৫০ বছর পর্যন্ত গোপন ছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংগঠন মোসাদের কোন অপারেশান?
সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা। বিমানের ভিতর তখন কয়েকজন লোক একটি বাক্সকে ঘিরে চিন্তায় রয়েছে। এই বাক্সকে ঘিরে চিন্তায় ছিল আরও একটি দেশও। কিছুক্ষন পর পাইলট নিশ্চিত করে আশেপাশে কোন বিমান বা জাহাজের উপস্থিতি নেই, তখনই বিমানটির পেছনের কার্গোর দরজা খুলে যায় এবং বাক্সটি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। এই বাক্সে ছিল এমন এক ব্যাক্তির মৃতদেহ যা সেসময় ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠেছিল। এই ব্যাক্তিটির জন্যই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলের মোসাদ তাদের অত্যন্ত গোপন অপারেশন আইভার শুরু করেছিল যা শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ দশক অবধি গোটা বিশ্বের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। পুরো মিশন শেষ হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল যথেষ্ট চিন্তায় ছিল।
১৯৪৯ সালে বুলগেরিয়ার এক ইহুদি পরিবারের তিন ভাই ইসরায়েলের হাইফা শহরে আসে কাজের সন্ধানে। ইসরায়েল সেসময় সদ্য তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত প্রান্ত থেকে ইহুদিরা দলে দলে তাদের নিজেদের দেশ ইসরায়েলে আসতে শুরু করেছিল। এই তিনভাইয়ের বড় ভাই ছিল আলেকজান্ডার ইসরায়েল, আকর্ষিক চেহারা, অসাধারন ব্যাক্তিত্ব এবং ব্যাপক বুদ্ধির জন্য খুব সহজেই সে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে কাজ পায় এবং সেখান থেকে পরে ইসরায়েলের নৌবাহিনীতে অ্যানালিস্টের পদে যোগ দেয়। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরিতে সে সিদ্ধহস্ত ছিল। তার দক্ষতার কারনে অল্প সময়ের মধ্যেই সে তার উদ্বর্তনদের সুনজরে পড়ে যায়। যার কারনে খুব তাড়াতাড়িই আলেকজান্ডার ইসরায়েলি নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদ পায় এবং প্রতিরক্ষা সেক্টরের অনেক গোপন বিষয়েও তাকে যুক্ত করা হয়। ১৯৫৩ সালে আলেকজান্ডার তার নাম পরিবর্তন করে আভনির রাখে এবং তুরস্কের বংশদ্ভূত মার্টিলদা আর্টিরি নামে এক সুন্দরী মহিলাকে বিবাহ করে। দুজনে হাইফাতে বসবাস শুরু করে কারন এখানেই ইসরায়েল নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। আর পাঁচজন সদ্য বিবাহিত দম্পতির মতো তারাও যথেষ্ট সুখে জীবন কাটাতে থাকে। কিন্তু মার্টিলদা জানতনা যে আভনিরকে সে বিয়ে করেছে সে আদতে একজন অত্যন্ত খারাপ ব্যাক্তিত্বের মানুষ। আকর্ষক চেহারা ও ব্যাক্তিত্বের জন্য সুপরিচিত আলেকজান্ডার ওরফে আভনিরের ভিতরের রূপ সম্পর্কে কেউই জানত। মুখোশের আড়ালে আলেকজান্ডার ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক ব্যাক্তি এবং তার অতীত ছিল অপরাধে পরিপূর্ণ। আলেকজান্ডার রিয়েল এস্টেট সংস্থার নামে অনেক দূর্নীতি করেছিল, একটি নামি ফ্রিজ সংস্থার নকল বিক্রেতা হিসাবে মানুষদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এরকম অনেক কাজে সে যুক্ত ছিল।
১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর এরকমই একটি মামলায় তাকে আদালতে হাজিরা দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে আলেকজান্ডার হাইফাতে ইটালিয়ান দূতাবাসের এক মহিলা কর্মীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে যার ব্যাপারে তার স্ত্রী মার্টিলদা কিছুই জানতনা। ইটালিয়ান মহিলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসে, এসব ঘটে যেসময় সেসময় মার্টিলদা প্রেগন্যান্ট ছিল। সেই ইটালিয়ান মহিলা বিবাহের জন্য আলেকজান্ডারকে ইহুদি ধর্ম পরিবর্তন করে ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহনের শর্ত দেয় যাতে আলেকজান্ডার রাজি হয়ে যায় কারন এটা তার কাছে নতুন কিছু ছিলনা৷ এর আগে বুলগেরিয়াতে থাকার সময়ে তার সাথে একটি খ্রীষ্টান মেয়ের প্রনয়ের সম্পর্ক ছিল যা মেয়েটির বাড়ির লোক জানতে পেরে বন্দুকের ডগে জোর করে আলেকজান্ডারের ধর্ম পরিবর্তন করে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে দেয়৷ এর কিছুদিন পরেই আলেকজান্ডার বুলগেরিয়া থেকে ইসরায়েল পালিয়ে আসে, সেই মেয়েটি তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
ইটালিয়ান মহিলাটিকে বিবাহ করার জন্য আলেকজান্ডার তার নাম আভনির থেকে পরিবর্তন করে আইভার রাখে। সবকিছু ঠিক চলছিল ১৯৫৪ সালের ৭ নভেম্বর ইটালিয়ান প্রেমিকার সাথে তার বিবাহের দিন নিশ্চিত হয় অর্থাৎ ৮ নভেম্বর আলেকজান্ডারের আদালতে উপস্থিত হবার একদিন আগে। কিন্তু এরই মধ্যে আলেকজান্ডারের মন ইটালিয়ান প্রেমিকার থেকে উঠে যায় এবং সে বিবাহ ও আদালত থেকে বাঁচতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে সে ইসরায়েলের সাথেই বেইমানি করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার ইসরায়েল থেকে পালিয়ে যায়। তার এই পালিয়ে যাওয়ায় তার স্ত্রী মার্টিলদা, প্রেমিকার থেকেও মোসাদ চিন্তায় পড়ে যায়। কারন আলেকজান্ডার ছিল ইসরায়েল নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অফিসার এবং অনেক গোপন তথ্য তার কাছে ছিল। এরই মধ্যে ইটালিতে থাকা আরব দূতাবাসের কর্মীদের থেকে মোসাদের কাছে খবর আসে আলেকজান্ডার ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিশরকে বিক্রি করেছে। সেসময় মিশরের নেতৃত্বে আরব দেশগুলো ছিল ইসরায়েলের শত্রু, স্বভাবতই মোসাদ চিন্তায় পড়ে এবং মোসাদ তার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেন্টদের আলেকজান্ডারকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেয়। মোসাদ আরও জানতে পারে আলেকজান্ডার পনেরো হাজার আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর বেসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিশরকে দিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবার জন্য মিশর তাকে কায়রো ডেকেছে এবং বিনিময়ে আরও অত্যাধিক মূল্য দেওয়া হবে। মোসাদ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল আলেকজান্ডার কায়রো পৌঁছালে ইসরায়েলের সমস্ত গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সেইসময়ের মোসাদ প্রধান আইজার হ্যারেল একটি বিশেষ দল তৈরি করে যার লক্ষ্য ছিল অপারেশন আইভার যাতে আলেকজান্ডারকে কায়রো পৌঁছাতে না দিয়ে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা। এই দলের নেতৃত্বে ছিল মোসাদের সেসময়কার সবচেয়ে সেরা এজেন্ট রাফি এইথেন।
মোসাদের দল এরপর রোম রওনা হয় কারন মোসাদের কাছে খবর ছিল রোম বিমানবন্দর থেকে আলেকজান্ডার কায়রো যাবে। রাফি এইথেনকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া ছিল প্রয়োজনে মেরে ফেলেও আলেকজান্ডারকে কায়রো যাওয়া আটকাতে হবে। তবে একবারে শেষমূহুর্তে আলেকজান্ডার রোম বিমানবন্দর দিয়ে কায়রো যাওয়া বাতিল করে। এরপর সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিলনা। কিন্তু ভাগ্য যেন মোসাদের উপর সুপ্রসন্ন ছিল। একদিন হঠাৎই মোসাদের হেড কোয়ার্টারে ভিয়েনা থেকে ফোন আসে। ফোনে ভিয়েনার এক মোসাদ এজেন্ট আলেকজান্ডারকে অদ্ভুতভাবে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা জানায়। ঘটনাটা এইরকম যে ওই এজেন্টের স্ত্রী সেদিন সকালে এসে তাকে জানায় তার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে যার সাথে কাল দুপুরে খেতে যাবে, বন্ধুর নাম বলে সে আলেকজান্ডার ইসরায়েল! এরপরই ভিয়েনাতে মোসাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক আলেকজান্ডারের উপর নজর রাখতে শুরু করে। আলেকজান্ডার এর কিছুই বুঝতে পারেনা। এর কিছুদিন পর প্যারিস যাবার জন্য ভিয়েনা থেকে বিমানে ওঠে আলেকজান্ডার। তার সিটের পাশেই একজন খুব সুন্দরী মহিলার সিট ছিল। সুন্দরী মহিলাদের প্রতি আকর্ষন প্রথম থেকেই ছিল আলেকজান্ডারের, স্বভাবতই সে ওই মহিলার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে এত ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে প্যারিসে নামার পর ওই মহিলার সাথে তার বাড়িতে যেতে একটি গাড়িতে ওঠে আলেকজান্ডার। গাড়িতে উঠতেই আগে থেকে সেখানে থাকা একজন ব্যাক্তি আলেকজান্ডারের মুখে ঘুষি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দেয়। এই ব্যাক্তিটি ছিল রাফি এইথেন এবং ওই সুন্দরী মহিলাটাও একজন মোসাদ এজেন্ট। প্যারিসে মোসাদের আস্তানায় দীর্ঘক্ষন জিজ্ঞাসাবাদের পর আলেকজান্ডার তার অপরাধ স্বীকার করে এবং মোসাদ নিশ্চিত হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলেকজান্ডার তখনও মিশরকে দিতে পারেনি। এরপর শুরু হয় তাকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম। প্যারিস থেকে সপ্তাহে একদিন করে ইসরায়েল বায়ুসেনার একটি বিমান কার্গো নিয়ে যেত যা মাঝে এথেন্সে জ্বালানির জন্য দাঁড়াত এবং তারপর আবার ইসরায়েল যেত। এতেই আলেকজান্ডারকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। প্যারিসে মোসাদের আস্তানা থেকে বিমানবন্দর অবধি পথে আলেকজান্ডারকে একটি বাক্সে রেখে ড্রাগস দিয়ে অচেতন করে নিয়ে আসা হয় এবং বিমানে ওঠানো হয়। মাঝে মাঝেই ড্রাগস ইনজেক্ট করা হতে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ড্রাগসের কারনে ইসরায়েল পৌঁছাতে পৌঁছাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় আলেকজান্ডার। যার জন্য তার মৃতদেহ লুকিয়ে ভূমধ্যসাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সেসময় আজকের মতন ইসরায়েল এত শক্তিশালী ছিলনা, ফলে এই ঘটনা জানাজানি হলে সদ্য গঠন হওয়া ইসরায়েলের উপর রাজনৈতিক চাপ আসত, যার জন্য প্রায় পঞ্চাশ বছর এই ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিল মোসাদ। বহুদিন পর্যন্ত আলেকজান্ডারের স্ত্রী, ছেলে, ভাই বিশ্বাস করত সে দক্ষিন আমেরিকার কোন দেশে আছে। এভাবেই মোসাদ গোপনে তার শত্রুকে শেষ করে দেয় ইসরায়েলের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে।