অফবিট

বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তৈমুর লং এর মতো শাসক দ্বিতীয় কেউ আসেনি

বিশ্বে এমন অনেক শাসক এসেছে যারা ভারতে শুধু আক্রমনই করেনি বরং ভারতের ঐশ্বর্য লুঠ করে বহু বছর ভারতে শাসন করেছে। এদের মধ্যে কয়েকজন শাসক সত্যিই সুশাসক ছিল কিন্ত কিছু এমন শাসকও ছিল যারা নিষ্ঠুরতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিল। এরকমই একজন শাসক তৈমুর লং। চোদ্দ শতকে ভারতে আক্রমনকারী তৈমুর লংকে মানবতা ও শান্তির শত্রু বলা হয়। ভারতের ইতিহাসে চেঙ্গিস খানের পর সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসক বলা হয় তৈমুর লংকে। দিল্লিতে যে নিষ্ঠুর গনহত্যা চালিয়েছিল তৈমুর লং তা পরবর্তী একশো বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষের মানুষ ভুলতে পারেনি। 

চোদ্দ শতকে তৈমুর লং পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। ১৩৩৬ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানে জন্ম হয়েছিল তৈমুর লং এর। তুর্কী ভাষায় তৈমুর শব্দের অর্থ লোহা। তবে তার নাম তৈমুর লং হয় কারন ছোটবেলায় দুর্ঘটনাবশত তার একটি পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল প্রায়। পার্সী ভাষায় লং শব্দের অর্থ খোঁড়া।

তার বাবা বারলাস উপজাতির নেতা ছিল। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পূর্বপুরুষ এই তৈমুর লং। এক পা খোঁড়া হলেও তৈমুর লং মঙ্গোল শাসক চেঙ্গিস খানের মতোন বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতো এবং আলেকজান্ডার দি গ্রেটের মতেন বিশ্ব বিজেতা হতে চাইতো। এই স্বপ্ন সার্থকের জন্য ১৩৬৯ সালে সমরকন্দেরর মোঙ্গল শাসকের মৃত্যুর পর তার জায়গায় নিজেকে নতুন সম্রাট হিসাবে ঘোষনা করে তৈমুর লং। চেঙ্গিস খানের মতোন পুরো সেনাবাহিনী গঠন করে তৈমুর এবং চেঙ্গিস খানের মতোই নিষ্ঠুরভাবে বিভিন্ন দেশ আক্রমন করে। 

১৩৮০-১৩৮৭ সালের মধ্যে সিস্টান, খোরসান, ফারস, আফগানিস্তান, আজারবাইজান, কুর্দিস্তানের মতোন অঞ্চল দখল করে নেয় তৈমুর। ১৩৯৩ সালের মধ্যে বাগদাদ থেকে শুরু করে মেসোপটোমিয়া পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে তৈমুর। সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ বিপুল ঐশ্বর্যে পরিপূর্ন ছিল। ভারতবর্ষের সুখ্যাতি ছিল জগৎ বিখ্যাত। ভারতকে সোনার পাখিও বলা হত। স্বাভাবিকভাবেই তৈমুর লং ও ভারতবর্ষের ব্যাপারে জানতো। সেজন্য ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য লুঠের জন্য তৈমুর ভারতবর্ষ আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করে। ভারতবর্ষে আক্রমনের জন্য সমরকন্দে ৯০,০০০ সেনা যুক্ত বিশাল সামরিক বাহিনী গঠন করে তৈমুর। কিন্তু ভারতবর্ষে আক্রমন এতটা সহজ ছিলনা। সমরকন্দ থেকে দিল্লির দূরত্ব ১০০০ মাইল কিন্তু এই সম্পূর্ন পথ বিশ্বের অন্যতম কঠিন পথ। হিন্দুকুশ পর্বতমালার সংকীর্ন পথ হয়ে, অসংখ্য নদী, মরুভূমি প্রায় অঞ্চল, বিপদজনক গিরিপথ হয়ে তবে ভারত পৌঁছাতে হত। উপরন্তু হিন্দুকুশ পর্বতমালায় যেসব উপজাতিরা থাকতো তাদের স্বয়ং আলেকজান্ডার দি গ্রেট পর্যন্ত পরাজিত করতে পারেনি। এতসব বাধা অতিক্রম করে দিল্লি পৌঁছে গেলেও দিল্লির শাসকদের বিশাল যুদ্ধ হাতির বহরের সামনে পড়তে হত যাদের কখনও চোখেই দেখেনি তৈমুর ও তার সেনা। কিন্তু শত বাধা সত্বেও ভারতবর্ষে আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল তৈমুর লং এবং ১৩৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তৈমুরের সেনা সমরকন্দ হয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর তৈমুরের সেনা সিন্ধ, ঝিলাম ও রাভি নদীকে অতিক্রম করে। ১৩ অক্টোবর মুলতান থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে তুলুম্বা নগর পৌঁছায় তৈমুরের সেনা। এখানে ব্যাপক গনহত্যা চালিয়ে ঐশ্বর্য লুঠ করে তার সেনা। এরপর ভাটনের পৌঁছায় তার সেনা এখানে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার সেনাবাহিনী। এরপর তৈমুর ও তার সেনাবাহিনী দিল্লির দিকে রওনা হয় এবং তাদের পথে আসা বহু জনপদে নারকীয় অত্যাচার চালায় তারা। এভাবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লির কাছে এসে পৌঁছায় তৈমুরের সেনা, এখানে এক লাখ হিন্দুদের হত্যা করে তৈমুর লং। ১৭ ডিসেম্বর, ১৩৯৮ এ পানিপথের কাছে তুঘলক সুলতান মেহমুদের ৫০,০০০ সেনা সদস্য বিশিষ্ট সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয় তৈমুর লং এর। এই যুদ্ধে তৈমুর লং বিজয়ী হয়। এই যুদ্ধে সুলতান মেহমুদ ১২০টি হাতির বহর নিয়ে এসেছিল যুদ্ধে কিন্ত তাও জিততে পারেনি। পরাজিত হওয়ার পর গুজরাটে পালিয়ে যায় সুলতান মেহমুদ। তৈমুরের সেনাবাহিনী দিল্লিতে পাঁচদিন ধরে গনহত্যা ও লুঠপাত চালায়। দিল্লির বহু বাসিন্দা প্রান বাঁচাতে পুরোনো দিল্লিতে একটি মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু তৈমুরের পাঁচশো জন সেনা মসজিদে আশ্রয় নেওয়া মানুষদেরও হত্যা করে। চেঙ্গিস খান যেমন গনহত্যা করে নরমুণ্ডর পিরমিড তৈরি করেছিল ঠিক তেমনি তৈমুরের সেনাবাহিনীও দিল্লিতে নরমুণ্ডর টাওয়ার তৈরি করে ফেলেছিল এবং বাকী দেহাবশেষগুলি কাক ও ঈগলের খাওয়ার জন্য ফেলে দিয়েছিল। গিয়াথ আল দিন আলি তার বই ডায়েরি অফ তৈমুর ক্যাম্পেন ইন ইন্ডিয়া নামক বইয়ে তৈমুর লং এর নারকীয় অত্যাচারের কথা বর্ননা করে লিখেছেন তৈমুরের সেনাবাহিনী ক্ষুদার্থ নেকড়ের মতোন দিল্লিবাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পনেরো দিন দিল্লিতে থাকার পর তৈমুর লং দিল্লির বেশীর ভাগ ঐশ্বর্য লুঠ করে সমরকন্দ নিয়ে গিয়েছিল। দিল্লি থেকে অসংখ্য মহিলা ও শিল্পীদের সাথে করে সমরকন্দ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে সমরকন্দে জোর করে একাধিক স্থাপত্য নির্মান করানো হয় যার মধ্যে জামা মসজিদ অন্যতম। সমরকন্দ ফিরে যাবার আগে খিজির খানকে পাঞ্জাব ও সিন্ধের গভর্নর নিযুক্ত করে তৈমুর লং। 

তৈমুর লং এর দিল্লি আক্রমনের সময় দিল্লির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিলনা। ১৩৩৮ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর পুরো ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। বাংলা ও দক্ষিন ভারতের অঞ্চলগুলো নিজেদের স্বাধীন ঘোষনা করে সেসময়। ১৩৮৮-৯৪ পর্যন্ত দিল্লির সিংহাসনে তিনজন সুলতান আসে, সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে এই লড়াই রাজনৈতিক অরাজকতা তৈরি করে। এমনকী সুলতানের বিশিষ্ট লোকেরা পর্যন্ত সুলতানের অবহেলা শুরু করে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার জর্জ ডানবার তার বই দি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া বইয়ে লিখেছেন ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে দশ বছরে পাঁচজন সুলতান আসে। দিল্লির রাজনৈতিক অস্থিরতাই ক্রমশ বাইরের আক্রমনের কারন হয়ে দাঁড়ায়। এরই সুযোগে তৈমুর লং এত সহজে দিল্লি আক্রমন করে। তৈমুর লং এর ভারত আক্রমনের প্রধান দুটি কারন ছিল প্রথমত মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের কারনে তৈমুরের রাজকোষ ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল সেজন্য ভারতবর্ষ আক্রমন করে প্রচুর ধনসম্পত্তি লুঠন করাই উদ্দেশ্য ছিল তৈমুরের। দ্বিতীয়ত ভারতে ইসলামের প্রসারের জন্য কাফের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ করতে ভারতবর্ষ আক্রমন করেছিল তৈমুর যাতে ইসলামি সেনা হিন্দুদের অর্থসম্পত্তি ও মূল্যবান বস্ত পেয়ে যায়। তৈমুরের আক্রমনের ফলে দিল্লিতে তুঘলক বংশের শাসনের অবসান হয় এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক স্বাধীন রাজ্য তৈরি হয়। তৈমুর লং এর আক্রমনে দীর্ঘদিনের উন্নত দিল্লি শহর প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছিল, চারিদিকে শুধু মৃতদেহের স্তূপ ও ধ্বংসাবশেষ ছিল। ভারতীয় রাজা, সুলতানদের দ্বারা জমাকৃত মহামূল্যবান ঐশ্বর্য কয়েকদিনে লুঠে নেয় তৈমুর লং। এরপর পুরোদেশ জুড়ে এতটাই রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় যে বারবার বিদেশী শক্তিগুলো ভারতবর্ষ আক্রমন করে। তৈমুর লং এর দিল্লি আক্রমনে ভারতের বিশেষ করে দিল্লির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন এতটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যে তা আবারও স্বাভাবিক হতে একশো বছর সময় লেগে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *