেন। বিশ্বের প্রথম দশটি শক্তিশালী অর্থনীতির শহরের মধ্যেও একটি এই সেনজেন শহর। বিশ্বের সবচেয়ে নবীন শহর গুলোর মধ্যে একটি সেনজেন বর্তমানে প্রযুক্তি, গবেষনা, ব্যবসার কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। হার্ডওয়্যারের বিভাগে সেনজেনকে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির সাথে তুলনা করা হয়। মাত্র চার দশকে সেনজেন শহরের এই অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। চীনের সেনজেন শহরের মাতোই ভারতেও এমন একটি শহরকে তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আহমেদাবাদের ঢোলেরা শহরকে ভারতের স্মার্ট সিটি বা আধুনিক শহর তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গুজরাট সরকার এবং ভারত সরকারের যৌথ প্রজেক্ট এই ঢোলেরা প্রজেক্ট। আহমেদাবাদ শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঢোলেরাকে আধুনিক শহরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। ঢোলেরা স্মার্ট সিটি গুজরাটে ভারত সরকারের একটি মেগা প্রজেক্ট যা ভারতের বাকী সমস্ত আধুনিক শহর প্রজেক্টের জন্য একটি উদাহারন হিসাবে কাজ করবে। ঢোলেরা স্মার্ট সিটি হতে চলেছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় উৎপাদন কেন্দ্র ও গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট। পার্ল নদীর তীরে যেমন সেনজেন শহর অবস্থিত, ঠিক তেমনি খামবাত উপসাগরের তীরে অবস্থিত ঢোলেরাও একটি প্রাচীন বন্দর শহর। ঢোলেরা ও সেনজেন শহরের মধ্যে আরও একটি বিষয়ে মিল আছে সেটি হল দুটি শহরই অতীতে সাধারন ক্ষেত্র ছিল। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সেনজন একটি সাধারন গ্রাম ছিল কিন্তু বর্তমানে চীনের উপকূলে অবস্থিত এই শহর আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্র। ঠিক তেমনি ঢোলেরাও এর আশেপাশেও গ্রাম রয়েছে যেখানে স্থানীয় মানুষ মাছ ধরার কাজ করে। যখন ঢোলেরা প্রজেক্ট সম্পন্ন হবে তখন এই শহরও আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও বিনিয়োগের কেন্দ্রে পরিনত হবে যা ভারতের অর্থনীতির জন্য বরদানের রূপে কাজ করবে।

২০০৭ সালের গুজরাট ভাইব্রান্ট সামিটে ঢোলেরা আধুনিক শহর নির্মান প্রজেক্ট প্রথম সামনে আনা হয়। ২০১১ সালে এই প্রজেক্ট সরকারি ভাবে লঞ্চ করা হয় এবং ২০১৬ সালে এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০০৭ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই এই প্রজেক্ট শুরু করবার কথা ভেবেছিলেন, ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই ২০১৬ সালে এই প্রজেক্টের জন্য সবুজ সংকেত দেন। সিঙ্গাপুরের থেকে দেড় গুন বড় ঢোলেরার আয়তন। সিঙ্গাপুরের আয়তন যেখানে ৭২১ বর্গকিলোমিটার সেখানে ঢোলেরার আয়তন ৯২০ বর্গকিলোমিটার। ঢোলেরাকে এমন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে এখানে বিশ্বের বড় বড় সংস্থা বিনিয়োগ করতে পারে এবং সংস্থাগুলি সমস্ত সুযোগ সুবিধা পায়। এই পুরো প্রজেক্টকে তিনভাগে ভাগ কর হয়েছে। প্রথম ধাপে রয়েছে নগর পরিকল্পনা। ভারত সরকার দিল্লি মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর বা ডিএমআইসি প্রজেক্টে আটটি শিল্পোন্নত আধুনিক শহর তৈরি করছে যার মধ্যে সবচেয়ে বড় শহরই এই ঢোলেরা। ডিএমআইসি ভারতের সবচেয়ে বড় নগর নির্মান প্রজেক্ট যাতে ৯০ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে উত্তর ভারতকে পশ্চিম ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হচ্ছে। ঢোলেরা একটি গ্রিনফিল্ড শহর। যেকোনও নগর নির্মানে সাধারনত দুটি প্রজেক্ট হয় গ্রিনফিল্ড শহর এবং ব্রাউন ফিল্ড শহর। গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট বলা হয় সেসব এলাকাকে যেখানে আগে কখনও শহর তৈরি হয়নি, কোনও পরিকাঠামো নেই, একেবারে নতুন করে শহর তৈরি করা হয়। ব্রাউনফিল্ড প্রজেক্ট বলা হয় সেসব এলাকাকে যেখানে আগে থেকেই শহর নির্মিত রয়েছে এবং পরবর্তীকালে সেগুলোর আধুনিকরন করা হয়। ঢোলেরাকে গ্রিনফিল্ড শহর বলা হয় কারন এখানে আগে কোনও শহর ছিলনা। 

ঢোলেরা স্মার্ট সিটি প্রজেক্টের দ্বিতীয় ধাপে এখানে উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হবে যাতে এই শহর পরবর্তীকালে ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে আরও মজবুত করতে পারে। কেন্দ্রীয় বানিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গোয়েল বলেছেন ঢোলেরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠবে। সহজ বানিজ্যিক নীতির মাধ্যমে ঢোলেরাতে ভারতের যেকোনও প্রান্তের থেকে শিল্পকারখানা তৈরি অনেক সহজ হবে। ঢোলেরাতে একটি বিশেষ প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র থাকবে যার নাম হবে এবিসিডি বা অ্যাডমিনিস্ট্রিটিড এন্ড বিসনেজ সেন্টার ফর ঢোলেরা। এই কেন্দ্র থেকে পুরো শহরকে নিয়ন্ত্রন করা হবে। সম্পূর্ন আধুনিক উপকরনে সজ্জিত এই শহরের কোথাও ভূমিকম্প হলে, আগুন লাগলে কিংবা কোনও দূর্ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে তার খবর এবিসিডিতে চলে যাবে। গুজরাট সরকার ঢোলেরা প্রজেক্টে আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে ৩০,০০০ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়েছে। ঢোলেরাতে প্লাগ ইন প্লে পদ্ধতিতে ব্যাবসায়িক সংস্থাগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হবে। যদি ভারতের কোনও প্রান্তে কোনও সংস্থাকে উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে হয় তাহলে প্রথমে সংস্থাটিকে জমি কিনতে হয়, এরপর সেখানে উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি শুরু হয়, তারপর শুরু হয় উৎপাদন। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কিন্তু ঢোলেরাতে সবকিছু আগে থেকেই তৈরি থাকবে শুধু সংস্থাগুলিকে নির্দিষ্ট এলাকা বেছে নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে, একেই প্লাগ ইন প্লে পদ্ধতি বলে যাতে ব্যাবসা শুরু করতে অনেক কম সময় লাগে। ইতিমধ্যেই টাটা ও এয়ারবাস জানিয়েছে তারা ঢোলেরাতে ২০,০০০ কোটি টাকার মূল্যে সি ২৯৫ সামরিক পরিবহন বিমান তৈরির কেন্দ্র তৈরি করবে। এই প্রথম কোনও ভারতীয় সংস্থা ভারতেই বিদেশী সংস্থার সাথে যৌথভাবে সামরিক বিমান তৈরি করবে। গুজরাট সরকার ঢোলেরাতে সেমিকন্ডাক্টর কেন্দ্র তৈরি করার জন্য সেমিকন্ডাক্টর নির্মান সংস্থা গুলিকে বিশেষ ছাড় দিতে চলেছে। যার ফলে সেমিকন্ডাক্টরের জন্য ভারতের আমেরিকা, চীন ও তাইওয়ানের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমবে।

ঢোলেরাতে ৪,৪০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুত কেন্দ্রও তৈরি করা হচ্ছে যা গোটা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। ভারতের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র হতে চলেছে এটি। ঢোলেরা প্রজেক্টের তৃতীয় ধাপে শহরের পরিকাঠামো তৈরির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। পুরো শহরে বিনামূল্যে ওয়াইফাই ব্যবস্থা ও সমস্ত জায়গায় সিসিটিভি থাকবে। দুবাই শহরের নিউরোল নেটওয়ার্কের মতো নেটওয়ার্ক থাকবে ঢোলেরাতেও। দুবাই শহরে পনেরো হাজার সিসিটিভি, আধুনিক সেন্সর ও যন্ত্রাংশ রয়েছে যাতে গোটা শহরের সমস্ত তথ্য প্রশাসনের কাছে থাকে, ঢোলেরাতেও এরকম ব্যবস্থা থাকবে। ঢোলেরারা নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সর্বাধুনিক হবে। চীনে অপরাধীদের ধরবার জন্য স্কাইনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যেখানে চীনে দুশো মিলিয়ন ক্যামেরা লাগানো আছে, অনেক ক্যামেরাতে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম রয়েছে। এসব ক্যামেরা দিয়ে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়। বিশেষ করে চীনের রাজধানী বেজিং পুরো সিসিটিভি দিয়ে ভর্তি। ঢোলেরার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খানিকটা এরকমই হবে। ঢোলেরা শহরের বাসিন্দাদের একটি বিশেষ অ্যাপ দেওয়া হবে যাতে শহরের সমস্ত নিয়ম, দোকান, পরিবহন সহ সমস্ত ব্যবস্থা থাকবে যাতে কারও কোনও সমস্যা না হয়। ঢোলেরা শহরের কাছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হচ্ছে যা  যাত্রীবাহী বিমান ও কার্গো বিমান উভয়েই ব্যবহার করতে পারবে। খামবাত উপসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায় ঢোলেরা থেকে সমুদ্র পথে পন্য পরিবহনও সহজ। আবার কেন্দ্রীয় সরকারের ডিএমআইসি করিডর ঢোলেরার পাশ দিয়েই গেছে। আমেদাবাদ থেকে মাত্র ৪৫ মিনিটের রেল দূরত্ব ঢোলেরাতে। সুতরাং যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পন্য পরিবহন ব্যবস্থাও খুব সহজ ঢোলেরাতে। যেকোনও গ্রিনফিল্ড শহর তৈরি হতে কমপক্ষে ৩০ বছর সময় লাগে। ঢোলেরা প্রজেক্ট ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে, তাই মনে করা হচ্ছে ২০৪৬ থেকে ২০৫০ এর মধ্যে এই প্রজেক্ট পুরো সম্পূর্ন হয়ে যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের এই ঢোলেরা আধুনিক শহরের আয়তন চীনের বানিজ্যিক রাজধানী সাংহাই শহরের আয়তনের থেকেও ছয়গুন বেশী এবং মুম্বাই শহরের থেকেও দ্বিগুন বেশী আয়তনে। ঢোলেরা প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে চীনের সেনজেন শহরের মতোনই ঢোলেরাও বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বানিজ্য ও উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে উঠবে এবং ভারতের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *