অফবিট

গুজরাটের কোন যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইউরোপীয়ান অধ্যায় শুরু হয়েছিল জানেন?

বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত ভারতবর্ষের সাথে প্রাচীন কাল থেকেই বানিজ্যের জন্য বহু দেশের সাথেই সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভারতীয় মশলা, পোষাকের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারত মহাসাগর হয়ে মালাক্কা প্রনালী দিয়ে কিংবা লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল দিয়ে ভূমধ্যসাগরের মাধ্যমে আফ্রিকা ও ইউরোপ, সবদিকেই ভারতীয় ব্যাবসায়ীদের অবাধ গতি ছিল। বরাবরই ভারত ছিল আন্তর্জাতিক বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। যার কারনে বারবার ইউরোপীয়ান দেশগুলোর প্রতিনিধি ভারতের বন্দর শহর গুলোতেই আসত কারন এখান থেকেই বানিজ্যের জন্য সুবিধা হত। তবে পনেরো শতকের দিকে ভারতের বন্দর দখলের জন্য ইউরোপীয়ান শক্তিগুলো রীতিমতো নৌবহর নিয়ে এসেছিল। এমনই একটি যুদ্ধ হয়েছিল ভারতের অন্যতম সুন্দর শহর গুজরাটে। গুজরাটেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী এবং ভগবান মহাদেবের সোমনাথ তীর্থ রয়েছে, এই গুজরাটের দিউতেই পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধ হয়েছিল গুজরাটের সুলতান, কালিকট ও মিশরের মমলুকদের যৌথ বাহিনীর, যাতে বিজয়ী হয় পর্তুগীজরা। এই যুদ্ধের পর ভারতের ইতিহাসে ইউরোপীয়ান অধ্যায় শুরু হয়।

২০ মে, ১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ভারতে উপস্থিত হয়। ভাস্কো দা গামা কেরালার কালিকট বন্দর বা আজকের কোঝিকোড়ের কাপ্পাডে প্রথম ভারতীয় ভূখন্ডে নামে। ভাস্কো দা গামার ভারতে আসার দুবছরের মধ্যে পর্তুগীজরা বুঝে যায় তারা পশ্চিম আফ্রিকাতে যেভাবে বানিজ্য করতো তেমনটা ভারতের এই পশ্চিম উপকূলে করা সম্ভব হবেনা কারন ভারতীয় ব্যাবসায়ীদের প্রতিরোধ। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল প্রথম ১৫০০ সালে ভারতে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে পেড্রো আলভারেজ ক্যাব্রালের নেতৃত্বে নৌবহর পাঠায়। পেড্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল ও তার দল ব্রাজিল আবিষ্কার করেছিল। এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল কালিকটের শাসক জামোরিনের সাথে বানিজ্যিক চুক্তি করা। এর আগে ভাস্কো দা গামাও জামোরিনের সাথে চুক্তি করতে চেয়েছিল কিন্তু তা ব্যার্থ হয়। পেড্রো ক্যাব্রাল জামোরিনের সাথে চুক্তি করতে সফল হয় এবং কালিকটে প্রথম পর্তুগীজ ফ্যাক্টরি তৈরি করে। এই ফ্যাক্টরির প্রধান নিযুক্ত করা হয় আইরেস কোরিয়াকে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই কালিকট বাজারে আরব ব্যাবসায়ীরা পর্তুগীজদের বানিজ্যে বাধা দেওয়া শুরু করে। সেসময় কালিকটের বাজারে আরব ব্যাবসায়ীদের প্রধান্য ছিল তারা এর আগে চাইনিজ ব্যাবসায়ীদেরও কালিকটের বাজার থেকে বের করে দিয়েছিল। পেড্রো ক্যাব্রাল জামোরিনের কাছে অভিযোগ জানায় কিন্ত জামোরিন এব্যাপারে কিছু করতে পারবেনা জানিয়ে দেয়। 

কিছুদিনের মধ্যে আরব ব্যাবসায়ীরা রীতিমতো বিদ্রোহ করে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যাতে প্রায় ৭০ জন পর্তুগীজ নিহত হয় এবং বেশ কিছু পর্তুগীজ জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রান বাঁচায়, পর্তুগীজদের ফ্যাক্টরি দখল করে নেওয়া হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা কালিকট হত্যাকান্ড নামে কুখ্যাত। এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পর্তুগীজরা কোচিনের রাজার সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, সেসময় কোচিন ও কালিকটের মধ্যে শত্রুতা ছিল। এই খবর জানতে পেরে জামোরিন কোচিন আক্রমন করে। 

১৫০৪ সালের ডিসেম্বরে পর্তুগীজ নৌবাহিনী জামোরিনের বানিজ্যিক জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। এই জাহাজে মিশরের জন্য মশলা সহ অন্যান্য বানিজ্যিক দ্রব্য যাচ্ছিল। পর্তুগীজদের কারনে ভারত মহাসাগরে বানিজ্যিক সমস্যায় পড়ে কালিকট, আরবরা এবং ভেনিস। সেসময় ইতালির ভেনিসের সাথে বানিজ্য হত কালিকটের। ভারত মহাসাগর প্রায় অবরুদ্ধ করে দেয় পর্তুগীজরা। বাধ্য হয়ে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য জামোরিন মিশরের কাছে সাহায্য চায়। মিশরে সেসময় মামলুক রাজবংশের শাসন ছিল। এদিকে ভেনিসও পর্তুগালের সাথে সমস্ত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে মিশরে দূত পাঠায় পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু মামলুক সেনাদের নৌযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন কোনও অভিজ্ঞতা ছিলনা যার কারনে মামলুক শাসক  আল-আশরাফ কোয়ানসুহ আল-গাওরী ভেনিসের কাছে সাহায্য চায়। 

বানিজ্য কর ছাড়ের বিনিময়ে ভেনিস যুদ্ধজাহাজ ও অস্ত্র দেয় মিশরকে। কুর্দিশ মামলুকের নেতৃত্বে এগারোশো সেনার একটি বহর রওনা হয় পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। এই সেনার মধ্যে মামলুক ছাড়াও, তুরস্ক, ইথিওপিয়া এবং ভেনিসের ভাড়াটে সেনারাও ছিল। এই দলকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল বর্তমান সৌদি আরবের জেদ্দাকে পর্তুগালের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। আসন্ন বর্ষাকালে সমুদ্র যাত্রায় সমস্যার কথা চিন্তা করে ইয়ামেনের কামারান দ্বীপে এই নৌবহর বর্ষাকালটা অতিবাহিত করে তারপর আবারও ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। 

অবশেষে ১৫০৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই নৌবহর ভারতের দিউয়ে এসে পৌঁছায়। সেসময় গুজরাটের সুলতান মালিক আয়াজকে দিউয়ের গভর্নর নিয়োগ করেছিল। গুজরাট সেসময় ভারতের অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। গুজরাটি ব্যাবসায়ীরা চীন থেকে রেশম এবং কেরালা থেকে মশলা এনে মিশর ও আরবে বানিজ্য করতো। জামোরিন মালিক আয়াজের কাছে দূত পাঠায় দিউয়ে পৌঁছানো নৌবহরকে সহায়তার জন্য। মলিক আয়াজ প্রথমে রাজি হয়নি কারন সে জানতো পর্তুগীজ নৌবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী কিন্তু পরে রাজি হয়ে যায়। মার্চ, ১৫০৮ সালে চাউলে পর্তুগীজ নৌবাহিনীর সাথে দিউয়ে আসা মিশর, ভেনিস, জামোরিন ও মালিক আয়াজের নৌবাহিনীর তিনদিন ব্যাপী যুদ্ধ হয় যাতে পর্তুগীজ নৌবাহিনী পরাজিত হয়, এই যুদ্ধে ভারতে নিযুক্ত প্রথম পর্তুগীজ ভাইসরয় ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডার ছেলে লোরেনকো ডি আলমেডার মৃত্যু হয়। যদিও এই যুদ্ধে পর্তুগীজরা পরাজিত হয় তবুও যুদ্ধে জামোরিন ও মিশরের নৌবাহিনীও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে পর্তুগীজরাও এত সহজে পরাজয় বরন করতে রাজি ছিলনা তারা পুনরায় যুদ্ধের প্রস্ততি শুরু করে। 

১৫০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পারস্য উপসাগর হয়ে কেরালায় এসে উপস্থিত নতুন পর্তুগীজ ভাইসরয় আফনসো ডি আলবুকার্ক। কিন্ত ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা পর্তুগীজ রাজার আদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে আফনসো ডি আলবুকার্ককে কারন ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা তার ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। ততদিনে মালিক আয়াজও বুঝতে পারে মামলুকদের সহায়তা করতে গিয়ে সেও ভুল করে ফেলেছে। ৯ ডিসেম্বর কোচিন থেকে পর্তুগীজ নৌবহর দিউয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কোচিন থেকে কালিকটে পৌঁছে পর্তুগীজ নৌবহর দেখতে মামলুক নৌবহর সেখান থেকে আগেই পালিয়ে গেছে ভয়ে। সেসময় পর্তুগীজদের গুপ্তচর ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী তারা জামোরিনের প্রত্যেক গতিবিধির খবর আগেই পেয়ে যেত। 

পর্তুগীজ নৌবহর যখন বোম্বাই পৌঁছায় তখন মালিক আয়াজ ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডাকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটি চিঠি লেখে কিন্তু ভাইসরয় মালিক আয়াজকে জানিয়ে দেয় সে যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তত থাকে নাহলে দিউকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। ১৫০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারী অবশেষে পর্তুগীজ নৌবাহিনী দিউ এসে পৌঁছায়, সকাল এগারোটা থেকে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধে পর্তুগীজ নৌবাহিনীর সামনে পরাজিত হয় মামলুক, গুজরাটের সুলতান, কালিকটের সম্মিলিত নৌবাহিনী। দিউয়ের যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। বলা হয় এই যুদ্ধে যদি পর্তুগীজরা হেরে যেত তাহলে ভারতে ব্রিটিশরা কখনওনই আসতোনা। দিউয়ের যুদ্ধের সময় পর্তুগীজদের থেকে মামলুক, গুজরাটের সুলতান ও কালিকটের সম্মিলিত নৌবহর সংখ্যায় অধিক ছিল। 

পর্তুগীজ নৌবাহিনীতে সেসময় ১৮ টি জাহাজ এবং ১,২০০ সেনা ছিল। অপরদিকে সম্মিলিত নৌবাহিনীতে ৪৬ টি জাহাজ, ১৫০ টি ছোট নৌকা ও প্রায় পাঁচ হাজার গুজরাটি সেনা ও ৪৫০ মামলুক সেনা ছিল। এত বিশাল নৌবহর থাকা সত্বেও সম্মিলিত নৌবাহিনী হেরে যায় কারন পর্তুগীজ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ গুলো অনেক বেশী আধুনিক ও শক্তিশালী ছিল।

দিউয়ের যুদ্ধের পরই ভারতে পর্তুগীজরা গোয়া দখল করে, এরপর একে একে ডাচ, ফরাসি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে। এই যুদ্ধের পর মালিক আয়াজ সমস্ত পর্তুগীজ বন্দীদের ফিরিয়ে দেয়। তবে ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা দিউ শাসন করেনি, তিনি জানান দিউ শাসন করতে অনেক খরচ। তিনি মালিক আয়াজের সাথে বানিজ্য চুক্তি করেন এবং দিউতে একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করেন। ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা তিন লাখ স্বর্নমুদ্রা নেয় এই যুদ্ধের পর যার মধ্যে এক লাখ পর্তুগীজ সেনাদের মধ্যে বিতরন করে দেওয়া হয় এবং দশ হাজার দেওয়া হয় কোচিন হসপিটালকে। ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা এরপর আফনসো ডি আলবুকার্ককে ভাইসরয়ের দায়িত্ব দিয়ে নভেম্বর মাসে পর্তুগালের উদ্দেশ্যে ফিরে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *