অফবিট

ভারতবর্ষের কুখ্যাত ঠগের নাম রয়েছে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। জানুন বিস্তারিত

ভারতে একটা সময় ঠগেদের অত্যাচার এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে সাধারন মানুষ একা কোথাও যেতেও ভয় পেত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঠগেদের শক্ত হাতে দমন করে। এইসব ঠগেদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল বেহেরাম জামেদার। গিনেস বিশ্বরেকর্ডের বইয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকারী হিসাবে এই ব্যক্তির নাম রয়েছে। ঠগ বেহেরাম জামেদার পঞ্চাশ বছর ধরে শুধু একটি রুমালের সাহায্যে ৯৩১ জনকে হত্যা করেছিল। শেষপর্যন্ত লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর জেনারেল হবার পর ঠগ অপারেশন করেন।

১৩৫০ সাল থেকেই ভারতে ঠগেদের উৎপাত শুরু হয়। ১৭৫০ সাল আসতে আসতে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে বহু পরিবারের পেশাই হয়ে দাঁড়ায় ঠগবৃত্তি। ১৭৬৫ সালে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরের একটি গ্রামে জন্ম হয় বেহেরাম জামেদারের। তাঁর পরিবারের প্রধান পেশাই ছিল ঠগবৃত্তি। দশ বছর বয়স থেকেই বেহেরাম ঠগের কাজ শিখতে শুরু করে। ১৭৯০ সালে অর্থাৎ ২৫ বছর বয়সে রীতিমতো দল গঠন করে ঠগের কাজ করত বেহেরাম। দিল্লি থেকে জব্বলপুরের রাস্তা ছিল তাঁদের প্রধান ঘাঁটি। দিল্লি থেকে আগ্রা, বিদিশা হয়ে ভোপাল, গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তারা লুঠপাট করতো। দিল্লি থেকে হরিয়ানা হয়ে রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ তারপর মধ্য প্রদেশ আসে, এই পাঁচটি রাজ্যে তখন তাদের আস্তানা ছিল। সেসময় অনেক মানুষ একসাথে ভ্রমন করতো। এইসব ঠগেরা সেসব মানুষকে লুঠ করত। বেহেরাম এতটা নিষ্ঠুর ছিল যে সে লুঠ করবার পর মানুষকে হত্যা করত। সেসময় ভারতে ব্রিটিশ শাসন ছিল। ব্রিটিশদের কাছে খবর আসত দিল্লি থেকে জব্বলপুর যাওয়ার রাস্তায় প্রায়ই মানুষ উধাও হয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে তারাও চিন্তায় ছিল। 

১৮০০ সাল আসতে আসতে বেহেরামের কাছে ২০০ এর বেশী  সদস্য ছিল এবং সে তাদের নেতা ছিল। এইসব ঠগেদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম সব ধর্মের লোক ছিল। ঠগেদের তিনটি প্রধান নিয়ম ছিল। প্রথমত যখন কাউকে হত্যা করা হবে যেন রক্ত না বেরোয়, দ্বিতীয়ত কোন মহিলা এবং বাচ্চার উপর কোন অত্যাচার করা হবেনা, তৃতীয়ত যতক্ষননা বোঝা যাছে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে ধনসম্পদ রয়েছে ততক্ষন পর্যন্ত তার উপর আক্রমন করা হবেনা। ঠগেরা মানুষকে মারবার পর তার মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলত, যার কারনে ইংরেজরা অনুসন্ধান করেও উধাও হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে পেতনা। ঠগেরা নিজেদের মধ্যে একটি সাংকেতিক ভাষায় কথা বলত যার নাম রামসি। ঠগেরা আক্রমন করারা সময় তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যেত। এছাড়া তিন চারজন লোক আলাদা ভাবে থাকতো যারা তিনটি দলের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখত। ঠগেরা রূপ বদলাতে সিদ্ধহস্ত ছিল। তারা কখনও তীর্থযাত্রী সাজতো কখনও অত্যন্ত জ্ঞানী সাজতো অর্থাৎ তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের বেশ বদল করতো। যদি কোন হিন্দু তীর্থযাত্রীদের দল আসত তারা হিন্দু সেজে নিত, আবার মুসলিম তীর্থযাত্রী হলে মুসলিম সাজতো। সোজা কথায় তারা এমন ভাবে বেশ ধারন করে পথিকদের সাথে মিশে যেত কেউ বুঝতেই পারতোনা তারা ঠগের খপ্পরে পড়েছে। ঠগেদের যে নেতা হত তাকে দেখে মনে হত সে প্রচুর শিক্ষিত। প্রথমে ঠগেরা কাকে আক্রমন করবে তা ঠিক করত। এরপর পুরো দল তিনভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে একদল আগে চলে যেত, একদল পেছনে থাকতো এবং এক দল নির্দিষ্ট পথিকদের সাথে মিশে যেত। আগে থাকা দলের কাজ ছিল সেই পথিকদলে কজন ব্যক্তি আছে তাদের জন্য কবর খোঁড়া। যে তিন চারজন লোক অতিরিক্ত থাকত তারা গিয়ে আগের দলকে খবর দিত কতজন পথিক আছে। ঠগেরা লুঠপাঠের পর পথিকদের মেরে কবর দিয়ে দিত। পেছনে থাকা দলের কাজ ছিল কোন বিপদ আসছে তা লক্ষ্য রাখা। মাঝের দলের সাথে ঠগেদের সর্দারও থাকত। নির্দিষ্ট জায়গায় পথিকরা পৌঁছানোর পর সর্দার ইশারা করতো সাথে সাথে ঠগেরা পথিকদের হাত পা চেপে ধরত। সর্দারের কাছে একটি রুমাল থাকতো সেই রুমালের মাঝে রুপোর একটি মোটা মুদ্রা বাঁধা থাকত তা দিয়ে সর্দার প্রত্যেক পথিককে শাসরুদ্ধ করে হত্যা করতো তারপর মৃতদেহ কবরে ফেলে দিত এবং লুঠের জিনিস ভাগ করে নিত। 

১৮০০ সালের দিকেই বেহেরামের সাথে ডলি নামে এক ইংরেজ মেয়ের পরিচয় হয় যে জঙ্গলে পালিয়ে এসেছিল৷ তারপর ডলিও বেহেরামের সাথে মিশে যায়। এরপর বেহেরাম তার পদ্ধতি বদলে ফেলে। বেহেরামের লোকজন পথিকদের হুক্কা খাইয়ে নেশা করাতো তারপর ডলি তাদের রূপের জ্বালে ফাঁসিয়ে বেহেরামের কাছে নিয়ে যেত এবং বেহেরাম তাদের হত্যা করত। এভাবে ১৮১০ আসতে আসতে বেহেরামের আতঙ্ক এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্দেশ দিয়েছিল কোন ইংরেজ সেনা এই এলাকা দিয়ে যাবার সময় যেন ডাকাতদের থেকে সতর্ক হয়ে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাধ্য হয়ে ১৮২০ সালে ব্রিটেন থেকে উইলিয়াম হেনরি নামে একজন গোয়েন্দাকে আনে মধ্যপ্রদেশে এবং ১৮২২ সালে তাকে নরসিংগড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেই ঠগেদের উৎপাত সবচেয়ে বেশী ছিল। এইসময় ডলি ও বেহেরামের ঝগড়া হয়ে যায় এবং তারা আলাদা হয়ে যায়। তখন বেহেরামের দলে যুক্ত হয় আমের আলি নামে আরও এক কুখ্যাত ঠগ। এই দুজন মিলে অনেক ইংরেজদেরও হত্যা করেছিল। 

১৮২৮ সালে বাংলার দায়িত্ব পেয়ে আসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, তিনিও মধ্যভারতে এই সমস্যার কথা শুনেছিলেন। মধ্যপ্রদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ডাকাত ও ঠগ দমনের জন্য একটি সংস্থা তৈরি করে যার প্রধান করা হয় উইলিয়াম হেনরি। 

দিল্লি থেকে জব্বলপুরের রাস্তায় ঠগেদের উৎপাত কমানোর জন্য উইলিয়াম হেনরি প্রথমে জঙ্গল কিছুটা করে কাটার সিদ্ধান্ত নেয় কারন ঠগেরা জঙ্গলেই আশ্রয় নিত কিন্তু এত বেশী জঙ্গল ছিল যে এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। এরপর উইলিয়াম হেনরি তার দলকে নির্দেশ দেয় ছদ্মবেশ ধরে এসব এলাকায় নজর রাখতে এবং ঠগেদের চিহ্নিত করতে। 

১৮৩৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয় উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, তিনি উইলিয়াম হেনরিকে বিশাল পুলিশ বাহিনী দেয় ঠগেদের ধরতে। এভাবেই ১৮৩৪ সালে গ্রেফতার করা হয় আমের আলিকে। পুলিশের জেরায় আমের আলি দুশোজন ঠগের পরিচয় ফাঁস করে দেয় এবং ১৮৩৫ আসতে আসতে তাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের। আমের আলি পুলিশকে জানায় সে অন্তত ৭৫০ জনকে হত্যা করেছে। সে পুলিশকে একটি কবরের সামনে নিয়ে যায় যেখানে ১৫০ কঙ্কাল ছিল। বহু ঠগ গ্রেফতার হলেও তখনও ঠগেদের সর্দার সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যক্তি বেহেরাম জমাদারকে ধরা সম্ভব হয়নি। 

১৮৩৫ থেকে ১৮৩৯ সাল অবধি চারবছর অনুসন্ধান করার পর মধ্যপ্রদেশেরই এক গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বেহেরাম জমাদারকে। পুলিশকে বেহেরাম জানায় সে ৯৩১ জনকে হত্যা করেছে, তার কাহিনী শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ। মধ্যপ্রদেশের মানসোরের পুলিশ সপারিটেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন টেলর আমের আলির জবানবন্দির উপর ১৮৩৯ সালে একটি বই প্রকাশ করেন যার নাম কনফেশন অফ এ ঠগ। এই বই সেসময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বেস্ট সেলার পেয়েছিল। 

১৮৪০ সালে ফাঁসি দেওয়া হয় বেহরাম জমাদারকে। বেহরামের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ব্রিটিশ পুলিশ ১৪০০ ঠগকে গ্রেফতার করেছিল। যার মধ্যে ১০৬০ ঠগের অপরাধ ততটা বেশী না হওয়ায় তাদের মালয়েশিয়ার এক নির্জন দ্বীপে ছেড়ে আসা হয় যাতে তারা কোনওদিন ভারতে ফিরতে না পারে। ৪১২ জন ঠগকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং ৮৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ৪১২ জনের মধ্যে কেউ ৩৫০ কেউ ৪০০ এর মতোন লোককে হত্যা করেছিল৷ অর্থাৎ ঠগেরা চারশো বছরে ভারতে অন্তত কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের নেতৃত্বেই বেহরাম জামেদারের ৫০ বছরের আতঙ্ক শেষ হয়। যার কারনে ওই অঞ্চলের সাধারন মানুষ সেসময় উইলিয়াম হেনরিকে রীতিমতো নায়ক মনে করতো। তার সম্মানে মধ্যপ্রদেশের কাটনি শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং জব্বলপুর শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামের নাম স্লিমানাবাদ দেওয়া হয়। উইলিয়াম হেনরি এরপর গোয়ালিয়র যান সেখানে সাত বছর অফিসার পদে কাজ করার পর লক্ষনৌ যান। 

উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ভারতে থাকার সময় বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। এমনই একটি বইয়ে তিনি লিখেছিলেন একটি মানুষের বাচ্চার কথা যাকে একটি নেকড়ে দের দল পালন করছে। বলা হয় এই ঘটনার উপর ভিত্তি করেই রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর বিখ্যাত বই দি জঙ্গল বুক লিখেছিলেন যাতে মুংলি চরিত্রটি এই বাচ্চাটির উপরই বানানো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *