অফবিট

অতীতের ন্যায় আবারও সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করছে পর্তুগাল!

পর্তুগাল এমন একটি দেশ যে সমুদ্রকে সবসময় শাসন করার চেষ্টা করেছে। পর্তুগাল জানতো সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে ভূরাজনীতিতে তাদের আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে। ইউরোপ মহাদেশের একদম পশ্চিম তীরে স্পেনের পাশে অবস্থিত একটি ছোট দেশ পর্তুগাল। পর্তুগাল স্পেনের মতোই আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অংশ। আয়তনের দিক দিয়ে পর্তুগালের অবস্থান বিশ্বে ১০৯ তম। পর্তুগালের জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন। জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বে পর্তুগালের অবস্থান ৮৯ তম। বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগাল একটা সময় বিশ্বের গুটিকয়েক সুপার পাওয়ার দেশের মধ্যে একটি ছিল যারা ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের উপনিবেশ তৈরি করেছিল। সমুদ্রে আধিপত্য বিস্তারের নেশাই পর্তুগালের ইতিহাসে এমন এমন আবিষ্কারক ও নাবিকের জন্ম দেয় যাদের কারনে বিশ্বের মানচিত্র পুরো বদলে যায়, মানব ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়। যখন রোমান, গ্রীক, মিশর সহ বিশ্বের কিছু প্রাচীন সভ্যতার মানুষের বিশ্বাস ছিল বিশ্বে মানব জাতির বিস্তার কিছুটা অঞ্চল জুড়ে তখন পর্তুগীজরাই এই ধারনার পরিবর্তন ঘটায়। পর্তুগীজরা তাদের কৌতুহলের কারনেই পনেরো শতকে নতুন সমুদ্র পথ ও দেশ আবিষ্কারের এমন এক যাত্রা শুরু করে যা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসকে পুরো পাল্টে দেয়। একটা সময় দক্ষিন আমেরিকা থেকে শুরু করে এশিয়া মহাদেশ পর্যন্ত সর্বত্র উপনিবেশ ছিল তৎকালীন সময়ের এক মিলিয়ন বা দশ লাখেরও কম সংখ্যক জনবসতি পূর্ন এই ছোট ইউরোপীয়ান দেশটির। পনেরো শতকের দিকে পুরো ভারত মহাসাগরে রীতিমতো আধিপত্য ছিল পর্তুগীজদের। বিশ্বে মশলা বানিজ্যে একটা সময় পর্তুগীজদেরই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রন ছিল। বিশ্বের চারটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত পর্তুগীজ উপনিবেশের আয়তন বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের আয়তনের থেকেও বেশী ছিল। কিন্তু বাকী ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোর মতোই বিংশ শতাব্দী আসতে আসতে পর্তুগালের সাম্রাজ্যও ধ্বংস হয়ে যায়, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশবাদের অবসান ঘটে। ইউরোপের পশ্চিম তীরে অবস্থিত পর্তুগালের ভূখন্ড আয়তনে ছোট হলেও আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্তুগালের বিশাল সমুদ্র সীমা রয়েছে। পর্তুগাল বর্তমানে তার সমুদ্র সীমা আরও বিস্তারের পরিকল্পনা করেছে। যদি পর্তুগাল এই কাজে সফল হয় তাহলে ভূমি ও সমুদ্র সীমা মিলিয়ে পর্তুগাল আয়তনে বিশ্বের ষোলোতম দীর্ঘতম দেশে পরিনত হবে।

আজ থেকে প্রায় ছয়শো বছর আগে পর্তুগাল ইউরোপ মহাদেশের বাইরে নিজের আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। উপনিবেশ বিস্তারে পর্তুগাল বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরকে ব্যবহার করে। ১৩৪১ সালে পর্তুগীজ আবিষ্কারকরা সর্বপ্রথম আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয় নতুন ভূমি আবিষ্কারের জন্য। পর্তুগীজ অভিযাত্রীরা প্রথম আফ্রিকার ক্যানেরী দ্বীপে পৌঁছায়। পরে স্পেন ক্যানেরী দ্বীপ দখল করে নেয় কিন্তু ততদিনে পর্তুগাল যুদ্ধজাহাজ তৈরি, সঠিক মানচিত্র তৈরিতে দক্ষ হয়ে গিয়েছিল। পর্তুগীজ রাজা জন প্রথমের নজর পড়ে মরক্কোর উপর। মরক্কো সেসময় উত্তর আফ্রিকার একটি সমৃদ্ধ দেশ ছিল যেখানে সোনা, বিভিন্ন রকম মশলা সহ অন্যান্য দ্রব্য পাওয়া যেত। ১৪১৫ সালে রাজা জন প্রথমের নৌবাহিনী জিব্রাল্টার প্রনালী পেরিয়ে মুরদের দেশ মরক্কোর কিউটা প্রদেশ দখল করে নেয়। সেসময় ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো মাল্টা, সিসিলি, আইবেরিয়ান উপদ্বীপ ও আফ্রিকার মাগরিব অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীদের মুর বলতো এবং মরক্কোর জনসংখ্যার সিংহভাগই ছিল মুসলিম যার কারনে ইউরোপীয়ানরা মরক্কোর অধিবাসীদেরও মুর বলতো। এভাবেই শুরু হয় ইউরোপীয়ানদের উপনিবেশ বিস্তার যার শুরু পর্তুগাল করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর্তুগালই শেষ ইউরোপীয়ান দেশ হিসাবে ঔপনিবেশবাদের অবসান ঘটায়। 

রাজা জন প্রথমের ছেলে রাজকুমার হেনরী পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে বিশাল অভিযান চালায়। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকাতে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার, সোনা, মশলা ও ক্রীতদাস বানিজ্য থেকে অর্থ উপার্জন। পর্তুগালই প্রথম দেশ যারা আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে দক্ষিন ও মধ্য আমেরিকাতে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতো। রাজকুমার হেনরীর সময়েই পর্তুগীজরা আফ্রিকার সিয়েরা লিওন অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। ১৪৬০ সালে রাজকুমার হেনরীর মৃত্যুর পর পর্তুগালের এই সমুদ্রভিযান কিছু বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরে রাজা জন দ্বিতীয়র সময়ে আবারও অভিযান শুরু হয়। ১৪৮৭ সালে পর্তুগীজ নাবিক বার্তোলোমেউ ডায়াস আফ্রিকা থেকে ভারত পর্যন্ত অভিযানের পথ আবিষ্কারের চেষ্টা করে এবং দক্ষিন আফ্রিকা উপকূল থেকে ভারত পর্যন্ত সমুদ্রপথ তিনি আবিষ্কারও করে ফেলেন, এই পথের নাম হয় কেপ অফ গুড হোপ। ১৪৮৮ সালে ইতালির নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস পর্তুগীজ রাজা জন দ্বিতীয় এবং স্পেনের ইসাবেলা ফার্ডিনান্ডের কাছে এই পথে অভিযানের অনুমতি চায় এবং তিনি অনুমতি পেয়েও যান। কলম্বাসের নতুন ভূখন্ড আবিস্কারের পর পর্তুগাল ও স্পেন এসব নতুন ভূখন্ড নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এজন্য দুই দেশ নিজেদের মধ্যে  টর্ডেসিলাসের চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা মহাদেশকে স্পেন ও পর্তুগাল উভয়ের মধ্যে ভাগ করে নেয়। 

১৪৯৭ সালে বার্তোলোমেউ ডায়াসের নির্দেশিত পথ ধরেই পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা চারটি জাহাজ ও ১৭০ সদস্য নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ১৪৯৮ সালের মে মাসে ভাস্কো দা গামা ভারতের কালিকটে এসে উপস্থিত হয়। এরপরেই ইউরোপীয়ানদের ভারতে আসা শুরু হয়। ভাস্কো দা গামার ভারতে আসার পরেই ভারত মহাসাগরে দীর্ঘদিন ধরে অটোমান সাম্রাজ্য ও বাইজেনটাইনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমুদ্র বানিজ্যে ইউরোপীয়ানদের আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়। 

ভারত থেকে পর্তুগীজ নাবিকরা ১৫১২ সালে মশলার দ্বীপ অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া এবং ১৫১৪ সালে চীন পৌঁছায়। ১৫২২ সালে ফিলিপিন্স থেকে পর্তুগীজ নাবিক ম্যাগেলিনের এক সাথী স্পেন পৌঁছায় এভাবে পর্তুগাল ষোলো শতকে পুরো বিশ্বে সর্বপ্রথম সামুদ্রিক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ষোলো শতকের শেষের দিকে পর্তুগালের লিসবন থেকে জাপানের নাগাসাকি পর্যন্ত পর্তুগীজ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল যা উনবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্রাজিল থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত এবং ভারত থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পর্যন্ত পর্তুগীজ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। কিন্ত উনবিংশ শতাব্দীতে লিসবনে একটি বড় ভূমিকম্প এবং ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়নের পর্তুগালে আক্রমনের কারনে পর্তুগালের রাজপরিবার ব্রাজিলে পালিয়ে যায়। 

১৮২২ সালে পর্তুগাল বাধ্য হয় ব্রাজিলকে স্বাধীনতা দিতে। ব্রাজিলের মতোন বড় দেশে পর্তুগালের পীছু হটা ভূরাজনীতিতে পর্তুগালের প্রভাব কমিয়ে দেয়। আফ্রিকাতে ব্রিটিশদের আধিপত্যের কারনে পর্তুগাল আফ্রিকাতেও তার উপনিবেশের বিস্তার ঘটাতে পারেনি। তখন থেকেই পর্তুগালের উপনিবেশ বিস্তারে পীছু হটা শুরু হয় যদিও বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও পর্তুগালের কাছে একটি বড় সাম্রাজ্য ছিল। ১৯৩০ সালে পর্তুগালের শাসন ক্ষমতায় আসে এক দক্ষিনপন্থী স্বৈরাচারী নেতা অ্যান্টেনিও সালাজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমস্ত ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো ধীরে ধীরে তাদের উপনিবেশ গুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু পর্তুগাল এর বিপরীতে গিয়ে সামরিক ক্ষমতার জোরে তার উপনিবেশ গুলোকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। অ্যান্টিনিও সালাজার অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ভারতের গোয়া ও ম্যাকওকে পর্তুগালের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষনা করে। কিন্তু ১৯৬০ সালের পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ১৯৭৪ সালে ৪৩ বছর পর অ্যান্টিনিও সালাজারের পতন হয় পর্তুগালে এবং পর্তুগাল তার উপনিবেশ গুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া শুরু করে। ১৯৯৯ সালে পর্তুগালের শেষ উপনিবেশ ম্যাকাওকে চীনকে দিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে শেষ হয় ছয়শো বছর পুরোনো পর্তুগীজ ঔপনিবেশবাদ। তবে অতীতের মতোন আবারও সমুদ্রে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা শুরু করেছে পর্তুগাল। তবে শুধু পর্তুগালই নয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি সামরিক শক্তিশালী দেশই বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে যার একটাই কারন ওই দ্বীপ গুলোর আশেপাশে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার করা। আর্জেন্টিনা ও ব্রিটেনের মধ্যে ফাল্কল্যান্ড দ্বীপকে নিয়ে এই কারনেই যুদ্ধ হয়েছিল। পূর্ব চীন সাগরে জাপান ও চীনের মধ্যেও এরকই সোনকাকু দ্বীপকে নিয়ে সমস্যা রয়েছে। চীন দক্ষিন চীন সাগরেও কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির মাধ্যমে পুরো দক্ষিন চীন সাগর নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে। এসব দেশগুলোর একটাই লক্ষ্য নিজেদের ইইজিড বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও বেশী সামুদ্রিক সম্পদ উত্তোলন। 

জাতিসংঘের সামুদ্রিক আইন অনুযায়ী কোনও দেশের মূল ভূখন্ড থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে সেই দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বা ইইজেড বলে। এই ইইজেডের মধ্যে সমস্ত সামুদ্রিক সম্পদ সেই দেশটির হয়। এছাড়া কোনও দেশ তার ইইজেডের থেকে ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকাতেও সামুদ্রিক সম্পদ উত্তোলন করতে পারে তবে সেই অঞ্চল সেই দেশটির নয় কিন্তু সামুদ্রিক সম্পদে অধিকার রয়েছে দেশটির। সুতরাং যে দেশের সীমানা যত তার ইইজোডের পরিধিও বেশী। পর্তুগালের কাছে বিশ্বের ২১ তম বৃহত্তম ইইজেড রয়েছে। পর্তুগাল তার ইইজেডের বাইরে ১৫০ নটিক্যাল মাইল অঞ্চলের সীমানা আরও বাড়ানোর অনুরোধ করেছে জাতিসংঘে। যদি জাতিসংঘ পর্তুগালের অনুরোধ মেনে নেয় তাহলে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে পর্তুগালের ৩৮,৭৭,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হয়ে যাবে। তাহলে পর্তুগালের সমুদ্রসীমা বিশ্বের দশম বৃহত্তম হয়ে যাবে যা আয়তনে ভারতবর্ষ দেশের মোট ভূভাগের থেকেও বেশী হয়ে যাবে। পর্তুগাল তার এই পরিকল্পনার নাম রেখেছে পর্তুগাল ই মার বা পর্তুগাল সমুদ্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *