মানুষের মাংস খাওয়া কি ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয়। “কোন লাশের মাংস খাবো?”-২০০ বছর আগে পর্যন্ত ইউরোপে প্রচলিত ছিল মৃতদেহকে খাওয়ার রীতি
বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি বদলেছে পুরনো দিনের অনেক রীতি-নীতিও। আগে চিকিৎসা শাস্ত্রে উন্নতি না হওয়ার কারণে ষোরশ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে এমন অনেক রেওয়াজ প্রচলিত ছিল যেটা আজকের দিনে অবাস্তব বলেই মনে হবে। কারণ সেই সময় রাজ রাজা থেকে শুরু করে পুরোহিত এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত নিজেদের রোগ নিরাময়ের জন্য শবদেহ ভক্ষণ করত। সপ্তদশ শতাব্দি খুব একটা পুরনো নয়। অর্থাৎ ২০০ বছর আগে পর্যন্ত ইউরোপে প্রচলিত ছিল মৃতদেহকে খাওয়ার রীতি।
তাহলে একটু পরিষ্কারভাবেই বলা যাক, কয়েক বছর আগে ইউরোপে ঠিক কেমন প্রথা প্রচলন ছিল? ইউরোপে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য বই যেমন – নোবেলের বই, মেডিসিনাল ক্যানিবালিজম ইন আর্লি মডার্ন ইংলিশ লিটারেচার অ্যান্ড কালচার, ইংল্যান্ডের ডারহাম ইউনিভার্সিটির রিচার্ড সুগের বই, মমিস, ক্যানিবালস অ্যান্ড ভ্যাম্পায়ারস: দ্য হিস্ট্রি অফ কর্পস মেডিসিন ফ্রম দ্য রেনেসাঁ টু দ্য ভিক্টোরিয়ান্স ইউরোপে নরখাদকের প্রচলনের বিষয় তুলে ধরা আছে। এই সকল বইয়ের লেখা অনুযায়ী বলা হয়েছে যে, কয়েকশো বছর আগে অর্থাৎ ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরাও তাদের রোগ নিরাময়ের জন্য সব দেহ কিংবা মমির থেকে প্রাপ্ত মাথার খুলি, হাড় ও একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিত রোগের প্রতিকারক হিসেবে। যার কারণে সেই সময় কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তোলা বা মিশরীয় সমাধি থেকে মমি চুরি করা এবং আইরিশ সমাধি স্থল থেকে মাথার খুলি নেওয়া ও সেগুলিকে বেআইনিভাবে প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি করার ঢল পড়ে গিয়েছিল। এমনকি রমরমা চলছিল সেই বাজারও। মাথা ব্যাথা শুরু করে মৃগী রোগ পর্যন্ত যেকোনো রোগের দাওয়াই তৈরি করার মূল মন্ত্র ছিল মৃতদেহের হাড় রক্ত কিংবা চর্বি দিয়ে তৈরি ওষুধ। রিচার্ড সুগেরের কথায়, “মানুষের মাংস খাওয়া কি ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো “কোন লাশের মাংস খাবো?”
এবার আসা যাক ইউরোপীয় বাসিন্দারা কিভাবে এই মৃত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ওষুধ ব্যবহার করত। প্রথমে মিশরীয় মমিকে গুঁড়ো করে নেওয়া হত তারপর আরকের সঙ্গে সেটাকে মিশিয়ে রক্তপাত বন্ধের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হত। প্রথমে এই পদ্ধতিতে রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কাজ হলেও পরবর্তীতে মাথাব্যথা থেকে শুরু করে মৃগিরও সমস্ত রোগের ওষুধে ব্যবহার করা হতো মৃত মানুষের দেহাবশেষ। এছাড়াও মাথাব্যথা চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহার করতো করোটি গুড়া। কারণ তখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন শব দেহে নিশ্চিত রয়েছে ভেষজ গুণ এবং সেই ভেষজ গুণের প্রয়োগে সারবে সাধারণ মানুষের রোগ। অর্থাৎ ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের কথা মতোই শব দেহের মাংস ,করোটি, হাড় ,মস্তিষ্ক ব্যবহার করতেন বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে যাজক, রাজা এবং সাধারন মানুষেরা।
শুধুমাত্র যে শবদেহের অঙ্গ গুঁড়ো করে ওষুধ হিসেবে ভক্ষণ করত বিজ্ঞানীরা তাই নয়, এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে নানান গবেষণাও করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শব্দ শতকের একজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী টমাস উইলিস অ্যাপোলেক্সি বা মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ একটি পানীয় ঔষধি আবিষ্কার করেছিলেন। কি ওষুধ যে তিনি তৈরি করেছিলেন মৃত মানুষের মাথার খুলি এবং চকলেটের সংমিশ্রণে? সে সময়কার ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নিজের মস্তিষ্ক ঠিক রাখার জন্য দা কিংস ড্রপস নামের একটি পানীয় পান করতেন। যে পানীয়তে চোবানো থাকতো মৃত মানুষের মাথার খুলি। এছাড়াও মাটির তলে যে সমস্ত মৃতদেহ কবরস্থ করা থাকতো সেই মাটির উপরের জন্তু এক প্রকার শ্যাওলার আস্তরণ। যেটিকে তখনকার বিজ্ঞানীরা ইউসেনা বলে নামকরণ করেছিলেন। এই শ্যাওলার আস্তরণ টিকেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করতেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভেষজের মাধ্যমে নাক থেকে রক্তক্ষরণ এবং মৃগী রোগ নিরাময় করা যায় বলেই মনে করতেন তারা। শুধুমাত্র মাথার খুলি নয়, মৃত মানুষের চর্বি জীবিত মানুষের শরীরের বাইরে আঘাতের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো। ইউরোপ নয় জার্মানিতে দেখা গিয়েছে ক্ষতস্থান হোক কিংবা গেটে বাতের ব্যথা এই সকল রোগ নিরাময়ের জন্য চর্বি মাখা ব্যান্ডেজ ঘষা ও লাগাতেন চিকিৎসকেরা।
শব দেহ থেকে উৎপন্ন ওষুধ সেই সময়ের বাজারে বিক্রি হতো চড়া দামে। সেক্ষেত্রে গরিব মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ওষুধ ক্রয় করা। কিন্তু তারাও নরদেহজাত কথিত ওষুধের সেবন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওষুধের পাশাপাশি মৃতদেহের তাজা রক্ত সেবন করার প্রথা ছিল, কারণ তাদের অনুমান ছিল রক্ত পান করলে প্রাণশক্তি ভরপুর থাকবে।