অফবিট

ডুবে যেতে চলেছে পৃথিবীর ভাসমান শহর ভেনিস! শহরের উচ্চতা বাড়াতে কি প্ল্যান করছে ইটালি?

মাটির তলা থেকে ভূগর্ভস্থ জল অতিরিক্ত তুলে নিলে উপরের মাটি আরও বসে যায় যেমন কিছু মাস আগেই জোশিমঠে হয়েছিল এমন ঘটনা। ঠিক তেমনই কোন শহরের ভূমির নীচে অতিরিক্ত জল প্রবেশ করিয়ে শহরের উচ্চতা কিছুটা হলেও বাড়ানো সম্ভব, এই ঘটনা শুনতে অবাস্তব মনে হলেও খুব শীঘ্রই এমন ঘটনারই পরীক্ষা হতে চলছে ইতালির শহর ভেনিসে। বিশ্ব উষ্ণয়নের কারনে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরে অবস্থিত ইউরোপের শহর ভেনিসের পাশে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্রের জলস্তর থেকে মাত্র তিন ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভেনিস শহর অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্রে ডুবে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালে সমুদ্রের অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসের কারনে প্রায় ৮০ শতাংশ ভেনিস শহর তিন থেকে চার ফুট জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। বিগত কয়েক বছরে এধরনের সামুদ্রিক বান প্রায়ই আসছে ভেনিস শহরে। সামুদ্রিক গবেষনায় দেখা গিয়েছে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারনে আগামী একশো বছরের মধ্যে ভেনিস শহর সমুদ্রের তলায় চলে যেতে পারে। এইজন্য ইতালির সরকার ভেনিসকে বাঁচানোর জন্য ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের সাহায্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। ভেনিস শহরকে রক্ষা করার জন্য ভূমির নীচে ছয়শো থেকে এক হাজার মিটার গভীরতা পর্যন্ত উচ্চচাপে সমুদ্রের জল প্রবেশ করানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে গোটা ভেনিস শহরের গড় উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার অবধি বেড়ে যাবে। তবে এই পরিকল্পনা শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে কিন্ত যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং।

উত্তর পূর্ব ইতালির ভেনাটো অঞ্চলের রাজধানী শহর ভেনিস। ১২৬ টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভেনিস শহরকে ভাসমান শহর বা খালের শহরও বলা হয়। চারিদকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর দ্বারা বেষ্ঠিত ভেনিস শহরের মধ্যে দিয়ে গেছে অসংখ্য ছোট ছোট ক্যানেল বা খাল। 

সমুদ্রপৃষ্ঠ  থেকে মাত্র এক মিটার উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় দূর থেকে ভেনিস শহরের পরিকাঠামো গুলো দেখে মনে হয় যেন জল থেকে উঠে আসছে। প্রতিবছর সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক লাখ পর্যটক ভেনিস শহরের সৌন্দর্যের টানে আকৃষ্ট হয়ে এখানে ছুটে আসে। ইতালির সরকারের একটি তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ভেনিস শহরে প্রায় ১.৪ মিলিয়ন বা ১৪ লাখ পর্যটক এসেছিল যেখানে ভেনিস শহরের মোট জনসংখ্যাই প্রায় ২.৬২ লাখ। ২০১৯ সালে হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা মার্ভেলের স্পাইডারম্যান ফার ফ্রম হোমে এই ভেনিস শহর ধ্বংস হওয়ার ঘটনাই দেখানো হয়েছিল। ভেনিস শহরের জনপ্রিয়তা এতটাই বেশী যে প্রতিবছর শহরটির মোট জনসংখ্যার পাঁচ গুন মানুষ এই শহর ভ্রমনে আসে। ৪২১ এডিতে সমুদ্রের প্রায় অর্ধ জলমগ্ন ভূমিতে তৈরি হওয়া এই ভেনিস শহরকে আজও রোমান সাম্রাজ্যের অসাধারন কারিগরী দক্ষতা বলে মনে করা হয়। 

৪২১ এডিতে ইউরোপের এই অঞ্চলে বার্বেরিয়ানরা আক্রমন করতো প্রায়ই। যার কারনে সেসময় ১২৬ টি দ্বীপকে একত্রিত করে তার উপর একটি শহর তৈরি করবার সিদ্ধান্ত নেয় রোমান সম্রাট। কিন্তু এই ১২৬ টি দ্বীপ সমুদ্রের জলস্তরের সামান্য উপরে অবস্থিত হওয়ায় এবং এই অঞ্চল জলমগ্ন হওয়ায় এখানে শহর নির্মান করা যথেষ্ট সমস্যার ছিল। শহর নির্মানের জন্য দুটো পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। প্রথম পরিকল্পনায় ঠিক করা হয় জলমগ্ন ভূমিকে প্রচুর মার্বেল পাথর দিয়ে শক্ত করে তার উপর শহর তৈরি করা হবে। কিন্তু এত বিশাল শহর নির্মানের জন্য প্রচুর মার্বেল পাথরের প্রয়োজন পড়ত, এত মার্বেল পাথর ইতালিতেও ছিলনা তখন, তাছাড়া মার্বেল পাথরের দামও প্রচুর। তাই এই পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পরিকল্পনায় ঠিক করা হয় কাঠের পিলার তৈরি করে তার উপর শহর নির্মান করা হবে। গাছ ইতালিতে পর্যাপ্ত পরিমানে ছিল এবং এই ভাবেই ভেনিস শহর নির্মান করা হয় যাতে খরচও অনেক কম হয়। আজও ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এমন কাঠের পিলারের বাড়ি দেখা যায়। ভেনিস শহরের ভিত তৈরিতে চার থেকে আট মিটার লম্বা জল প্রতিরোধক কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধানত এলম, ওক, এলডার ও পপলার কাঠ ইতালির জঙ্গল থেকে এইসব দ্বীপে এনে পেন্সিলের মতোন কেটে জলাভূমিতে আট মিটার গভীরতা অবধি গেঁথে দেওয়া হয়। এরপর ওইসব কাঠের পিলারের মধ্যবর্তী অংশে পাথর দিয়ে ভর্তি করা হয়। এই পদ্ধতিতে এক বর্গমিটার এলাকা তৈরি করতে অন্তত ছয় থেকে বারোটি পিলার লেগে যায়। শুধু ভিতই নয় বরং ভেনিস শহরের পরিকাঠামোও প্রথমে কাঠের তৈরি করা হয় যাতে ভিতের উপর চাপ কম পড়ে। এই পদ্ধতিতে ভিত তৈরি করে তার উপর পরিকাঠামো তৈরি করতে কয়েক মাস লেগে যেত। ভেনিস শহরে যত পরিকাঠামো হয়েছে তার মধ্যে স্যান জ্যাকারিয়া গীর্জা তৈরি করতেই সবচেয়ে বেশী সময় লেগেছে। 

চোদ্দ শতকে তৈরি হওয়া এই গীর্জা তৈরি করতে ছয় হাজার কাঠের পিলার ব্যবহার করা হয় কিন্তু গীর্জা তৈরির জন্য এর ভিত তৈরি করতেই সাত হাজার কাঠের পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো ভেনিস শহরের ভিত তৈরি করতে প্রায় এগারো মিলিয়ন কাঠের পিলারের ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্ত বর্তমানে সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধির কারনে সমস্যা বেড়েছে শহরটিতে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে ২০১৯ সালের নভেম্বরে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের জলস্তর ৬.১ ফুট বা ১৮৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছিল যা বিগত একশো বছরের মধ্যে সর্বাধিক। ভেনিস শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন ফুট উপরে অবস্থিত হওয়ায় সিংহভাগ শহরই জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে ভেনিস শহর থেকে মানুষ জনকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় ভেনিসে এক বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক ক্ষতি হয়। ভেনিসে এই ঘটনাকে অ্যাকোয়াএল্টা বলা হয়। 

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী যদি বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি পায় তাহলে সমুদ্রে জলস্তর ৩২ সেন্টিমিটার বা এক ফুট বেড়ে যাবে, যদি তাপমাত্রা চার ডিগ্রি বৃদ্ধি পায় তাহলে জলস্তর ১৮০ সেন্টিমিটারের বেশী বা ৬ ফুট বেড়ে যাবে যার অর্থ আশি শতাংশের বেশী ভেনিস শহর চিরকালের জন্য সমুদ্রের তলায় চলে যাবে। এই কারনে ইতালি সরকার ২০০৩ সাল থেকেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ব্যারিয়ার সিস্টেম মোস ব্যারিয়ার নির্মান শুরু করেছে। ২০১১ সালে এই প্রজেক্ট শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু এই প্রজেক্ট এতটাই জটিল ও ব্যায়বহুল যে এটি তৈরি করতে কুড়ি বছর লেগে যায়। ২০২৩ সালে এই পুরো সিস্টেম তৈরি হয়ে যায়। কুড়ি বছর ধরে এই প্রজেক্টে খরচ হয়েছে আট বিলিয়ন ডলার। মোস ব্যারিয়ারে ৭৮ টি ধাতব প্লেট রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ২০ মিটার এবং উচ্চতা ২৯ মিটার। এগুলো সমুদ্রের তলায় বিশেষ কংক্রিটের খাপে থাকে কিন্তু সমুদ্রে বানের সংকেত এলেই এগুলোকে জল থেকে ওঠানো হয় যাতে সমুদ্রের জল শহরে খুব বেশী প্রবেশ করতে পারেনা। মোস ব্যারিয়ার ৩ ফুট পর্যন্ত সমুদ্রের জলকে আটকাতে সম্ভব। কিন্তু এই মোস ব্যারিয়ার চালনা করা অত্যন্ত ব্যায়বহুল, ভেনিস শহরে বছরে বেশ কয়েকবারই এমন বান আসছে যাতে এই মোস ব্যারিয়ার চালনা করেও জল পুরোপুরি আটকানো সম্ভব হচ্ছেনা। যার কারনে ইতালির সরকার এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজছে। এখানেই পরিকল্পনা করা হয়েছে মাটির মধ্যে সমুদ্রের জল প্রবেশ করিয়ে ভেনিস শহরের উচ্চতা স্থায়ীভাবে বাড়ানো হবে। 

সাধারনত মাটির একশো মিটার গভীরতায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর থাকে, তবে স্থান বিশেষে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের গভীরতা বিভিন্ন রকম হয়। ভেনিস শহরে ভূগর্ভস্থ জলস্তর রয়েছে ৬৫০ থেকে ১০০০ মিটার গভীরতায়। ইঞ্জিনিয়াররা প্রথমে ভেনিস শহরের মাঝামাঝি দশ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন জায়গায় গর্ত করে উচ্চচাপে সমুদ্রের জল ভূগর্ভস্ত জলস্তরে পাঠাবে যদি এই পরীক্ষা সফল হয় তাহলে পুরো ভেনিস শহর জুড়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে শহরের উচ্চতা কৃত্রিম ভাবে বৃদ্ধি করা হবে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় দশ বছর সময় লাগবে যাতে ভেনিস শহরের উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার অবধি বেড়ে যাবে। তবে এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে সমস্যা হল অতিরিক্ত জল প্রবেশ করালে পুরো শহরের পরিকাঠামোয় ফাটল দেখা যাবে সেকারনে বর্তমানে শহরের ভৌগলিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু এই শুধু পদ্ধতিতে ভেনিস শহরের সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবেনা কারন গত ২০১৯ সালে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে যে বান এসেছিল তাতে জলস্তর ১৫০ সেন্টিমিটারের বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল, সুতরাং ভেনিস শহরের উচ্চতা অন্তত এক থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ইতালির পাডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোলজি এবং হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী শিক্ষক পিয়েত্রো টিয়েটিনির কথায় সমুদ্রের জল প্রবেশ করিয়ে ৩০ সেন্টিমিটারের বেশী উচ্চ করা সম্ভব নয় ভেনিস শহরকে, কারন এই বেশী উচ্চ করতে গেলে শহরের ভিত অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। তবে এই পদ্ধতিতে অন্তত আগামী কয়েক শতাব্দীর জন্য ভেনিস শহর নিরাপদ হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *