ইভেন্টবনেদী বাড়ি এবং গ্রাম বাংলার পূজা

২২৪ বছর পরেও রায় পরিবারে একই নিয়ম মেনে আরাধনা হয় দেবী দূর্গার। পুজোর আসল দামামা বেজে ওঠে জন্মাষ্টমীর দিন

সূচনা হয়েছিল ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে, তারপর কেটে গিয়েছে ২২৪ বছর। কিন্তু এখনও একই ধারা মেনে পুজো হয়ে আসছে এই পরিবারে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের জারা গ্রামের রায় পরিবারের দূর্গাপুজো এবার ২২৫ বছরে পদার্পণ করল। আসলে রায় হলো তাদের পরিবারের পাওয়া উপাধি, কিন্তু এই পরিবারের আসল পদবী গঙ্গোপাধ্যায়। মাঝে কেটে গিয়েছে ২২৪ বছর। তাও একই ভাবে অমলিন হয়ে আছে এই বাড়ির দূর্গাপুজো। 

১৭৯৮ সালে জারা রায় রাজবংশের রাজীব লোচন রায় এই পুজো শুরু করেছিলেন। সেই যে শুরু হয়েছিল আজ পর্যন্ত কোনও বাধা বিপত্তি, মৃত্যু, শোক কিছুই এই পুজোকে আটকাতে পারেনি। পরিবার, আত্মীয়ের সাহায্যে প্রতি বছরই সাড়ম্বরে দূর্গাপুজো হয়ে আসছে। যদিও রাজীব লোচন রায়ের দাদু ছিলেন কালীর উপাসক, কিন্তু তিনি শুরু করেছিলেন দূর্গাপুজো। এখন এই রায় পরিবারে দুই দেবীর পুজোই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

পঞ্চমীর ভোর থেকে এই পুজোর সূচনা হয় নহবত সুরের মাধ্যমে। মন্দির প্রাঙ্গণ সেজে ওঠে আলপনা, এবং অন্যান্য জিনিসে। তবে পুজোর আসল দামামা বেজে ওঠে জন্মাষ্টমীর দিন। এদিন মূল দূর্গা মণ্ডপে গণেশের প্রতীকী হাত নির্মাণের মাধ্যমে শুরু করা হয় দেবীমূর্তি তৈরির কাজ। প্রথমে বানানো হয় খড়ের কাঠামো, তার উপর দেওয়া হয় দুই প্রলেপ মাটি। এরপর রঙ আর চক্ষুদানের মধ্যে দিয়ে দেবী সপরিবারে সেজে ওঠেন। আগে যদিও গ্রামের শিল্পীরাই মূর্তি তৈরি করতেন, এখন বাইরে থেকে শিল্পী আনা হয়ে থাকে। একচালা মাতৃমূর্তি হয় এই পরিবারে। দেবীর ডান পা থাকে সিংহের গায়ে, এবং বাম পা থাকে অসুরের গায়ে। ত্রিশূল থাকে মহিষাসুরের বুকে বাঁধানো। দেবীর গোটা পরিবারের সঙ্গে থাকেন জয়া এবং বিজয়া।

জারা রায় পরিবারের পুজো হয় বৈষ্ণব মতে এবং কালিকা উপপুরানের শাস্ত্রীয় বিধি মেনে। ষষ্ঠীর সকালে বংশের কোনো বয়স্ক পুরুষের নামে প্রথম সংকল্প হলেও পরের সংকল্পের অধিকার দেওয়া হয় পুরোহিতকে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর বোধন এবং অধিবাস হয়। এরপর একে একে পালিত হয় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং দশমীর নানান আচার, অনুষ্ঠান। বাড়ির মহিলারাই সমস্ত ভোগ, নাড়ু, ইত্যাদি বানিয়ে থাকেন। দশমীতে দেবীর বিসর্জন হয় এই পরিবারের সদর পুকুরঘাটে।

এই পুজো যেহেতু বৈষ্ণব মতে অনুষ্ঠিত হয় সেহেতু এখানে বলির কোনো প্রথা নেই। তবে পুজোর বৈদিক ভোগে দেবীকে দেওয়া হয় খিচুড়ি সহ ১১ রকমের ভাজা। অন্যদিকে রাজসিক ভোগে দেওয়া হয় সাদা ভাত সহ ১১ রকম ভাজা, লাউঘন্ট, শাক, শুক্ত, পায়েস, ইত্যাদি। ষষ্ঠীতে একটি থালায় এবং সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ভোগ ১৭টি থালায় দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রতিটা ভোগ তৈরি করেন বাড়ির মেয়ে, বউরা। আগে পুজোর সময় রোজ যাত্রা হতো। কিন্তু এখন তার বদলে বাড়ির সকলে মিলে নানান ধরনের বিচাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। চারদিন পরিবারের সকলে মিলে হইহই করে আনন্দ করে পুজোয় সামিল হন। পুজোর একদিন করা হয় নরনারায়ণ সেবা, আরেকদিন গোটা গ্রামের বাসিন্দাদের ভোগ খাওয়ানো হয়ে থাকে।

আমরা অনেকেই পুজোর সময় পল্লী গ্রামের পুজো দেখতে চাই, তার সঙ্গে যদি ইতিহাস আর বনেদিয়ানা জুড়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। এবার যদি আপনার এরকম কোনো প্ল্যান থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই একবার এই জারা রায় বংশের পুজো দেখে আসবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *