হিরোশিমা শহরে ফেলা পরমানু বোম্বের থেকেও ২৪ গুন বেশী শক্তিশালী পরমাণু বোম্ব তৈরি আমেরিকার
গত ২৭ অক্টোবর আমেরিকা নতুন একটি পরমানু বোম্ব বি ৬১ – ১৩ তৈরি ও পরীক্ষা করার ঘোষনা করে। আমেরিকার তৈরি এই নতুন বোম্ব ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা শহরে ফেলা পরমানু বোম্বের থেকেও ২৪ গুন বেশী শক্তিশালী হবে। যদি এই বোম্ব কোথাও ফেলা হয় তাহলে তার আটশো মিটারের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ লোক সাথে সাথে মারা যাবে, ১.৫ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত পরিকাঠামো মাটিতে মিশে যাবে এবং ৩.২১ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত মানুষ এক মাসের মধ্যে তেজস্ক্রিয় বিকিরনের প্রভাবে মারা যাবে। এরপরেও যে ১৫ শতাংশ লোক বেঁচে থাকবে তারা পরবর্তী কালে প্রানঘাতি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। যেই অঞ্চলে এই বোম্ব ফেলা হবে তার কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা জুড়ে অন্তত ৮,৬৮,০০০ এর বেশী লোক আহত হবে বোম্বের প্রভাবে। আমেরিকার এই ঘোষনার পর থেকেই বিতর্ক তৈরি শুরু হয় কারন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার ফেলা পরমানু বোম্বের থেকেও ২৪ গুন শক্তিশালী পরমানু বোম্ব পৃথিবীর জন্যই হুমকী স্বরূপ। বলা হচ্ছে আমেরিকা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপে রাখতেই এই বোম্ব তৈরি করছে। আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীন, এই দুটি দেশও পিছিয়ে নেই, রাশিয়া ও চীন আমেরিকাকে চাপে রাখতে যথেষ্ট শক্তিশালী বোম্ব তৈরি করছে। বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ন বিভাগ হচ্ছে পরমানু রাজনীতি, যার অঙ্গ হিসাবে পরমানু শক্তিধর দেশগুলো তাদের পরমানু সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।
গত ৭ অক্টোবর যেদিন থেকে ইসরায়েল ও হামাসের যুদ্ধ শুরু হয়েছে তারপর থেকে আমেরিকার উপর ইসরায়েলকে সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকেই আমেরিকা ইসরায়েলকে সমর্থন করে আসছে। হামাসের সাথে যুদ্ধেও ইসরায়েলের পাশে আছে আমেরিকা, ইসরায়েলকে অস্ত্র পাঠিয়েছে আমেরিকা। আমেরিকা তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গ্রুপ ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড সহ আরও একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার পাঠিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে সহায়তা করতে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে ইসরায়েলের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিনে লোহিত সাগর রয়েছে। এই ভূমধ্যসাগর পাঁচ হাজার সেনা বিশিষ্ট ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড এবং লোহিত সাগরে ইউএসএস আইসেনহাওয়ার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও চারটি যুদ্ধজাহাজকে পাঠিয়েছে আমেরিকা। অর্থাৎ ইসরায়েলকে পশ্চিম ও দক্ষিন সমুদ্র উপকূলে সম্পূর্ন নিরাপত্তা দিচ্ছে আমেরিকা। যার কারনে মধ্যপ্রাচ্যে ইরাক ও সিরিয়াতে আমেরিকার সামরিক বেসে এক সপ্তাহে উনিশ বার ড্রোন হামলা করেছে ইরান সমর্থিত জঙ্গি সংগঠন, যাতে একুশ জন আমেরিকান সেনা আহত হয়। এরপর আমেরিকার সামরিক সেক্রেটারি লয়েড অস্টিন ইরানকে হুমকি দিয়ে জানায় এরপরে এরকম ঘটনা ঘটলে আমেরিকাও তার বদলা নেবে। আমেরিকার এই হুমকির পরে এটাই মনে হচ্ছিল আমেরিকা হয়ত এই পরমানু বোম্ব তৈরি করছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানকে চাপে রাখতে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই আমেরিকা ইসরায়েল হামাস যুদ্ধে পরমানু অস্ত্র প্রয়োগের বিরোধীতা করে। সুতরাং এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এই বোম্ব তৈরি করছেনা। আমেরিকা এই পারমানবিক বোম্ব তৈরি করছে অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের দুই শক্তিশালী প্রতিপক্ষ রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য। নিউক্লিয়ার পোস্টার রিভিউ নামে আমেরিকাতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে ২০৩০ এর মধ্যে আমেরিকা রাশিয়া ও চীনের থেকে ব্যাপক পারমানবিক ঝুঁকিতে পড়বে, বিশেষ করে রাশিয়ার পরমানু অস্ত্র অত্যাধিক পরিমানে রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের নয়টি পরমানু শক্তিধর দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পরমানু অস্ত্র রয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছে। রাশিয়ার কাছে ৫,৮৮৯ এবং আমেরিকার কাছে ৫,২২৪ টি পরমানু বোম্ব রয়েছে। এছাড়া চীনের কাছে ৪১০, ফ্রান্সের কাছে ২৯০, ব্রিটেনের কাছে ২২৫, ভারতের কাছে ১৬৪, পাকিস্তানের কাছে ১৭০ টি পরমানু বোম্ব রয়েছে। নিউক্লিয়ার পোস্টার রিভিউতে আরও বলা হয়েছে আগামী দশ বছরে আরও এক হাজার পরমানু ওয়ারহেড তৈরি করে ফেলবে চীন, এই রশিয়া ও চীন উভয়েই কুটনৈতিক ভাবে বন্ধু দেশ। তাই আমেরিকা বোম্ব বি ৬১ – ১৩ পরমানু বোম্ব তৈরি করছে কুটনৈতিক স্তরে তার আধিপত্য বজায় রাখতে। বিশ্বে প্রথম পরমানু বোম্ব তৈরি করেছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রই এবং এর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল বিখ্যাত পদার্থবিদ রবার্ট ওপেনহাইমারের। তবে বর্তমানে আমেরিকার থেকে রাশিয়ার কাছেই পরমানু অস্ত্রের সংখ্যা বেশী রয়েছে। এছাড়া আমেরিকার এই শক্তিশালী পরমানু বোম্ব তৈরির আরও একটি কারন হচ্ছে আমেরিকার আভ্যন্তরীন রাজনীতি।
বি ৬১- ১৩ পরমানু বোম্ব তৈরি ঘোষনার পরেই আমেরিকান কংগ্রেসে বিরোধী গোষ্ঠি রিপাবলিকান দল এই ঘোষনার সমালোচনা করে জানায় শুধু এই একটি বোম্ব তৈরি যথেষ্ট নয় রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে। আসলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ন বিভাগ এই পরমানু বোম্ব রাজনীতি। যেমন ১৯৮০ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী রিপাবলিকান দলের রোনাল্ড রিগ্যান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের পরমানু নীতির সমালোচনা করে জানায় সে রাষ্ট্রপতি হলে আমেরিকার সামরিক শক্তি ও পরমানু অস্ত্র ভান্ডার আরও আধুনিক করবে। এই প্রচারনার উপর ভিত্তি করে সেই বছর রোনাল্ড রিগ্যান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়। তখন থেকেই পরমানু অস্ত্র আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি প্রধান বিভাগ হিসাবে ব্যবহার হতে থাকে। যে প্রার্থী যত শক্তিশালী পরমানু নীতির প্রচার করতে পারবে তারই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমেরিকার দুই রাজনৈতিক দলও দুই ধরনের পরমানু বোম্বকে নির্বাচন প্রচারে ব্যবহার করছে বারংবার। যেমন ডেমোক্রেট দল বোম্ব বি ৬১ – ১৩ পরমানু বোম্বের সমর্থনে রয়েছে অন্যদিকে রিপাবলিকান দলের পচ্ছন্দ বি ৮৩- ১ পরমানু বোম্ব। আমেরিকার ডেমোক্রেট দলের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বি ৮৩ পরমানু বোম্বকে অবসরে পাঠিয়ে দেয় কিন্তু রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হয়েই বি ৮৩ এর অবসরের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়, আবার ডেমোক্রেট দলের জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি হয়েই পুনরায় বি ৮৩ বোম্বকে অবসরে পাঠায়। অর্থাৎ পরমানু বোম্বের প্রয়োগ কোথাও হচ্ছেনা কিন্তু আমেরিকাতে যে দলের সরকার তাদের নিজ নিজ পচ্ছন্দের পরমানু বোম্ব থাকবে।
আমেরিকা যে নতুন বি ৬১- ১৩ পরমানু বোম্ব তৈরি করছে, সেই বি ৬১ সিরিজের পরমানু বোম্ব ১৯৬০ এর দশক থেকেই তৈরি করছে আমেরিকা। এর আগে বি ৬১ সিরিজের ৪,৭,১০,১১ এবং ১২ তৈরি করা হয়েছে, এই পাঁচটি বি ৬১ সিরিজের বোম্ব তৈরি করতে দশ বিলিয়ন ডলারের বেশী খরচ হয়েছে আমেরিকার। কিন্তু নতুন বি ৬১- ১৩ বোম্ব তৈরি করতে আটশো মিলিয়ন ডলার খরচ সুতরাং বি ৬১ সিরিজের পুরোনো পাঁচটি বোম্ব তৈরির ব্যাপক খরচ বাঁচাতে আমেরিকা এই নতুন বোম্ব তৈরি করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল মূলত ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরে।
১৯৪৫ সালের ৭ মে জার্মানির আত্মসমর্পনের সাথে সাথে ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এরপর জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব জার্মানির নিয়ন্ত্রন নেয় এবং আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স পায় পশ্চিম জার্মানির দায়িত্ব। ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকা ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ত এবার প্রশান্ত মহাসাগরে আসবে। প্রশান্ত মহাসাগরে মূলত আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। আমেরিকা এইসময় ভাবে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রশান্ত মহাসাগরে আসে তাহলে জাপানকেও জার্মানির মতোন দুই ভাগে ভাগ করতে হবে। তাই আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের আগেই জাপানকে পরাজিত করে বিশ্বে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। ঐতিহাসিক গার আলপেরোভিটজ তার বই অ্যাটমিক ডিপ্লোম্যাসি হিরোশিমা এন্ড পটসড্যামে লিখেছেন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকা পরমানু বোম্ব ফেলেছিল শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে, জাপানকে পরাজিত করতে নয় কারন জাপান কিছু মাসের মধ্যে নিজে থেকেই আত্মসমর্পন করতো।
পরমানু বোম্বের ধ্বংসলীলা দেখার পরেই আমেরিকা বুঝে যায় এই বোম্বের ব্যবহার ভবিষ্যতে করা যাবেনা, এরপরেই আমেরিকা তার বন্ধুস্থানীয় দেশগুলোকে পরমানু হুমকীর থেকে রক্ষার জন্য আশ্বাসন দেয় কারন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা সুপার পাওয়ার দেশ হিসাবে উঠে আসে। তখন থেকেই শুরু হয় পরমানু রাজনীতি। সব সামরিক শক্তিশালী দেশগুলোই পরমানু বোম্বকে ইনশিওরেন্স হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন পরমানু অস্ত্র পরীক্ষা না করার চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে কারন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে রাশিয়ার উপর বিশ্বব্যাপী আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তাই রাশিয়াও আজ পরমানু বোম্বকে তাদের ইনশিওরেন্স হিসাবে ব্যবহার করছে। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে পরমানু বোম্বকে ঘিরে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।