গোটা পৃথিবী জুড়ে চার কোটি লোককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কিভাবে উত্থান হয় মোঙ্গল সাম্রাজ্যের?
বিশ্ব ইতিহাসকে দুই শতাব্দী ধরে প্রভাবিত করে মোঙ্গল সাম্রাজ্য। একটা সময় মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সীমানা পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়াতে জাপানি সমুদ্র পর্যন্ত ছিল। ২৪ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত মোঙ্গল সাম্রাজ্য সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল। মোঙ্গল সেনাদের সবচেয়ে নিষ্ঠুর বলা হয় ইতিহাসে। বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বলা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এতটাই বিশাল ছিল আয়তনে যে বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্যাস্ত হয়না। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আয়তনে বিশাল হলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে বিস্তৃত ছিল কিন্তু মোঙ্গল সাম্রাজ্য, একটানা বিস্তৃত এলাকা ছিল অর্থাৎ আশেপাশের সমস্ত প্রদেশ, দেশ মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, এই হিসাবে মোঙ্গল সাম্রাজ্যকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যও বলা হয়। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল মঙ্গোলিয়া থেকে।
১২০৬ সালে মঙ্গোলিয়া এলাকার বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় এক হয়ে তাদের নতুন শাসক নির্বাচন করে তেমুজিনকে যে পরে চেঙ্গিস খান নাম গ্রহন করে।
দশম শতকে মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর চীনের নিয়ন্ত্রন ছিল চীনের লিয়াও রাজবংশের হাতে। ১১২৫ সালে জিন রাজবংশ লিয়াও রাজবংশকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করে। জিন রাজবংশের শাসকদের সোনালী শাসক বলা হত। কিন্ত মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে জিন রাজবংশের নিয়ন্ত্রন লিয়াওদের মতোন মজবুত ছিলনা। কারন মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে কেরাইটস, খামাগ মঙ্গোল, নেইমান, মেরগিড এবং তাতার এই পাঁচটি উপজাতির প্রভাব ছিল। এই সমস্ত উপজাতির মধ্যেই পারস্পরিক বিবাদ ছিল বিশেষ করে তাতার ও খামাগ মোঙ্গলদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শত্রুতা ছিল। এরই সুবিধা নেয় জিন রাজবংশ।
চেঙ্গিস খানের দাদু খাবুল খানের বিদ্রোহ প্রতিহত করে জিন রাজবংশ। খাবুল খানের পর মোঙ্গল দের নেতা আমবাঘাই খানকে তাতাররা বিশ্বাসঘাতকতা করে গ্রেপ্তার করে জিন রাজবংশের শাসক জুরচেনকে দিয়ে দেয়, এবং তাকে হত্যা করা হয়। এরপর মোঙ্গলরা জিন রাজবংশের উপর আক্রমন শুরু করে বারংবার, তবে ১১৪৩ সালে জিন রাজবংশের সাথে মোঙ্গলদের শান্তি চুক্তি হয়। এরপর মোঙ্গলরা তাতারদের উপর প্রতিশোধের জন্য আক্রমন শুরু করে। ১১৬১ সালে তাতাররা জিন রাজবংশের সেনাবাহিনীর সাথে যৌথভাবে মোঙ্গলদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরজিত করে। এর কিছু বছর পর মঙ্গোলিয়ায় এক শক্তিশালী শাসক তেমুজিনের উদ্ভব হয়। সেসময় শক্তিশালী মোঙ্গল শাসক ছিল কুরতেইত যে নিজেকে ওয়াং বলতো, চাইনিজ ভাষায় ওয়াং শব্দের অর্থ রাজা। তেমুজিন কুরতেইতকে পরাজিত করে চেঙ্গিস খান উপাধি গ্রহন করে। চেঙ্গিস খান দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কিছু নীতি পরিবর্তন করেছিল। যেমন মোঙ্গলরা যুদ্ধে জিতলে শত্রুর সম্পত্তি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড়লোক সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হত কিন্তু চেঙ্গিস খান সমস্ত অর্জিত সম্পদ তার প্রত্যেক সেনা ও তার পরিবারের মধ্যে ভাগ করে নিত। যার কারনে সাধারন মোঙ্গল সেনাদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু চেঙ্গিস খানের এই নীতির বিরোধীতা করে মোঙ্গল শাসক পরিবারের অনেক সদস্য কিন্তু চেঙ্গিস খান তার সব শত্রুদের একে একে শেষ করে দেয়।
১২০৫ সাল আসতে আসতে মোঙ্গোলিয়াতে এমন কেউ ছিলনা যে চেঙ্গিস খানের বিরোধীতা করবে, এখান থেকেই শুরু হয় মোঙ্গল সাম্রাজ্যের উত্থান। চেঙ্গিস খান প্রথমেই তার সেনাবাহিনী গঠনে মনোযোগ দেয়। চেঙ্গিস খান তার সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে যেমন আরবানস যাতে দশজন করে সেনা ছিল, জুনস যাতে একশো জন করে সেনা ছিল, মিংঘানস যাতে হাজার জন করে সেনা ছিল, তুমিনস যাতে দশ হাজার জন করে সেনা ছিল। এছাড়া দিনের বেলায় রাজপ্রহরী বিভাগকে খোরচিন টরঘুদস এবং রাতের বেলায় রাজপ্রহরী বিভাগকে কেভটুল বলা হত। চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনীতে নিয়ম ছিল চেঙ্গিস খানের প্রতি নিষ্ঠা ও বীরত্ব দেখাতে পারলে সে ধাপে ধাপে সেনাবাহিনীর উচ্চপদেও যেতে পারতো। সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেই চেঙ্গিস খান প্রথমে উত্তর চীনের জিয়া রাজবংশের উপর ১২১১ সালে আক্রমন করে জিয়া প্রদেশ দখল করে নেয়। চেঙ্গিস খান জিয়া প্রদেশ আক্রমন করে রেশম পথ নিয়ন্ত্রনের জন্য যাতে তার আর্থিক লাভ হয় ব্যবসা থেকে। জিয়া দখল করে তিব্বত ও কারা খাইতাই প্রদেশের সাথেও কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চেঙ্গিস খান। জিন রাজবংশের উপর আক্রমন শুরু করে চেঙ্গিস খান ১২১১ সালের আগস্ট মাসে। উভয়ের মধ্যে ইয়েদুলিং এর যুদ্ধ হয় আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যাতে মোঙ্গল সেনা জিন রাজবংশকে পরাজিত করে।
জিন রাজবংশের সেনাবাহিনীর সংখ্যা মোঙ্গলদের থেকে অনেক বেশী ছিল কিন্তু জিনরা আক্রমনের বদলে নিজের এলাকাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল যার কারনে চেঙ্গিস খান পূর্ন আক্রমন শুরু করে এবং জিন রাজবংশ পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় তিন লাখ জিন সেনার মৃত্যু হয়। এরপর মোঙ্গল সেনা জিনদের রাজধানীর উপর আক্রমন করে। বলা হয় সেসময় জিনদের রাজধানীতে ধাতুর পরিমান কম থাকায় অস্ত্র তৈরির জন্য সোনা ও রূপোর মুদ্রা ব্যবহার করা হয় কিন্তু তা সত্বেও জিনদের রাজধানী দখল করে নেয় চেঙ্গিস খান। জিন শাসক রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় নিজের রাজধানী তৈরি করে। ১২১৫ সাল আসতে আসতে অর্থাৎ চেঙ্গিস খান মোঙ্গল শাসক হওয়ার দশ বছরের মধ্যে জিন রাজবংশের অর্ধেক এলাকা দখল করে নেয়। এরপর চেঙ্গিস খান চীনের আরও একটি সাম্রাজ্য কারা কিতাই দখল করে। এই কারা কিতাই সাম্রাজ্যের শাসক চেঙ্গিস খানের এক নাতিকে হত্যা করেছিল যার প্রতিশোধ নিতে পুরো সাম্রাজ্যই দখল করে নেয় চেঙ্গিস খান। কারা কিতাই এর সীমানা ছিল আরও একটি বড় চাইনিজ সাম্রাজ্য খোয়ারজমের সাথে। চীনের রেশম পথে খোয়ারজম সাম্রাজ্যের প্রভাব সবচেয়ে বেশী ছিল যার কারনে চেঙ্গিস খান প্রথমে পাঁচশো ব্যক্তির একটি দল খোয়ারজমের শাসক শাহ আলাউদ্দিন মহম্মদের কাছে পাঠায় ব্যাবসায়িক চুক্তির জন্য কিন্তু খোয়ারজমের সেনারা এই দলের উপর আক্রমন করে তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নেয়। কিন্তু এরপরেও চেঙ্গিস খান তার আরও তিন রাজদূতকে শাহ আলাউদ্দিনের সভায় পাঠায়। কিন্তু শাহ আলাউদ্দিন চেঙ্গিস খানের তিন রাজদূতকে অপমান করে একজনকে হত্যা করে। এই অপমান মানতে পারেনি চেঙ্গিস খান, এরপর প্রায় দুই লাখ সেনাযুক্ত বিশাল সেনা গঠন করে চেঙ্গিস খান খোয়ারজম সাম্রাজ্যে আক্রমন শুরু করে। খোয়ারজমে আক্রমনের জন্য পুরো মোঙ্গল সেনাবাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমেই ওটরার শহর আক্রমন করে মোঙ্গল সেনা, এখানেই আটক করা হয় শাহ আলাউদ্দিনের প্রতিনিধি ইনালচুককে। ইনালচুক একসময় চেঙ্গিস খানের পাঁচশো প্রতিনিধির উপর আক্রমন করেছিল, ইনালচুককে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এবং ওটরার শহরে নরসংহার করে মোঙ্গল সেনা। এরপর বুখারা শহর দখল করে মোঙ্গল সেনা। বুখারা দখলের পরেই খোয়ারজম সাম্রাজ্যের রাজধানী সমরকন্দে আক্রমন করে মোঙ্গল সেনাবাহিনী। সমরকন্দ শহরও দখল করে নেয় মোঙ্গল সেনাবাহিনী এবং এখানেও নরসংহার করা হয়।
মোঙ্গলরা সবচেয়ে বড় নরসংহার করেছিল নিশাপুরে। নিশাপুরের নাগরিকরা মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং এই বিদ্রোহে ১২২১ সালে চেঙ্গিসখানের জামাই তুকাচারের মৃত্যু হয়। এরপর চেঙ্গিস খানের মেয়ে তার বাবাকে জানায় পুরো নিশাপুর শহরকে ধ্বংস করে দিতে যেন কেউ না বাঁচে। মোঙ্গল সেনাবাহিনী দশ দিনে পুরো শহরের সমস্ত বাসিন্দাদের হত্যা করে নরমুন্ডুর পিরামিত তৈরি করে। মহিলা, পুরুষ, বাচ্চাদের মাথার আলাদা আলাদা পিরামিড তৈরি করা হয়েছিল। চেঙ্গিস খান তার পুরো শাসনে চীন ও ইরানে অন্তত ৪০ মিলিয়ন বা প্রায় চার কোটি লোককে হত্যা করেছিল।