অফবিট

মানব ইতিহাসে গনতন্ত্রের বীজ রোপন করেছিল গ্রীসের কোন ঐতিহাসিক ঘটনা?

কয়েক হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন। প্রাচীনকালে রাজতন্ত্রে এটা নিয়ম ছিল রাজার কথাই শেষকথা এবং রাজার আদেশ সবাইকে মানতে হবে। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। এরপর রাজার সাথে একটি মন্ত্রীমন্ডল থাকে যাদের বিচার রাজা মানতে শুরু করে। আধুনিক যুগে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রই তুলে দেওয়া হয়েছে তার বদলে সংসদ তৈরি করা হয়েছে যেখানে জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে। রাজতন্ত্রে যেটা সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাহল যোগ্য না হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক অদক্ষ ব্যক্তি শাসক হয়ে যেত যার ফল ভোগ করত সাধারন মানুষ। কিন্তু গনতন্ত্রে দেশের মানুষ দক্ষ শাসক নির্বাচন করে ভোটের মাধ্যমে। ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা ঠিক করে ভবিষ্যতে ক্ষমতা কোন এক বিশেষ ব্যক্তির হাতে না থেকে সাধারন মানুষের হাতে থাকবে এবং সাধারন মানুষই তাদের পচ্ছন্দমতো শাসক নির্বাচন করতে পারবে, এরই নাম গনতন্ত্র যা পশ্চিমা দেশ গুলোতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ভবিষ্যতে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে এমনই এক ঘটনা ঘটে এক রাজাকে কেন্দ্র করে যিনি তার উদ্দেশ্য পূরনের জন্য এমন কিছু করে যা পরে মানব ইতিহাসে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটায়।

সময়টা তখন ৪৯৯ বিসি মানে আজ থেকে থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে। তুরস্কের সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি শহর মিলেতাসে তখন গ্রীক সংস্কৃতি বেশী অনুসরন করা হত। মিলেতাসের আশেপাশের বেশ কিছু শহরেও গ্রীক সংস্কৃতি অনুসরন করা হত। মিলেতাস সহ আশেপাশের শহর গুলো আয়োনিয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই আয়োনিয়া প্রদেশ সেসময় পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিলেতাস থেকে মূল পার্সিয়ান ভূখন্ড ছিল অনেকটাই দূরে সেকারনে পার্সিয়ান সম্রাট এসব অঞ্চলে শাসনের জন্য বিশেষ কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ করেছিল। প্রত্যেক ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল। এসব ব্যক্তিদের স্যাট্রেপস বলা হত। মিলেতাসের শাসক ছিল অ্যারিস্টাগোরাস, যিনি পার্সিয়ান সম্রাট ডারিয়াস দি ফাস্টের অধীনস্থ ছিলেন। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে ঘোড়াই ভরসা ছিল। যদি দরকারী কোন বার্তা পৌছাঁতে হত তাহলেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে কয়েক সপ্তাহ বা মাস লেগে যেত। ডারিয়াস দি ফাস্ট থাকত সেই সূদর ব্যাবিলনে, সেখান থেকে সেনা আনতে অন্তত কয়েক মাস লেগে যেত। যার কারনে স্যাট্রেপস দের মধ্যে যোগাযোগ করায় অনেক সমস্যা হত মাঝেমধ্যে। এজিয়ান সাগর উপকূলে যত স্যাট্রেপস ছিল তারা নিজেদের মধ্যেই একটা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করত কিভাবে ডারিয়াস দি ফাস্টের নজরে আসা যায় যাতে আরও বড় এলাকা পাওয়া যায় শাসনের জন্য। এজিয়ান সাগর উপকূলে এরকমই একটি পার্সিয়ান এালাক ছিল ন্যাক্সোস যা একটি দ্বীপ ছিল। এই দ্বীপের অধিবাসীরা স্যাট্রেপসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তাঁকে হত্যা করে কারন এখানে অতিরিক্ত কর নেওয়া হত। জনগনের হাতে ক্ষমতা আসায় আশেপাশের শহরের সাথে ন্যাক্সোসের বানিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং কর অনেকটাই কমানো হয়। মিলেতাসের স্যাট্রেপস অ্যারিস্টাগোরাস এই পুরো ঘটনা জানার পর ন্যাক্সোস দখলের পরিকল্পনা করে কারন তাহলে তাঁর কাছে ন্যাক্সোসের ভূমিও এসে পড়বে এবং পার্সিয়ান সম্রাট ডারিয়াস দি ফাস্টের চোখেও সম্মান পাবে সে। কিন্তু ন্যাক্সোস দ্বীপ হওয়ায় সেখানে আক্রমন করতে গেলে অনেক যুদ্ধজাহাজের প্রয়োজন ছিল কিন্ত অ্যারিস্টাগোরাসের কাছে এত জাহাজ ছিলনা যার কারনে সে পাশ্ববর্তী একটি রাজ্য লিডিয়ার কাছে সাহায্য চায়। এই লিডিয়ার স্যাট্রেপস ছিল স্বয়ং ডারিয়াস দি ফাস্টের ভাই। লিডিয়া থেকে জাহাজ নিয়ে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে অ্যারিস্টাগোরাস এবং একজন সুদক্ষ অ্যাডমিরাল নিয়োগ করে তাঁর নৌবাহিনীর জন্য যাঁর নাম মেগাবেটস। কিন্তু কোন কারনে মেগাবেটসের সাথে বিবাদ হয় অ্যারিস্টাগোরাসের এবং জনসমক্ষে মেগাবেটসকে অপমান করা হয়। 

মেগাবেটস সরাসরি কিছু বলেনি অ্যারিস্টাগোরাসকে কিন্তু সে বদলা নেবার উপায় খুঁজতে থাকে। মেগাবেটস ন্যাক্সোসে আক্রমনের আগে সেখানের মানুষদের খবর দিয়ে দেয় আক্রমন হতে চলেছে যার কারনে ন্যাক্সোস প্রস্ততি নিতে থাকে। এদিকে মেগাবেটস পুরো নৌবাহিনী নিয়ে ন্যাক্সোস যায় আক্রমন করতে, টানা চার মাস যুদ্ধ চলে এবং শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় মেগাবেটসের নৌবাহিনীর কারন ন্যাক্সোস ততদিনে প্রস্তত হয়ে গিয়েছিল। এই হাটের পুরো দায়ভার গিয়ে পড়ে অ্যারিস্টাগোরাসের উপর। লিডিয়ার স্যাট্রেপস ডারিয়াস দি ফাস্টের ভাইও তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়। অ্যারিস্টাগোরাস তাঁর নিজের রাজ্যেই সমালোচিত হয়। অবস্থা এমন হয় তাঁর স্যাট্রেপস পদই চলে যাবার উপক্রম হয়। এরকম অবস্থায় অ্যারিস্টাগোরাস একটি পরিকল্পনা তৈরি করে এবং মিলেতাসের মানুষকে পার্সিয়ান সম্রাটের বিরুদ্ধে বোঝাতে শুরু করে এবং মিলেতাসের আশেপাশের শহরের মানুষকেও বোঝাতে শুরু করে। এসব এলাকায় গ্রীক সংস্কৃতি আগে থেকেই থাকায় মানুষ খুব সহজে অ্যারিস্টাগোরাসকে বিশ্বাস করে ফলে এবং বিদ্রোহ ঘোষনা করে দেয়৷ ইতিহাসে এই ঘটনা আয়োনিয়ান বিদ্রোহ নামে বিখ্যাত। 

এরপর অ্যারিস্টাগোরাস বিশাল সেনা নিয়ে লিডিয়া আক্রমন করে। যে লিডিয়া তাঁকে সাহায্য করে সেখানেই অ্যারিস্টাগোরাস আক্রমন করে। লিডিয়ার স্যাট্রেপস ভয়ে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। অ্যারিস্টাগোরাসের সেনা লিডিয়া দখল করে লিডিয়ার রাজধানী সার্ডিসে আগুন ধরিয়ে দেয়, পুরো শহর জ্বলতে থাকে। ডারিয়াস দি ফাস্ট খবর পেয়েছিল বিদ্রোহের তাঁর সেনা রওনাও দিয়ে দিয়েছিল কিন্তু ব্যাবিলন থেকে লিডিয়া অনেক দূরে থাকায় তাঁর সেনা পৌছাঁতে একটু সময় লেগে যায় ততদিনে সার্ডিস শহরে আগুনে পুড়তে থাকে। ডারিয়াসের সেনা এসেই অ্যারিস্টাগোরাসের সেনার সাথে লড়াই শুরু করে। বিশাল পার্সিয়ান সেনার সামনে অ্যারিস্টাগোরাসের সেনা কিছুই ছিলনা। যুদ্ধে অল্প সময়েই অ্যারিস্টাগোরাস মারা যায় এবং তাঁর সেনাবাহিনীর বহু সদস্য গ্রেফতার হয় ও মারা যায়। এই ঘটনার পরেই পার্সিয়ান সম্রাট বুঝে যায় এজিয়ান সাগরের তীরে এসব গ্রীক রাজ্য গুলো কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রন করা দরকার। কিন্তু অ্যারিস্টাগোরাস মারা গেলেও সে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যে চিন্তাধারার সূচনা করে গিয়েছিল তা মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ন ঘটনা হয়ে দাড়ায়। কারন এরপর একের পর এক যুদ্ধ হতে থাকে পার্সিয়ান ও গ্রীকদের মধ্যে। শেষপর্যন্ত আলেকজান্ডার দি গ্রেট পার্সিয়াকে পরাস্ত করে। ইউরোপীয় সভ্যতা ও গনতন্ত্রের জন্ম গ্রীস থেকেই হয়েছিল এবং এতে অ্যারিস্টাগোরাসের বড় অবদান ছিল। যদি সেসময় অ্যারিস্টাগোরাস বিদ্রোহ না করত তাহলে আজও হয়ত বহু দেশে পার্সিয়ানদের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা বর্তমান থাকতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *