কমিউনিজমের কলো অধ্যায় ইউক্রেনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের মাধ্যমে শুরু হয় ইউরোপের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক সমস্যা রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ যা এখনও চলমান। রাশিয়ান আক্রমনে পূর্ব ইউক্রেন পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই প্রথম নয়, অতীতেও রাশিয়ার কারনে ইউক্রেনে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আজ যে ক্ষয়ক্ষতি ইউক্রেনে হচ্ছে অতীতে তার থেকেও অধিক বেশী ধ্বংসলীলার স্বাক্ষি থেকেছে ইউক্রেন। ১৯৩২-১৯৩৩ সালে ইউক্রেনে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যার কারনে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা হোলোডোমোর বা ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ কোনও প্রাকৃতিক কারনে হয়নি বরং একজন নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট শাসকের ভুল নীতির কারনে ইউক্রেনে মৃতদেহের স্তূপ তৈরি হয় যা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।
ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে কমিউনিজম বা সাম্যবাদের যখন উত্থান হয়েছিল তখন সমাজের শোষিত, নীপীড়িত শ্রেনী বেঁচে থাকার নতুন অবলম্বন পেয়েছিল। কমিউনিজম ইউরোপের দারিদ্র্য পীড়িত শ্রমিক শ্রেনীকে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। যার জন্য আগুনের দিকে পতঙ্গ যেভাবে ছুটে যায় তেমনভাবেই দলেদলে মানুষ কমিউনিস্ট হয়ে যায় এবং ইউরোপে কমিউনিজম দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষজন জানতোনা কমিউনিজম বৈজ্ঞানিক গবেষনার সেই ফর্মুলার মতো যার তখনও ল্যাবে প্রয়োগ হয়নি। যার জন্য যখন বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা হয় তার কিছু বছরের মধ্যে দেশটির জনগন বুঝতে পারে কত বড় ভুল তারা করে ফেলেছে। কমিউনিস্ট শাসনে শোষিত শ্রেনীর উপর নিপীড়নের মাত্রা আরও বেড়ে যায়, তাদের প্রতিবাদের কোনও উপায় থাকেনা, প্রতিবাদ করলেই মৃত্যু তাদের একমাত্র সঙ্গী হয়। কমিউনিস্ট শাসনে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হয় যাদের কারনে কয়েক লাখ সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতোন কমিউনিস্ট দেশে ক্রুর কমিউনিস্ট শাসকদের কারনে কোনও বড় যুদ্ধ ছাড়াই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ইতিহাসে এমনই এক নিষ্ঠুর, ক্রুর কমিউনিস্ট শাসক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্টালিন যার কারনে সোভিয়েত ইউনিয়নে ষাট থেকে নব্বই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ইউক্রেনের হোলোডোমোরের জন্য দায়ী এই জোসেফ স্টালিনই।
ইউক্রেনীয় ভাষায় হোলোডোমোর শব্দের অর্থ ক্ষুধার কারনে মৃত্যু। ১৯৩২ সাল থেকে হোলোডোমোর ইউক্রেনীয় অঞ্চলে শুরু হয়, ১৯৩৩ সালের বসন্তকালে সবচেয়ে বেশী মানুষের মৃত্যু হয় ক্ষুধার কারনে। এই দুর্ভিক্ষের স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখে।
১৯২৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত যেখানে রাশিয়া ও বেলারুসে ১৬.৯ শতাংশ এবং ১১.৭ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয় সেখানে ইউক্রেনীয় অঞ্চলে মাত্র ৬.৬ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। ইউক্রেনে হোলোডোমোরের পটভূমি তৈরি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দশ বছর পর ১৯২৮-১৯২৯ সালের দিকে। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউক্রেনে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছিলো। ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে হওয়া বলশেভিক বিদ্রোহের পর ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হয়। তবে রাশিয়ায় জারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হলে ১৯১৮ সালে ইউক্রেন নিজেকে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষনা করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের সময় জোরপূর্বক ইউক্রেনকে সোভিয়েত ইউনিয়নে যুক্ত করা হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই ইউক্রেনের বাসিন্দারা সোভিয়েত নেতৃত্বের উপর খুশি ছিলনা কিন্তু ইউক্রেনের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব চাইছিলো তাদের অবস্থান আরও মজবুত করতে যাতে আন্তজার্তিক স্তরে একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে উত্থান হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। কিন্ত এইসময় ইউক্রেনের ভিতর জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ভ্লাদিমির লেলিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের দায়িত্ব যায় জোসেফ স্টালিনের কাছে, এখান থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয় কমিউনিজমের অন্ধকার অধ্যায়ের। জোসেফ স্টালিনের সরকার ইউক্রেনে বিভিন্ন আইন শুরু করে যা পরে জনজীবন ধ্বংসের কারন হয়। স্টালিন ইউক্রেনের বাসিন্দাদের স্বাধীনতার দাবী বন্ধ করার জন্য কঠোর নীতি গ্রহন করে। সোভিয়েত গোপন পুলিশ ও রেড আর্মি ইউক্রেনের সমর্থনকারী কয়েক হাজার কৃষক, অভিজাত সম্প্রদায়, শিক্ষাবিদদের হত্যা করে যাতে ইউক্রেনের মানুষ সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় খায়।
জোসেফ স্টালিন ১৯৩০ সালে দেশে শিল্পোন্নয়নের জন্য আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোকে খাদ্যশস্য রপ্তানির পরিমান বৃদ্ধি করবার সিদ্ধান্ত নেয়। এর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি অঞ্চলে কৃষকদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেওয়া হয় সরকারকে শস্য জমা দেওয়ার। ইউক্রেন ইউরোপের বরাবরই উর্বর এলাকা যার জন্য ইউক্রেনের কৃষকদের শস্য জমা দেওয়ার পরিমান বাকী সমস্ত অঞ্চলের থেকে বেশীই ছিল। বলা হয় ইউক্রেনে সোভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহ দমাতে স্টালিন ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছিল। সোভিয়েত সরকার এইসময় যৌথ খামার নীতি চালু করে, এই আইন অনুযায়ী দেশের সমস্ত জমি ও গবাদি পশু যৌথ খামারের অংশ করে দেওয়া হয় এবং কৃষকদের তাদের নিজেদের জমিতেই জোর করে শস্য উৎপাদন করতে বাধ্য করতো সোভিয়েত সেনাবাহিনী। সোভিয়েত প্রশাসনের এই অত্যাচারের মধ্যেই প্রকৃতিও ইউক্রেন বাসীর বিরুদ্ধে চলে যায়। ১৯৩২ সালে বৃষ্টির পরিমান অতিরিক্ত কম হওয়ায় এবং ফসলে পোকার কারনে শস্য উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৩১ সালে ইউক্রেনে যেখানে ৭.২ মিলিয়ন টন শস্য উৎপাদন হয়েছিল সেখানে ১৯৩২ সালে শস্য উৎপাদন হয় মাত্র ৪.৩ মিলিয়ন টন। এরকম পরিস্থিতি সত্বেও সোভিয়েত প্রশাসন কৃষকদের থেকে তাদের নিজস্ব খাদ্যশস্য পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে যায় জোর করে। প্রশাসন ১৯৩১ সালের শুরুতেই জানতো ১৯৩২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে তাও তারা ইউক্রেনবাসীর উপর অত্যাচার চালায়।
ইউক্রেনের মানুষদের কাছে খাদ্যশস্যের তীব্র অভাব শুরু হয়, মানুষের কাছে খাওয়ার রুটি পর্যন্ত ছিলনা। বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকমাস ধরে মানুষজন রুটি পর্যন্ত খেতে পায়নি, শুধুমাত্র লুকিয়ে রাখা আলু খেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে মানুষজন। একটা সময় আলুর মজুতও শেষ হয়ে যায়, তখন সবাই গবাদি পশুর জন্য রাখা খাওয়ার খেতে বাধ্য হয়। কিন্তু বহু পরিবারের কাছে পশুখাদ্যও ছিলনা যার জন্য তারা অচিরেই মারা যায়।
ইউক্রেনে সেসময় গ্রামের পর গ্রামের বয়স্ক, ছোট বাচ্চারা বাধ্যহয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা শুরু করে খাদ্যের জন্য কিন্তু খাদ্য দেবে কে, কারও কাছেই খাদ্য ছিলনা। ক্ষুধার তাড়নায় অনেকে গাছের ছাল, পাতা সেদ্ধ করে খাওয়া শুরু করে। যদি কোনও ব্যক্তি তার ঘরের কিছু আসবাবপত্র বিক্রি করে খাদ্যশস্য কিনতো তাহলে তাকে গ্রেফতার করতো সোভিয়েত পুলিশ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে গিয়েছিল কোথাও কোথাও মানুষ মানুষের মাংস খাওয়াই শুরু করেছিল। তবে ইউক্রেনের সর্বত্র এরকম পরিস্থিতি ছিলনা, কমিউনিস্ট দলের সদস্যদের পরিবারের কোনও খাদ্যাভাব ছিলনা। সোভিয়েত সরকারের শস্যভান্ডারে যথেষ্ট খাদ্যশস্য মজুত ছিল তাও স্টালিন ইউক্রেনে তা সরবরাহ করেনি। আসলে সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে এই দুর্ভিক্ষ ছিলনা, শুধুমাত্র ইউক্রেন ও তার আশেপাশের অঞ্চলেই এই খাদ্যাভাব ছিল। ইউক্রেন ছাড়াও পশ্চিম সাইবেরিয়া, কাজাখিস্তান, উত্তর ককেশাস অঞ্চল, ভলগা এবং উরাল অঞ্চলে এই দুর্ভিক্ষ দেখা গিয়েছিল।
গোটা বিশ্বের থেকে সম্পূর্ন এই ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিল জোসেফ স্টালিনের কমিউনিস্ট সরকার। এমনকী ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে জুলাই মাসের মধ্যে বিভিন্ন দেশের দেওয়া ১,৭৬,২০০ টন এবং ৩,২৫,০০০ টন খাদ্যশস্যের ত্রানও গ্রহন করেনি সোভিয়েত প্রশাসন। এই দুর্ভিক্ষের কারনে অনাহারের পাশাপাশি অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে ভুগেও অসংশোধনীয় মানুষের মৃত্যু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেসময় এই হোলোডোমোরে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত রয়েছে। একটি তথ্য অনুযায়ী অন্তত এক কোটি কুড়ি লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেসময়। শুধু কাজাকিস্তানেই মৃত্যু হয়েছিল দশ লাখ লোকের। ২০০৩ সালে জাতিসংঘে পঁচিশটি দেশ সম্মিলিত ভাবে জানায় ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষে সত্তর লাখ এক কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছে। তবে বিভিন্ন গবেষকের দাবী এই সংখ্যাটা ত্রিশ লাখ থেকে পঁচাত্তর লাখ। তবে সংখ্যা যাইহোক সেসময় ইউক্রেন ও কাজাখিস্তানের অন্তত ৩৫ শতাংশ জনসংখ্যার মৃত্যু হয়েছিল স্টালিনের দ্বারা তৈরি এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার এই দুর্ভিক্ষ লুকিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু ১৯৪২ সালের পর সব তথ্য প্রকাশ হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে ৩৪টি দেশ ও ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট এই ঘটনাকে জোসেফ স্টালিনের গনহত্যা বলে ঘোষনা করে। পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে বলে ঘোষনা করে। শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্য জোসেফ স্টালিনের মতো নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট শাসকের কারনে ১৯৩৩ সালে সত্তর লাখ থেকে এক কোটি নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।