অফবিট

মহাদেবের মাথায় কিভাবে আসল অর্ধচন্দ্র?

দেবাদিদেব মহাদেব যাকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সংহারকর্তা বলা হয়। তাঁর পরনে থাকে বাঘের ছাল, মাথায় থাকে গঙ্গা ও অর্ধচন্দ্র এবং হাতে থাকে ত্রিশূল ও ত্রিশূলে জড়ানো ডমরু, ত্রিনয়ন, ও রুদ্রাক্ষ। কিন্তু কেন দেবাদিদেব মহাদেব এইরকম বেশ ধারণ করেছিলেন? কি বলছে পুরাণ?

মস্তকে চন্দ্র কেন?

মহাদেবের মাথায় কিভাবে স্থান পেল অর্ধচন্দ্র? এই নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে। 

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ব্রহ্মাপুত্র প্রজাপতি দক্ষের মোট ৬০টি কন্যা সন্তান ছিল। তার কন্যা সন্তানগুলির মধ্যে তিনি ২৭ জন কন্যার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন চন্দ্রদেবের সাথে। চন্দ্রদেব ২৭ জন কন্যকে বিবাহ করলেও তাঁদের মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল রোহিণী। যার ফলে রোহিনীকে ব্রহ্মাপুত্র প্রজাপতি দক্ষের বাকি কন্যারা ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একদিন তাঁরা একত্রিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তার পিতা দক্ষের কাছে। তাঁরা বলেন যে তাঁদের সাথে চন্দ্রদেব ভাল ব্যবহার করেন না। দক্ষ তাঁর কন্যাদের কথা শুনে চন্দ্রদেবের উপর ক্রোধিত হয়ে যান। যার ফলে তিনি চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দেন ক্ষয় হয়ে যাওয়ার। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তখন চন্দ্রদেব মহাদেবের কঠোর তপস্যা করেন। মহাদেব চন্দ্রদেবের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে তাঁকে অভিশাপ থেকে মুক্তির আশীর্বাদ দেন এবং তাঁকে  নিজের মস্তকে ধারণ করেন।

অন্য আরেকটি কাহিনী অনুযায়ী, যখন সমুদ্র মন্থন হয়েছিল সেই সময় অমৃতের সাথে উঠে এসেছিল বিষ। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচানোর জন্য সেই বিষ মহাদেব নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। নিজের কণ্ঠে নীল বিষ ধারণ করেছিলেন বলেই তাঁর অপর একটি নাম হল নীলকণ্ঠ। এই তীব্র বিষের প্রভাবে মহাদেবের শরীরের তাপমাত্রা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। সেই সময় তাপ হ্রাস করতেই মহাদেব তাঁর মাথায় ধারণ করেছিলেন চন্দ্রকে। 

জটায় স্থান পেলেন গঙ্গা

রাজা ভগীরথ নিজের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তির জন্য ভগবান ব্রহ্মা এবং ভগবান বিষ্ণুর পরামর্শ অনুযায়ী দেবী গঙ্গার তপস্যা করেন। ভগীরথের এই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী গঙ্গা তাঁকে দর্শন দিলে দেবী গঙ্গাকে পৃথিবীতে নেমে আসার জন্য তিনি প্রার্থনা করেন। তখন দেবী গঙ্গা তাঁর সাথে প্রস্থান করতে রাজী হন, তবে জানান যে তিনি পৃথিবীতে অবতরিত হলে তাঁর প্রচণ্ড স্রোত এই পৃথিবী সহ্য করতে পারবে না। এই শুনে ভগীরথ তাঁর সাহায্যের জন্য মহাদেবের তপস্যা করেন। মহাদেব তাঁর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে গঙ্গাকে নিজের জটায় ধারণ করে তাঁর বেগ নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীতে পাঠান।

হাতে ত্রিশূল

ত্রিশূল মহাদেবের হাতে সব সময় থাকে। মনে করা হয় যে সৃষ্টির জন্মের সময় যখন শিবের উদ্ভব হয়েছিল, সেই সময় দেবাদিদেব মহাদেবের সাথে জন্ম হয় রজ, তম ও তস নামক তিনটি গুণের। আর এই তিনটি গুণ সমাহিত রয়েছে ত্রিশূলে। মনে করা হয় ত্রিশূলের তিনটি অংশ হল জন্ম, পালন ও মৃত্যুর সূচক।

গলায় সাপ

সমুদ্র মন্থনের সময় দড়ি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল নাগরাজ বাসুকীকে। নাগরাজ বাসুকী ছিলেন শিবের পরম ভক্ত। একদিকে দেবতা এবং অন্য দিকে অসুররা বাসুকী নাগকে ধরে সমুদ্র মন্থন করে। যার ফলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান বাসুকী নাগ। নাগরাজ বাসুকীর ভক্তিতে দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হয়ে তাঁকে নিজের গলায় ধারণ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

বাঘের ছাল

পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, ভগবান বিষ্ণু নরসিংহ অবতারে হিরণ্যকশ্যপের বধ করার পরও তার ক্রোধ শান্ত হয় না। যার ফলে ভগবান শিব শরভ অবতার ধারণ করে নরসিংহের সাথে যুদ্ধ করে এবং তাঁকে শান্ত করেন। এরপর এই অবতার শরীর ত্যাগ করার সময় তাঁর চামড়াকে আসন হিসেবে গ্রহণ করার আবেদন করেন। তারপর থেকেই দেবাদিদেব মহাদেব বাঘের ছালের ওপর অধিষ্ঠিত। এমন কি তিনি এই ছালই পরিধান করেন। 

মহাদেবের এই বাঘের চামড়া পরিধান করার পেছনে প্রচলিত রয়েছে অন্য আরেকটি পৌরাণিক কাহিনী। সেই কাহিনী অনুযায়ী, মহাদেব একবার হাঁটতে হাঁটতে একটি বনে গিয়েছিলেন। এবং সেই বনেই বসবাস করতেন কয়েকজন ঋষি তাদের পরিবার সহকারে। শিব ওই বনের মধ্যেই জঙ্গলে ঘোরাফেরা করছিলেন কিন্তু তার পরনে কোনও পোশাক ছিল না। আর শিবের রূপ পুরুষালি চেহারা দেখে সেখানকার ঋষিদের স্ত্রীরা মুগ্ধ হয়ে পড়েন। এবং শিবের সুন্দর চেহারার প্রতি দুর্বল এবং আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন ঋষিদের স্ত্রীরা। এটি জেনে ঋষিরা ক্রুদ্ধ হয়ে যান এবং তারা শিবকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে,ওই বনের ঋষিরা মহাদেব শিবের ভ্রমণের পথে একটা বড় গর্ত খুঁড়লেন এবং তাতে একটি বাঘও ছেড়ে রাখলেন। তারপর মহাদেব ওই গর্তের মধ্যে পড়ে যান। তারপর মহাদেব ওই গর্তে থাকা বাঘটিকে হত্যা করেন এবং বাঘের ছাল পরিধান করেন।

আর তখন থেকেই তিনি কেবলমাত্র বাঘের ছাল পড়ে থাকেন। এইসব দেখে ঋষিরা বুঝতে পারেন যে তিনি হলেন দেবাদিদেব মহাদেব এবং তারপর ঋষিরা শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বলা হয় যে এরপর থেকে দেবাদিদেব মহাদেবের পরনে থাকে বাঘের ছাল। আর এই বাঘের ছাল হল শক্তির প্রতীক।

ডমরু

সৃষ্টির সূচনা কালে যখন সরস্বতী উৎপন্ন হয়, তখন জন্ম হয়েছিল বীণার স্বরে সৃষ্টি ধ্বনির। তবে এই সুর ও সঙ্গীত ছাড়া ছিল এই ধ্বনি। ওই সময় নৃত্যরত মহাদেব ১৪ বার ডমরু বাজান।  এই ধ্বনি দিয়ে ব্যাকারণ এবং সঙ্গীতের ছন্দ, তালের জন্ম হয়। আর এইভাবে উৎপত্তি হয় শিবের ডমরুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *