চরম দারিদ্র্যতা এবং স্বৈরাতন্ত্র থাকলেও উত্তর কোরিয়া থেকে কেন পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে?
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বে এমন একটি দেশ আছে যারা পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। দ্রুত গতির ইন্টারনেটের দৌলতে যখন প্রত্যেক দেশের মানুষ ঘরে বসেই গোটা দুনিয়ার খবর জানতে পারছে কিন্তু তখনও এই বিশ্বে এমন একটি দেশ রয়েছে যেখানকার মানুষ ইন্টারনেটই ব্যবহার করতে পারেনা! অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি যে পূর্ব এশিয়ার উত্তর কোরিয়া নামক দেশটি পুরো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এমন একটি দেশ যেখানকার মানুষ আজও আধুনিক সভ্য জগৎ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
২০০৯ সালে উত্তর কোরিয়া দেশটিতে এক বাচ্চাকে আজীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় কারন বাচ্চাটির বাবা মায়ের কাছে পবিত্র বাইবেল পাওয়া গেছিল! উত্তর কোরিয়ার সরকার মনে করে এই বাচ্চাটি ও তার বাবা মায়ের কারনে দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিপদে ছিল। এমনই এক দেশ উত্তর কোরিয়া যেখানে দুই বছরের বাচ্চাও শাসকের কোপ থেকে রেহাই পায়না। উত্তর কোরিয়া দেশটির সংবিধান অনুযায়ী দেশটির নাম ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে। কিন্ত বাস্তবে এই দেশটি পৃথিবীতে থাকা সবচেয়ে বড় জেলখানা। উত্তর কোরিয়া এমন একটি দেশ যেখানে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতেও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়, এমনকী গ্রাম থেকে শহরে আসতেও অনুমতি নিতে হয়। এখানের মানুষ টিভিতেও সরকার নির্দিষ্ট চ্যানেলই দেখতে পারে। উত্তর কোরিয়া দেশটির ঠিক পাশেই রয়েছে চীনের মতোন শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। কিন্ত অদ্ভুত ব্যপার হলেও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা উত্তর কোরিয়া দেশটি থেকে চীন বা অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। একটা সময় মানুষ সীমান্ত দিয়ে চীন বা অন্য দেশে পালিয়ে যেত কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা অনেকটাই কমে আসছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল উত্তর কোরিয়ার আইন প্রচন্ড শক্ত হওয়া সত্বেও, অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকা সত্বেও দেশটির মানুষ উত্তর কোরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইছেনা! বিশ্বজুড়ে তথ্য সংগ্রহ সংস্থা স্ট্যাটিস্টার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের পর থেকে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পন করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এরপর কোরিয়া দ্বীপ নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া কোরিয়ান যুদ্ধে কোরিয়া দ্বীপ দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিন কোরিয়া। উত্তর কোরিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দক্ষিন কোরিয়াকে আমেরিকা সহায়তা করতে থাকে। কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একপক্ষে থাকলেও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দুই দেশ একে অপরকে টেক্কা দেবার প্রতিযোগিতা শুরু করে যাতে গোটা বিশ্ব দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়, ইতিহাসে এই ঘটনা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর শীতল যুদ্ধও সমাপ্ত হয়। কোরিয়া যখন দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তখন উত্তর কোরিয়ার কাছে দক্ষিন কোরিয়ার থেকে বেশী সম্পদ ছিল। এরপর যে ঘটনা ঘটে তা প্রমান করে কোনও দেশের কাছে কম পরিমান সম্পদ থাকলেও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেই দেশটির মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে পারে। উত্তর কোরিয়ার কাছে কয়লা, সোনা ও ইউরেনিয়াম প্রচুর পরিমান আছে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়ার দায়িত্ব নেয় কিম সুং দ্বিতীয়। যেসব ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল তাদের হয় গ্রেফতার করা হয় অথবা হত্যা করা হয়। কিম সুং দ্বিতীয় উত্তর কোরিয়াতে নিজেকে সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পুরো দেশে নিজের প্রচুর মূর্তি তৈরি করে। উত্তর কোরিয়ার পাঠ্য পুস্তকে নিজের বীরত্বের মিথ্যা খবর ছাপায় কিম সং দ্বিতীয়। যেমন উত্তর কোরিয়াতে এটা পড়ানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে খুব সহজেই কিম সং দ্বিতীয় একা পরাস্ত করেছিল। উত্তর কোরিয়ার সরকার দেশটির খনিজ সম্পদ ও ব্যবসা সম্পূর্ন নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত দক্ষিন কোরিয়ার অবস্থাও খারাপ ছিল কিন্তু ১৯৬০ সালের পর দুই কোরিয়ার ভাগ্য বদলায়।
১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের সাথে সম্পর্ক খানিকটা খারাপ হবার পর উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার জন্য জুচে নীতি গ্রহন করে। এই নীতি অনুযায়ী ১৯৬২ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া তার সরকারি বিনিয়োগের চারভাগের তিনভাগই সামরিক খাতে, অস্ত্র তৈরিতে, সেনাবাহিনী গঠনে ব্যায় করা শুরু করে কিন্ত দেশের শিল্পোন্নয়ন ও অর্থনীতিকে ততটা জোর দেওয়া হয়নি। দক্ষিন কোরিয়াতে ঠিক এর বিপরীত ঘটনা ঘটে। জেনারেল পার্ক চুং হি বিদ্রোহ করে দক্ষিন কোরিয়ার ক্ষমতা দখল করে জাপানের মতোন রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি গঠন করা শুরু করে দেশের। একদিকে যখন উত্তর কোরিয়ার সামরিক ক্ষমতা বাড়ছিলো অন্যদিকে তখন দক্ষিন কোরিয়ার অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছিল, দক্ষিন কোরিয়াতে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ আসে, বৈদেশিক সঞ্চয় বৃদ্ধি পায় এবং স্যামসাং এর মতোন সংস্থা তৈরি হয়। যার ফলস্বরূপ বর্তমানে উত্তর কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর মধ্যে একটি কিন্তু দক্ষিন কোরিয়া বিশ্বের বারোতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ।
বর্তমানে উত্তর কোরিয়াতে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারনে বাইরে থেকে কোনও কিছু আসেনা। এখানে ইন্টারনেট নিষিদ্ধ তার বদলে দেশের মানুষকে কোয়াংমিয়ং ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। কোয়াংমিয়ং এমন এক সিস্টেম যা পুরোপুরি উত্তর কোরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রন করে এবং এটি শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়াতেই চলে। এখানে বিদেশী সিনেমা, গান, বই নিষিদ্ধ যদি কেউ অবৈধ ভাবে এসব জিনিস ব্যবহার করে তাহলে তার গোটা পরিবারকে সাজা দেওয়া হয়। উত্তর কোরিয়ার মানুষকে সরকার অন্য কোনও দেশে যাওয়াও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এরকম অবস্থায় শুধুমাত্র অবৈধ ভাবেই একমাত্র অন্য দেশে যাওয়া সম্ভব। উত্তর কোরিয়ার সাথে তিনটি দেশের সীমানা রয়েছে চীন, দক্ষিন কোরিয়া ও রাশিয়া। উত্তর কোরিয়া থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোনওরকমে পালিয়ে দক্ষিন কোরিয়া চলে আসতে পারে তাহলে কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার পর দক্ষিন কোরিয়ান সরকার সেই ব্যক্তিকে দক্ষিন কোরিয়ার নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়। কিম জি ইয়ং নামে এক ব্যক্তি ৩১ বছর বয়সে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিন কোরিয়া চলে আসে, সে সাক্ষাৎকারে জানায় এটা ছিল একটি স্বপ্নের মতোন। দক্ষিন কোরিয়ার ইনটেলিজেন্স বিভাগ প্রথমে তাকে পরীক্ষা করে সে উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচর কীনা, এরপর তাকে হানাওন নামে একটি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দক্ষিন কোরিয়ার নিয়ম শেখানোর জন্য। দক্ষিন কোরিয়ার সরকার উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের রীতিমতো সহায়তা করে ঘর, খাদ্য ও অর্থ দিয়ে এবং পরে তাদের দক্ষিন কোরিয়ার নাগরিকত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু চীন ও রাশিয়াতে যদি উত্তর কোরিয়া থেকে কোনও ব্যক্তি পালিয়ে আসে তাহলে ধরা পড়ার পর তাদের আবার উত্তর কোরিয়াতেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাশিয়া এরকম কয়েকশো পালিয়ে আসা লোককে উত্তর কোরিয়াতে ফেরত পাঠিয়েছে। উত্তর কোরিয়াতে ফিরে যাওয়ার পর ওইসব ব্যক্তিদের যা অবস্থা হয় তার থেকে মৃত্যুও ভালো। উত্তর কোরিয়াতে ওইসব ব্যক্তিদের বিশেষ ক্যাম্পে আটকে রেখে নিষ্ঠুর ভাবে নির্যাতন করা হয়। অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার মানুষদের কাছে পালিয়ে যাওয়ার একটাই জায়গা আছে তা হল দক্ষিন কোরিয়া।
স্ট্যাটিস্টারের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিন কোরিয়াতে ১,৪১৮ জন, ২০১৭ সালে ১,১২৭ জন, ২০১৮ সালে ১,১৩৭ এবং ২০১৯ সালে ১,০৪৭ জন পালিয়ে এসেছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারী শুরু হওয়ায় সব দেশ তার সীমানা বন্ধ করে দেয়, ২০২০ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে মাত্র ২২৯ জন, ২০২১ সালে ৬৩ জন এবং ২০২২ সালেও একশো জনের কম লোক দক্ষিন কোরিয়াতে এসেছে। ২০২৩ সালে এখনও অবধি মাত্র ৩৭ জন লোক দক্ষিন কোরিয়াতে এসেছে উত্তর কোরিয়া থেকে।
উত্তর কোরিয়া থেকে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে তার সবচেয়ে বড় কারন দেশটির আইন। উত্তর কোরিয়াতে আইন তৈরি হয়েছে যদি কোনও ব্যক্তি দেশ থেকে পালিয়ে যায় তাহলে সেই ব্যক্তির পুরো পরিবারকে শাস্তি পেতে হবে, ওই ব্যক্তির পরিবারকে আটক করা হবে যার কারনে অনেকে পালাতে চাইছেনা পরিবারের কথা চিন্তা করে। এছাড়া চীন ও রাশিয়াতে পালানো একপ্রকার অর্থহীন কারন তারা ফেরত পাঠিয়ে দেয় এবং তার পরে সেই ব্যক্তির জীবন মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রনাদায়ক হয়ে যায়। দক্ষিন কোরিয়ার সাথে সীমান্তে উত্তর কোরিয়া তার নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সেনাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে যদি কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে সাথে সাথে গুলি করার। সুতরাং বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের কাছে পালিয়ে যাবার সুযোগ খুবই কম।