ইংল্যান্ডে মৃত মানুষদের সাথে ছবি তোলা ফ্যাশানে পরিনত হয়েছিল। জানুন বিস্তারিত
বর্তমান যুগে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ফটো তোলা কোনও বিস্ময়কর বিষয় নয়। খুশির মুহূর্ত কিংবা দুঃখের, প্রতি মুহূর্তের স্মৃতি উপলব্ধি করতে ক্যামেরা বন্দি করে রাখা আজকালকার দিনে একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে পূর্বে যখন ক্যামেরা ও ফটো তোলার এত ঝুঁকি ছিল না তখনকার সময়ে ক্যামেরা শুধুমাত্র ব্যবহার করা হতো পুলিশের কাজে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বা কোন আইনি কাজের সাক্ষী রাখতে ফটো তোলার নিয়ম ছিল। তবে কালের পরিবর্তনে অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ান যুগে এই ছবি তুলে রাখা পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হতো মানুষের সঙ্গে।
১৮ শতকের শুরুর দিকে প্রথম প্রচলন ঘটেছিল ক্যামেরার ব্যবহার। এই ক্যামেরার প্রচলনের প্রথম দিকে বিষয়টা ছিল বড্ড ব্যয়বহুল। কিন্তু ১৮৫০ থেকে ৬০-এর দশক নাগাদ ক্যামেরার প্রচলন সংস্থা হয়ে যাওয়ার কারণে এর মূল্য ছিল খুবই নগণ্য। আর যদিও সেই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর। তখন সকলকে অবাক করে দিয়ে নিজের স্বামীর মৃত্যু শোক প্রকাশ করতে রানী ভিক্টোরিয়া ঘোষণা করেছিলেন যে তখনকার সময় থেকে নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কালো পোশাক পরিধান করবেন তিনি। কালের পরিবর্তে এবং যুগের পরিবর্তনে সে কালো পোশাক একটি ট্রেন্ডে দারিয়ে গেছিল। অর্থাৎ সেই সময়কার দিন থেকে কোন মানুষের মৃত্যু হলে তার পরিবারের সদস্য এবং নিকট আত্মীয়রা শোক প্রকাশের জন্য কালো পোশাক পরিধান করতেন। অনেক সময় এটাও দেখা গেছিল যে মৃতের স্বহস্তে লিখিত উইলনামা, চুলের তৈরি অলঙ্কার, শোক প্রকাশক আংটি, শোক পোশাক, মৃতের স্কেচ, মৃতদেহের প্রতিমূর্তি, চিঠি ও স্মৃতিচারক চিত্র সম্বলিত কার্ড সংরক্ষণ করে মৃতের শোক পালন করা হত। তবে একটা সময় একাধিক পদ্ধতি অবলম্বনের পর মানুষ শোক প্রকাশ হিসেবে ছবি তোলাটাকে বেছে নিয়েছিল। অর্থাৎ নিজেদের স্মৃতিতে মৃত মানুষকে চিরস্মরণীয় রাখতে মৃতদের সঙ্গে ছবি তুলত পরিবারের বাকি জীবিত সদস্যরা। বিশেষ করে এর প্রবণতা বেশি দেখা গেছিল ১৮৬০ নাগাদ।
১৮৬০ দশক নাগাদ ইংল্যান্ডে ডিফথেরিয়া, কলেরা ও টাইফয়েডের জর্জরিত হয়ে উঠেছিল একাধিক শহর। এই মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল শতাধিক শিশু। সেই সময় থেকে মৃত শিশুদের কবরস্থ করার আগের মুহূর্ত স্মৃতিতে বজায় রাখতে তাদের সঙ্গে ছবি তুলত পরিবারের বাকি সদস্যরা। তবে আগেকার দিনে ছবি তুলতে গেলে বেশ কিছুক্ষণ সময় স্থির হয়ে দাড়িয়ে কিংবা বসে থাকতে হতো। না হলে একটু নড়াচাড়া করলেই ঝাপসা হয়ে যেত সেই ছবি। সেক্ষেত্রে বহু পূর্বের ছবি দেখলে বোঝা যায় যে তারা ভালো ফটো তোলার জন্যই সব সময় কঠোরভাবে দাঁড়িয়ে কিংবা কোন চেয়ারে বসে থাকতেন। সে ক্ষেত্রে মৃত মানুষের ছবি তোলা খুব সহজ হয়ে উঠেছিল কারণ তারা নড়াচড়া করত না। অনেক সময় দেখা গেছে যে মৃত শিশু কিংবা বয়স্কদের ছবি তোলা হতো মর্গ বা মৃত মানুষের কক্ষে। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতীর ছবি তোলা হত কফিনের ভেতরে।
কারণ তখনকার দিনের মানুষ এটা মনে করত যে মৃত সদস্যদের ফটোর মাধ্যমে তাদের প্রতিকৃতি না রাখলে একটা সময় হারিয়ে যাবে তারা। তাই নিজেদের পরিবারের মৃত সদস্যকে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম পদ্ধতি ছিল এই ফটোসেশন। আর এই পদ্ধতিকে বলা হত মিররস উইথ মেমোরিস। পরবর্তীতে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে ফটো তোলা হয়ে গেলে সেই ফটো বাঁধিয়ে বাড়ির একটি দেওয়ালে টানিয়ে রাখা হতো। আবার অনেকে নিজের পার্স, কেউ তার লকেট এবং আত্মীয়কে দিয়ে দিত। এই ফটো গুলোই ছিল তাদের কাছে মৃত ব্যক্তির শেষ স্মৃতি চিহ্ন। প্রথম থেকেই এই জিনিসটা ইংল্যান্ডে শুরু হলেও পরবর্তীতে সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধুমাত্র যে মৃত ব্যক্তির ফটো তুলে রাখা হতো তাই নয় মৃত ব্যক্তির সঙ্গে পরিবারের বাকি সদস্যরা একত্রিত হয়ে বা কোন সময় গ্রুপ ফটো তোলা হতো। তবে মৃত ব্যক্তিদের ফটো তোলার আগে তাদের সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হতো। প্রাপ্তবয়স্ক এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মৃতদেহগুলিকে চেয়ারে বসিয়ে ফটো তোলা হতো এবং শিশু হলে তাদের চেয়ার ও খেলনা সহকারে ফটো তোলা হতো।
তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে মৃতদেহগুলি ছবি তোলার সময় ফটোগ্রাফার এমন কায়দা অবলম্বন করতো যে ছবি দিয়ে মৃতদেহগুলিকে জীবন্ত বলেই মনে হতো। ভিক্টোরিয়ান যুগে মৃত ব্যক্তিদের ফটো তোলা একটা ফ্যাশনে পরিণত হলে ১৯৩০ এর দশকের পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এই পদ্ধতি বন্ধ হওয়ার পেছনে অনেকেরই অনুমান কালের পরিবর্তনে এবং সমাজ উন্নতির জন্য আজকালকার দিনের মানুষ এই ধরনের পন্থা অবলম্বন করেন না। আবার অনেকের কাছে এই পদ্ধতি ছিল বর্বরতা এবং অসুস্থতার প্রতীক।