অফবিট

ভিয়েতনাম যুদ্ধ জয় করতে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করিয়েছিল আমেরিকা। জানুন বিস্তারিত

সময়টা ১৯৭৪ সালের কোন এক বিকেল, আমেরিকার সেনেট কমিটির এক গুরুত্বপূর্ন বৈঠক চলছে। আমেরিকার বিদেশনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং গোপনীয় এই বৈঠকে উপস্থিত রয়েছে আমেরিকার রোথড দ্বীপের ডেমোক্রেট সেনেটর ক্লাইবোর্ন পেল এবং নিউ জার্সি শহরের রিপাবলিকান সেনেটর ক্লিফোর্ড কেস। এই বৈঠকে আলোচনা হচ্ছিল আবহাওয়া সম্পর্কে। ক্লাইবোর্ন পেল ছিলেন আমেরিকার তৎকালীন সমুদ্র ও আন্তজার্তিক আবহাওয়া বিভাগের চেয়ারম্যান। বিদেশনীতি সম্পর্কে অত্যন্ত গোপনীয় কোন বৈঠকে আবহাওয়া নিয়ে আলোচনা করা ব্যাপারটা একটু বেমানান হলেও এটা কোন সাধারন বিষয় ছিলনা। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রনকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক বছর ধরে আমেরিকার একটি অতি গোপনীয় প্রজেক্ট চলছিল। এই গোপনীয় প্রজেক্টের নাম অপারেশন পপআই। যার মূল লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রন করে আমেরিকার বিজয়। এই প্রোজেক্টে ক্লাউড সিডিং এর মাধ্যমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ জয়ের পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা।

১৯৫৫ সালে ১ নভেম্বর শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ যা শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রায় উনিশ বছর ধরা চলা এই যুদ্ধে ১৯৭৩ সাল নাগাদ বাধ্য হয়ে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় আমেরিকা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে হার আমেরিকার জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি বড় ধাক্কা ছিল। এই ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা বেশ কিছু গোপন প্রজেক্ট প্রয়োগ করেছিল যার একটি হচ্ছে প্রজেক্ট পপআই। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পাঁচ বছর ধরে আমেরিকান বায়ুসেনা এই প্রজেক্ট করেছিল। এই প্রজেক্টের লক্ষ্য ছিল উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিন লাওসের বিশেষ কিছু এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটানো যাতে রাস্তা নরম হয়ে যায়, ধ্বস নামে রাস্তায়, নদীতে বন্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে হো চি মিন অঞ্চলে এই প্রোজেক্ট শুরু করে আমেরিকান বায়ুসেনা। হো চি মিন বা আনামাইট রেঞ্জ যা উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিন ভিয়েতনামকে সংযুক্ত করে। তবে এই অঞ্চল গিয়েছে লাওস ও কম্বোডিয়া হয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনামীরা বা ভিয়েত কং এই এলাকা দিয়েই তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট পেত। আমেরিকা উত্তর ভিয়েতনামের এই মিলিটারি সাহায্য বন্ধ করার জন্যই এই প্রজেক্ট শুরু করেছিল। সাধারনত সূর্যের তাপে বাতাস গরম হয়ে হালকা হয়ে যায়। হালকা বাতাস ঊর্ধগামী হয়। এই বাতাসের চাপ কম হতে থাকে ক্রমশ এবং একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছানোর পর বায়ু ঠান্ডা হয়ে যায়। পরে সেই বায়ু ঘনিভূত হয়ে মেঘ বা ক্ষুদ্র জলকনা তৈরি করে। যা পরে মাধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে নীচে বৃষ্টি আকারে নেমে আসে। এটা হচ্ছে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে বৃষ্টিপাত। কিন্তু বিশ্বের অনেক জায়গা আছে যেখানে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে। সেখানে দরকার পরে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তির, যাকে ক্লাউড সিডিং বলা হয়।

১৯৪৬ সালে আমেরিকান রসায়নবিদ ভিনসেন্ট জোসেফ সর্বপ্রথম কৃত্রিম বৃষ্টিপাত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৯৪৭ ও ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়াতে এই পদ্ধতির সর্বপ্রথম প্রয়োগ করা হয়। তবে ১৮৯১ সালে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত তৈরিতে তরল কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যাবহারের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্ত কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের সম্পূর্ন পদ্ধতি ভিনসেন্ট জোসেফই তৈরি করেছিলেন। ক্লাউড সিডিং পদ্ধতিতে ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড, ক্যালশিয়াম কার্বাইড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, সিলভার আয়োডাইড, পটাশিয়াম আয়োডাইড ব্যাবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে মেঘের মধ্যে তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস সাত ডিগ্রিতে নিয়ে আসা হয়, যাতে বিমানে করে যে অঞ্চলে ক্লাউড সিডিং হবে সেই অঞ্চলের মেঘে সিলভার আয়োডাইড প্রয়োগ করা হয়।

২০০৮ সালে বেজিং অলিম্পিকে চীন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল। ঠিক একই পদ্ধতি আমেরিকা ১৯৬৭ -৭২ সালে ভিয়েতনামেও প্রয়োগ করেছিল।

থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস হয়ে ভিয়েতনামে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন গোপন ভাবে করেছিল আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসেঞ্জার এবং সিআইএ। এই বিষয়ে কোন তথ্য জানতইনা সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স মেলভিন লায়ার্ড। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে এই প্রজেক্ট শুরু করার আগে অপারেশন পপআই এর পরীক্ষা করা হয় ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে লাওসের সী কং নদীর তীরে বলোভেনস উপত্যকায়। লাওসের সরকারের অনুমতি ছাড়াই এই পরীক্ষা করা হয়েছিল। এই সময়ে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স পঞ্চাশের বেশী ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা করেছিল যার ফলাফল আশানুরূপ ছিল। ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়েই যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এই প্রজেক্টে যতটা বৃষ্টিপাত করানো হয়েছিল সেটা যথেষ্ট ছিল ওই এলাকার রাস্তা খারাপ করতে যা ঠিক করতে পারেনি উত্তর ভিয়েতনামিরা। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে পূর্ব ভিয়েতনাম সীমান্তে একটি আমেরিকান বিশেষ বাহিনীর ক্যাম্পও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্সের বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিল তাদের পরীক্ষা যথেষ্ট সফল, এই পরিমান বৃষ্টিপাত হলে রাস্তা যানচলাচল অযোগ্য হয়ে পড়বে। আমেরিকা আগেই এই অঞ্চলে সমস্ত সেতু্কে বোম্বিং করে উড়িয়ে দিয়েছিল, ফলে ক্লাউড সিডিং এর জন্য উত্তর ভিয়েতনামের সহয়তা একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রজেক্টের জন্য আমেরিকার বেশী লোকও প্রয়োজন পড়েনি, এমনকী খরচও অনেক কম হয়েছিল। মাত্র দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস হেলিকপ্টারকে বিশেষ ভাবে ক্লাউড সিডিং পোগ্রমের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। উত্তর পূর্ব থাইল্যান্ডে আমেরিকার বেসে অতিরিক্ত মাত্র ৩৩ জন সদস্য যোগ দিয়েছিল এই মিশনের জন্য। সেখানে আগে থেকেই বিশেষ বিমান রাখা ছিল। এই বিমানে ক্লাউড সিডিং এর জন্য লেড আয়োডাইড এবং সিলভার আয়োডাইড ব্যাবহার করা হয়েছিল। প্রজেক্ট স্ট্রোমফিউরির জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার নেভাল এয়ার ওয়েপনস স্টেশনে এটা আগেই তৈরি করেছিল। এর আগেই টেক্সাস, ফ্লোরিডা, গুয়ামে এর প্রয়োগ পরীক্ষা করে দেখেছিল আমেরিকা। অতি ঘূর্নিঝড়কে নিয়ন্ত্রন করার জন্যই আমেরিকা প্রজেক্ট স্ট্রোম ফিউরি শুরু করেছিল। এই মিশনের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল উত্তর ভিয়েতনামের জনবহুল এলাকা গুলোর জন্য বিশেষ করে ডং হই শহরের জন্য। তবে যেহেতু সে সময়টা বর্ষাকাল ছিল তাই জন্য এই এলাকার মানুষকে ততটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। অন্য কোনও সময় এই মিশন শুরু করা হলে ধান চাষ, ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা ছিল। তবে লাওসে এই মিশন করা হয় কম জনবসতি পূর্ন এলাকাগুলোতে। তবে এই মিশনের সবচেয়ে সুবিধা ছিল সাধারন মানুষের থেকে উত্তর ভিয়েতনামী মিলিটারি বেশী সমস্যায় পড়বে কারন মিলিটারি গাড়ির উপর বেশী নির্ভরশীল।

অবশেষে ১৯৬৭ সালের ২০ মার্চ আমেরিকার ৫৪ তম ওয়েদার রিকোনেসান্স স্কোয়াড্রন অপারেশন পপআই শুরু করে, তাদের স্লোগান ছিল কাদা তৈরি করো, যুদ্ধ নয়। 

১৯৬৭ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে প্রত্যেক বর্ষাকালে মার্চ থেকে নভেম্বর মাস অবধি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। থাইল্যান্ডের উডোন থানি রয়েল থাই এয়ারফোর্স বেস থেকে দুটি সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান, দুটি এফ-৪সি ফ্যান্টম বিমান প্রত্যেকদিন দুইবার করে উড়তো মিশনের জন্য। সরকারি ভাবে জানানো হত এই বিমানগুলো আবহাওয়া পর্যবেক্ষন করছে। এই মিশনের কোডনেম দেওয়া হয়েছিল মটোরপুল। প্রথমে এই প্রজেক্ট শুরু করা হয় অর্ধেক লাওটিয়ান প্যানহ্যান্ডেল এলাকা জুড়ে। ১১ জুলাই, ১৯৬৭ এই মিশন উত্তর ভিয়েতনামের বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে করা হয়। সেপ্টেম্বর মাস আসতে আসতে দক্ষিন ভিয়েতনামের সাউ উপত্যকাকেও যুক্ত করা হয় মিশনে।

১৯৭২ সাল আসতে আসতে কম্বোডিয়ার উত্তর পূর্ব এলাকা জুড়েও এই অপারেশন করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ৫ জুলাই এই প্রজেক্ট বন্ধ করা হয়। আমেরিকার পেন্টাগন পেপারস প্রকাশের পর অপারেশন পপআই এর কথা সর্বপ্রথম জনসমক্ষে আসে। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস এই ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও লেখা হয়েছিল, তার দুইদিন পরেই লাওসে এই অপারেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *