দাসত্ব প্রথাকে সরাতে গিয়ে নিজের প্রান পর্যন্ত গিয়েছিল। অবাক করা ইতিহাস আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের
আজ থেকে প্রায় ২১৪ বছর আগে ১২ ফেব্রুয়ারী, ১৮০৯ সালে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে মহান রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের জন্ম হয় আমেরিকার এক গরীব পরিবারে। আমেরিকার ষোলোতম রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন ১ জানুয়ারী, ১৮৬৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু করে। এই দিন আব্রাহাম লিংকন দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকাতে চলে আসা দাসত্ব প্রথা অবৈধ বলে ঘোষনা করেন। যার কারনে দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকাতে দাসত্বের কাজ করা আফ্রিকান আমেরিকানরা মুক্তি পায়। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা ঘটে যেখানে দেশটির রাষ্ট্রপতি স্বয়ং দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহন করে। তবে সেসময় লিংকনের এই পদক্ষেপ নেওয়া যথেষ্ট সমস্যার ছিল কারন উনিশ শতকে আমেরিকার একটি বড় রাজনৈতিক সমস্যা ছিল দাসত্ব প্রথা। দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকাতে এই বিষয়ে বিতর্ক চলছিলো। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দাসত্ব প্রথা বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে।
আমেরিকার বেশ কয়েকটি প্রদেশ আব্রাহাম লিংকনের সমালোচনাও করে কারন এসব প্রদেশ দাসত্ব প্রথা মেনে চলতো। আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তবে লিংকন অত্যন্ত দক্ষতায় ১৮৬৫ সালে এই গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রন করে। আব্রাহাম লিংকন শুধু দাসত্ব প্রথা বন্ধ করে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ নিয়ন্ত্রন করেনি বরং আমেরিকার প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেছিলেন যার কারনে আব্রাহাম লিংকনকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের একজন বলা হয়। এখনও পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি বলা হয় আব্রাহাম লিংকনকে।
১২ ফেব্রুয়ারী, ১৮০৯ সালে আমেরিকার কেনটাকি শহরে এক গরীব কৃষক পরিবারে জন্ম হয় আব্রাহাম লিংকনের। তার বাবা থমাস লিংকন একজন কৃষক ছিলেন। ১৮১৬ সালেই তাঁর পরিবার কেনটাকি থেকে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা প্রদেশে চলে আসে। ১৮১৮ সালের ৫ অক্টোবর আব্রাহাম লিংকনের মা ন্যান্সি লিংকনের মৃত্যু হয়। ১৮২৮ সালে তার দিদি সারারও মৃত্যু হয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি বাবার সাথে খামারে কাজ করতেন যার কারনে স্কুল যাবার সুযোগ খুব ছিল তার কাছে। ১৫ বছর বয়স অবধি তিনি মাত্র বারো মাস স্কুলে যেতে পেরেছিলেন। তবে পরবর্তী জীবনে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। ১৮৬১ সালের জুন মাসে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন তিনি। তরুন বয়স থেকেই কুস্তি শিখতেন আব্রাহাম লিংকন। ২১ বছর বয়সেই তিনি আমেরিকার কুস্তি বিজেতা ছিলেন। ১৮৩০ সালে তার পরিবার ইলিনয়েস শহরে চলে যায় এবং ম্যাকন কাউন্টি নামক জায়গায় বসবাস শুরু করে।
১৮৩১ সালে তার পরিবার কোলেস কাউন্টি নামক জায়গায় নতুন বাড়িতে চলে যায় কিন্তু আব্রাহাম লিংকন ইলিনয়েসের নিউ সালেমে পরবর্তী ছয় বছরের জন্য ছিলেন। ১৮৩২ সালে প্রথম বারের মতো রাজনীতিতে পা রাখে আব্রাহাম লিংকন। তিনি ইলিনয়েস শহরের সাধারন সভার জন্য নির্বাচনে দাঁড়ান। কিন্তু রাজনৈতিক সেক্টরে তেমন কোনও বন্ধু ও অর্থ না থাকায় তিনি নির্বাচনে হেরে যান। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি, ১৮৩৪ সালে উইগ দলে যোগদান করেন এবং এবার নির্বাচনে জিতে যান তিনি। ইলিনয়েসের হাউস অফ রিপ্রেজেন্টিভে চার বছরের জন্য সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সদস্য নির্বাচিত হয়েই তিনি তার কাজ শুরু করেন। সেসময় আমেরিকাতে ভূমির মালিকদেরই ভোট দানের অধিকার ছিল, আব্রাহাম লিংকন এই নিয়মের পরিবর্তন করে প্রত্যেক আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেওয়ার নিয়ম শুরু করেন। সেসময় থেকেই লিংকন দাসত্ব প্রথার বিরোধীতা শুরু করেছিল। তবে এইসময়েই আব্রাহাম লিংকনের ব্যক্তিগত জীবনে এক বিশাল দুর্ঘটনা ঘটে।
১৮৩৫ সালের ২৫ আগস্ট তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা অ্যান রুটলেজ টাইফয়েড জ্বরে মারা যায়। এরকারনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ১৮৪২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি ম্যারি টডকে বিবাহ করেন। এরপর তিনি আমেরিকার রাজনীতিতে আরও বেশী যুক্ত হয়ে পড়েন। আমেরিকাতে দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে প্রকৃত আওয়াজ উঠতে শুরু করে ১৮৫৪ সাল থেকে। ১৮৫৪ সালে আমেরিকার ক্যানসাস ও নেব্রেস্কা শহর দুটি দাসত্ব প্রথার প্রসারন নিয়ে ক্যানসাস- নেব্রাস্কা আইন তৈরি করেছিল কিন্তু এই আইন প্রয়োগের সরাসরি বিরোধীতা করে আব্রাহাম লিংকন।
১৮৫৮ সালে আমেরিকাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্ততিতেও আব্রাহাম লিংকন দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠায় যা আমেরিকার জাতীয় স্তরে তাকে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তুলে ধরে। এরপরই আমেরিকার রিপাবলিক দল আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আব্রাহাম লিংকনকে তাদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে আমন্ত্রন জানায় এবং ১৮৬০ সালে আমেরিকার সাধারন নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই আমেরিকার কিছু প্রদেশ যারা দাসত্ব প্রথাকে মান্যতা দিত তারা ইউনাইটেড স্টেটস থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং ১৮৬১ সাল থেকে আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
আব্রাহাম লিংকনের রাষ্ট্রপতি হিসাবে কাজ শুরু করবার আগেই দক্ষিন আমেরিকার সাতটি প্রদেশ সাউথ ক্যারোলাইনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, অ্যালবামা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা এবং টেক্সাস ইউনাইটেড স্টেটস থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের স্বাধীন ঘোষনা করে। আমেরিকার সরকার এই সব প্রদেশকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে আমেরিকা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে ছিল উত্তর আমেরিকান প্রদেশ যারা দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে ছিল এবং অন্যদিকে ছিল দক্ষিন আমেরিকান প্রদেশ যারা দাসত্ব প্রথার পক্ষে ছিল। দক্ষিন আমেরিকার এসব বিদ্রোহী প্রদেশকে কনফেডারেট স্টেটস বলা হয়। ১৮৬১ সালের ১ জানুয়ারী আব্রাহাম লিংকন আমেরিকায় দাসত্ব প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। কিন্তু দক্ষিন আমেরিকার প্রদেশগুলো তখনও এই আইন মানেনি। দক্ষিন আমেরিকা থেকে বহু মানুষ উত্তর আমেরিকাতে পালিয়ে আসে নিজেদের দাসত্ব জীবন থেকে মুক্তি দিতে।
১৮৬৫ সালে কনফেডারেট স্টেটসের জেনারেলরা একে একে আত্মসমর্পন করে এবং আমেরিকাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ শেষ হয়। ১৮৬৫ সালেই আমেরিকার কংগ্রেস তেরোতম সংশোধনের মাধ্যমে আমেরিকাতে দাসত্ব প্রথাকে চিরকালের মতো বন্ধ করে দেয়। আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার প্রশাসনিক গঠন কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন করেন। আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির পদকে কোর্ট ও আমেরিকার কংগ্রেসের থেকেও শক্তিশালী করেন, তিনি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন, সামরিক বাহিনীতে বাজেট বাড়ান। কোর্ট ও ইউএস কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই আমেরিকার উন্নতির জন্য তিনি এমন সব পদক্ষেপ নেন যা আজ পর্যন্ত আমেরিকার ইতিহাসে কোনও রাষ্ট্রপতি করতে পারেনি যার কারনে আব্রাহাম লিংকনকে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি বলা হয়। তবে এত দৃষ্টান্তমূলক কাজ করার পরেও দাসত্ব প্রথাকে সমর্থন করা লোকেদের হাতে ১৮৬৫ সালেই মৃত্যু হয় মহান আব্রাহাম লিংকনের। আব্রাহাম লিংকনই আমেরিকার প্রথম কোনও রাষ্ট্রপতি যাকে হত্যা করা হয়। তিনি মারা যান কিন্তু তার নেওয়া প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ইতিহাসে অমর করে দেয় তাকে। আব্রাহাম লিংকনের দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রশাসনিক সংস্কার বিশ্বের বহু দেশের মানুষের জন্য অনুপ্রেরনা ছিল। যেমন ভারতের বিখ্যাত সামাজিক কর্মী জ্যোতিরাও ফুলে আব্রাহাম লিংকনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি আমেরিকার দাসত্ব প্রথাকে ভারতের বর্নপ্রথার সাথে তুলনা করে ভারতে জাতিভেদ বা বর্নপ্রথা অবসানের জন্য চেষ্টা করেন।
আমেরিকান কংগ্রেস ১৩ তম সংশোধনের মাধ্যমে দাসত্ব প্রথা নিষিদ্ধ করায় আমেরিকায় থাকা আফ্রিকানদের জীবন বদলে যায়। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৭ এর মধ্যে আমেরিকান কংগ্রেস একাধিক আইন তৈরি করে যেমন নাগরিকত্ব, সমান অধিকার এবং প্রত্যেক নাগরিকের ভোটদানের অধিকার। যার ফলে দীর্ঘদিন দাসত্বের শিকলে বন্দী থাকা আফ্রিকানরা আমেরিকাতে একজন সাধারন আমেরিকান নাগরিকের মতোই সমান অধিকার পায়, তারা সরকারি কাজে, শিক্ষাব্যবস্থা সবেতেই যুক্ত হয়। আব্রাহাম লিংকনের কারনে বিশ্বের বহু দেশেই দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। তবে আব্রাহাম লিংকনের কারনে দাসত্ব প্রথার অবসান ঘটলেও আমেরিকাতে বর্নবাদ তখনও ছিল যার কারনে ১৯৬০ সালে আমেরিকাতে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে সর্বসাধারনের অধিকার আন্দোলন শুরু হয়। আজও আমেরিকা সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে কিছুটা হলেও বর্নবাদ রয়ে গেছে। যার কারনে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন দেশে বর্নবাদ বিরোধী প্রতিবাদ হয়। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নিজেও আব্রাহাম লিংকনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
আব্রাহাম লিংকন দক্ষিন আমেরিকার বিরোধী প্রদেশগুলোকে পুনরায় ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকাতে যুক্ত করে যাতে আমেরিকা দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিংকন গ্যাটিসবার্গ এড্রেস নামক বক্তৃতা দিয়েছিল যাকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ছোট বক্তৃতা বলা হয়। এই বক্তৃতাতে তিনি একটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে গেলে কি দরকার সেটা বলেন। তিনি বক্তৃতায় বলেন সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তৃতা হল সরকার জনগনের, জনগনের দ্বারা তৈরি এবং জনগনের জন্য। আব্রাহাম লিংকনের এই গ্যাটিসবার্গ এড্রেস বিশ্বের সমস্ত গনতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য একটা অসাধারন অনুপ্রেরনা। এই গ্যাটিসবার্গ এড্রেস বক্তৃতা আব্রাহাম লিংকনকে আমেরিকার জনগনের কাছে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। আব্রাহাম লিংকনের রাজনৈতিক জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল গনতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং সমান অধিকারকে মান্যতা দেওয়া। আব্রাহাম লিংকন যদি আরও কিছু বছর বেঁচে থাকতো নিঃসন্দেহে তিনি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ করে যেতেন আমেরিকাতে সহ পুরো বিশ্বের জন্য।