অফবিট

কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের দ্বিচারিতা ও তার নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ার লাল সন্ত্রাস

কমিউনিজম বা সাম্যবাদ এমন এক মতাদর্শ যা কোনও দেশ বা কোনও জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। কমিউনিস্ট নেতারা প্রথমে সমাজের অবহেলিত, শোষিত মানুষদের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে মগজ ধোলাই করে। তারপর তাদের সাথে নিয়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলেই কমিউনিস্ট সরকার রীতিমতো স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। সমাজের যেসব পীড়িত মানুষ কমিউনিস্টদের সমর্থন দিয়েছিল ধীরে ধীরে তাদের অবস্থা পূর্বের তুলনায় আরও খারাপ হয়ে যায়। ইতিহাসে এমন অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতার উদাহারন রয়েছে যারা সাধারন মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করে নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসকে পরিনত হয়েছে। ইতিহাসের এমনই এক ক্রুর কমিউনিস্ট শাসক হচ্ছে সোভিয়েত রাশিয়ার ভ্লাদিমির লেনিন যার নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়াতে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়ে। 

রাশিয়ান বিদ্রোহ বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে রাশিয়ার ক্ষমতা থেকে জার নিকোলাস দ্বিতীয়কে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। রাশিয়ান বিদ্রোহের মাধ্যমে রাশিয়ায় রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে কম্যুনিজমের সূত্রপাত হয় যার নেতৃত্বে ছিল ভ্লাদিমির লেনিন। জার নিকোলাস দ্বিতীয়কে রাশিয়ায় ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ শাসক বলা হয় কারন তার শাসনে রাশিয়া জাপানের মতো ছোট দেশের কাছে পরাজিত হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও রাশিয়ান সেনাবাহিনী পরাজিত হচ্ছিল। 

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে রাশিয়ায় বিদ্রোহের মাধ্যমে জারের শাসনের অবসান হয় এবং অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এই সরকারও বেশী দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ওই বছরই অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব হয় যাকে অক্টোবর বিপ্লবও বলা হয়। রাশিয়ান বিদ্রোহে মূলত তিনটি দল ছিল বলশেভিক দল, মেনশেভিক দল এবং সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি। বলশেভিক দলের প্রধান ছিল ভ্লাদিমির লেনিন। বলশেভিক দল পেশাদার রাজনৈতিক সংগঠন ছিল যাদের লক্ষ্য ছিল শ্রমিক ও কৃষকদের সুরক্ষা। মেনশেভিক দলের বিশ্বাস ছিল রাশিয়ায় মানুষের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন তখনই সম্ভব যদি দেশে শিল্প কারখানা তৈরি হয়। মেনশেভিকরা মনে করতো দেশে কৃষকদের তুলনায় শ্রমিকদের সংখ্যা কম হওয়া প্রয়োজন অর্থাৎ মেনশেভিকদের শ্রমিকদের উপর বেশী লক্ষ্য ছিল। সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারিদের লক্ষ্য ছিল জারের শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাশিয়াকে একটি কৃষি প্রধান দেশে পরিনত করা। অর্থাৎ রাশিয়াতে মেনশেভিক ও সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি দলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ন বিপরীত ছিল। 

রাশিয়াতে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী- মার্চ মাসেই জারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও বলশেভিক বিদ্রোহ করা হয়েছিল শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের লোভে নাকী জনগনের স্বতস্ফুর্ত বিদ্রোহের কারনে এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিকদের দাবী বলশেভিকদের কাছে জনসমর্থন ছিল। সমাজের কৃষক, শ্রমিক মানুষদের পূর্ন সমর্থন ছিল বলশেভিকদের প্রতি। তাদের দাবী রাশিয়ার ৯৭টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১৬টি কেন্দ্রে বলশেভিকদের ক্ষমতার জন্য লড়াই করতে হয়, বাকী ৮১টি কেন্দ্রের মানুষ লেনিনের পক্ষে ছিল। কিন্তু পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের মতে বলশেভিকদের কাছে কোনও জনসমর্থন ছিলনা। বাকী দুটি দলের তুলনায় বলশেভিক দল অনেকবেশী সংঘটিত ছিল যার জন্য বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে নেয়। রাশিয়াতে জারের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষ বিদ্রোহ করেছিল কিন্ত পরিস্থিতির সুযোগ নেয় বলশেভিকরা এই বিদ্রোহকে তাদের নাম দেয়। ক্ষমতা দখলের পরেই লেনিন চিন্তাভাবনা শুরু করে কীভাবে ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি ধরে রাখা যায়। লেনিনের কাছে সমস্যা ছিল নির্বাচন করাতে হবে রাশিয়াতে কিন্তু তার জনসমর্থনও প্রয়োজন। এই জন্য লেনিন প্রথমে রাশিয়ার সমস্ত জমির জাতীয়করন করে যার মধ্যে উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের জমিও ছিল। তাদের কোনও ক্ষতিপূরনও দেওয়া হয়নি। লেনিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই সমস্ত জমি কৃষকদের মধ্যে ভাগ করে দেবে যাতে জন সমর্থন পাওয়া যায়। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য আট ঘন্টা কাজের আইনও করা হয়। কলকারখানা ও ব্যাঙ্ককেও জাতীয়করন করা হয়। লেনিন বিরোধী সমাচারপত্রও বন্ধ করে দেয়। কিন্ত এতসব সত্বেও নির্বাচনে ভ্লাদিমির লেনিনের বলশেভিক দল হেরে যায়। নির্বাচনে বলশেভিক দল সাতশো আসনের মধ্যে ১৭৫ আসন পায়। সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি ৩৭০ আসন পায় এই নির্বাচনে। অর্থাৎ রাশিয়ার নির্বাচনে সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি দল জয়লাভ করে এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরই সরকার গঠন করার অধিকার ছিল। কিন্তু ভ্লাদিমির লেনিন ক্ষমতা লোভী ছিল। লেনিন কখনও চায়নি সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি সরকার গঠন করে। এইজন্য লেনিন ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে আটকানোর জন্য লেনিনের রেড আর্মি নির্বাচনের ফলকে মানতে অস্বীকার করে জোর করে ক্ষমতা দখল করে। যার জন্য বিরোধীদের সাথে রীতিমতো সহিংস গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই সময় লেনিনের কাছে আরও একটি সমস্যা ছিল যেভাবেই হোক রাশিয়াকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বের করে আনা কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারনে রাশিয়ার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল। লেনিন জার্মানির সাথে আলোচনা শুরু করে শান্তিচুক্তির জন্য। ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ সোভিয়েত রাশিয়া ও কেন্দ্রীয় শক্তি অর্থাৎ জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়ার সাথে ব্রেস্ট-লিটোভস্ক চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরে আসে। তবে বেলারুশের ব্রেস্ট শহরে হওয়া এই চুক্তির ভারী মূল্য দিতে হয় সোভিয়েত রাশিয়াকে। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়াকে ইউক্রেন, পোল্যান্ড, বেলারুশ, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটাভিয়া, ফিনল্যান্ড এবং ককেশাস অঞ্চলের বড় অংশের নিয়ন্ত্রন হারাতে হয়। এই চুক্তির কারনে সোভিয়েত রাশিয়ার ৩৪ শতাংশ জমি, ৮৯ শতাংশ কয়াল খনি অঞ্চল, ৫৪ শতাংশ শিল্পাঞ্চল এবং ২৬ শতাংশ রেলওয়ে কেন্দ্রীয় শক্তির কাছে চলে যায়। যার জন্য গোটা দেশে ভ্লাদিমির লেনিনের তীব্র সমালোচনা হয়।

শান্তি চুক্তির পর লেনিনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে এক বক্তৃতায় লেনিন জানিয়েছিল ফরাসী বিপ্লবের মতো রাশিয়াতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হবেনা। ফরাসী বিপ্লবের গিলোটিনে বহু মানুষকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা, লেনিন এর বিরোধী ছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের জন্য লেনিনের নৃশংসতা ফরাসী বিপ্লবের নৃশংসতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে পেত্রোগ্রাদ ও মস্কো লেনিনের রেড আর্মির অধীনে চলে যায়। বর্তমানে সেন্ট পিটাসবার্গই অতীতের পেত্রোগ্রাদ শহর। সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি দল পেত্রোগ্রাদ শহর ছেড়ে ভলগা নদীর তীরে চলে যায় এবং একটি সরকার গঠন করে। কিন্তু লেনিন বলশেভিক ছাড়া অন্যকোনও দলকে রাশিয়ার ক্ষমতা দিতে নারাজ ছিল। যার জন্য রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সমগ্র রাশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। রেড আর্মি ছাড়া লেনিন গুপ্ত হত্যা ও নজর রাখার জন্য চেকা নামে গোপন পুলিশ বাহিনীও গঠন করে। জানুয়ারি, ১৯১৮ সালে মস্কো ও পেত্রাগ্রাদের মতোন বড় শহরে ফসলের অভাব দেখা দেয়। লেনিন এই পরিস্থিতির জন্য উচ্চবর্গের কৃষকদের কালোবাজারিকে দায়ী করে এবং গোপনে তাদের হত্যার আদেশ দেয়। 

১৯১৯ সালের মধ্যে লেনিনের গুপ্ত পুলিশ বাহিনী চেকা প্রায় ১৩,০০০ কৃষককে হত্যা করে, তাদের ফসলও দখল করে নেয় রেড আর্মি। যদিও এটা সরকারি হিসাব, বেসরকারি মতে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী। এর পাশপাশি সোশ্যাল রেভোলিউশ্যোনারি দলের বহু নেতা, সদস্য এবং লেনিন বিরোধীদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়। বহু নির্দোষ ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়। রাশিয়ার এইসব ঘটনাকে রেড টেরর বা লাল সন্ত্রাসও বলা হয়। রাশিয়ায় লাল সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের দ্বারা জার নিকোলাস দ্বিতীয় ও তার পরিবারকে নৃশংস ভাবে হত্যা। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে মেনশেভিক, জারের অনুগামী সহ বহু সাধারন মানুষও অস্ত্র তুলে নিয়েছিল এদের হোয়াইট বলা হত। তবে সময়ের সাথে রেড আর্মির নৃশংসতার কাছে ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে হোয়াইটরা এবং ১৯২৩ সালে লেনিনের নেতৃত্বে রেড আর্মি জয়লাভ করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট দেশ তৈরি হয়। 

১৯১৭ সাল থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত চলা এই গৃহযুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের থেকেও বেশী সময় ধরে হয়েছিল। এই গৃহযুদ্ধে অন্তত সাত মিলিয়ন বা সত্তর লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পরেও রাশিয়াতে খাদ্য সমস্যা দেখা দেয় কারন কৃষকরা বেশী চাষ করতেই চাইছিলোনা। কৃষকের দাবী ছিল তারা বেশী শস্য উৎপাদন করলে রেড আর্মি কালোবাজারে নামে তাদের খাদ্যশস্য বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ক্ষমতা দখলের পরেও লেনিন তার দমননীতি অব্যাহত রাখে। আসলে কমিউনিজমের মূল ভিত্তিই হচ্ছে অত্যাচার করে, হত্যা করে যেভাবেই হোক ক্ষমতার কেন্দ্র থাকে। যদিও বেশীদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন শাসন করতে পারেনি লেনিন, কারন ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে তার মৃত্যু হয়। তবে ভ্লাদিমির লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের অত্যাচার কালো অধ্যায় শুরু হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *