অফবিট

আমেরিকা, রাশিয়াকে ছেড়ে কেন ফ্রান্সের থেকেই যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিন ক্রয়?

ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্রান্সের থেকে তিনটি স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিন ও ২৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনতে চলেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করবার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী দ্রুত এই সাবমেরিন ও রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনতে চাইছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর আইএনএস ভিক্রান্ত ও আইএনএস বিক্রমাদিত্যে রাশিয়ান মিগ ২৯কে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়, যা ২০৩০ এর মধ্যে অবসরে যেতে পারে। সুতরাং খুব শীঘ্রই মিগ ২৯কে এর বিকল্প যুদ্ধবিমান দরকার ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর। এই মহূর্তে ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে ৪২ টি মিগ ২৯কে রয়েছে। দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ৩৬ টি করে ৭২ টি এয়ারক্রাফট থাকতে পারে। যার মধ্যে ২৬ টি করে ৫২ টি যুদ্ধবিমান বাকী কুড়িটি রাশিয়ান কামোভ কে ৩১ বা কে ২৮ হেলিকপ্টার এবং সদ্য কেনা আমেরিকান এমএইচ ৬০ রোমিও অ্যান্টি সাবমেরিন হেলিকপ্টার থাকতে পারে। সুতরাং এই হিসাবে দেখতে গেলে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের জন্য প্রয়োজনীয় মিগ ২৯কে নেই ভারতের কাছে। চীন ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী থাকার কারনে ভারতীয় নৌবাহিনী দ্রুত এই শূন্যস্থান পূরন করতে চাইছে।

প্রাথমিক ভাবে ২৬ টি রাফায়েল এম, যা নৌবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি, যুদ্ধবিমান কেনা হবে যার মধ্যে ২২ টি রাফায়েল এম এক আসন বিশিষ্ট এবং বাকী চারটি প্রশিক্ষন বিমান যা প্রয়োজনে যুদ্ধপযোগী করা সম্ভব। এর আগেও ভারতীয় বায়ুসেনা ফ্রান্স থেকে ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনেছে, যার সবকটিই ফ্রান্স ভারতকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুতরাং রাফায়েল ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। মোট ৯০,০০০ কোটি টাকার মূল্যে এই চুক্তি হবে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে। তবে চুক্তির সঠিক মূল্যের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে ইতিমধ্যেই আলোচনা চলছে। 

ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্রান্সের স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন আগে থেকেই ব্যবহার করে। ভারত প্রজেক্ট ৭৫ এর আওতায় ফ্রান্সের থেকে ৪.২ বিলিয়ন ডলার বা ২৩,৬৫২ কোটি টাকার মূল্যে ছয়টি স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন কিনেছে। এক একটি স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিনের দাম প্রায় ৭১০ মিলিয়ন ডলার বা ৩,৯৪২ কোটি টাকা। মুম্বাইয়ের মাজাগাঁও ডক লিমিটেডে এগুলি তৈরি হয়েছে। ভারতে এই স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিনকে কালভেরী শ্রেনীর সাবমেরিন বলা হয়। স্করপিয়ান ক্লাস সাবমেরিনকে ফ্রান্সের তৈরি বলা হলেও এটি তৈরিতে ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপ ও স্পেনের নাভানতিয়া উভয়েই যুক্ত ছিল। কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক এই সাবমেরিন একটানা ৫০ দিন অপারেশনাল থাকতে সক্ষম। এই শ্রেনীর সাবমেরিনের সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১২,০০০ কিলোমিটার। এই সাবমেরিনে ইটালির বিখ্যাত প্রতিরক্ষা সংস্থা লিওনার্দোর তৈরি সি ৩০৩/এস অ্যান্টি টর্পেডো সিস্টেম রয়েছে যা এই সাবমেরিনকে আরও শক্তিশালী করেছে। ২২১ ফুট লম্বা ও ৪৩ জন ক্রু বহনে সক্ষম এই সাবমেরিন সমুদ্রের ৩৫০ মিটার গভীরতা অবধি যেতে সক্ষম। একটি কালভেরী শ্রেনীর সাবমেরিনের সর্বোচ্চ গতি ২০ নটস বা ৩৭ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। 

ভারতের স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন গুলোর প্রতিটিতে ছয়টি ৫৩৩ মিলিমিটার টর্পেডো টিউব রয়েছে যার প্রতিটিতে তিনটি করে মোট ১৮ টি এসইউটি টর্পেডো রয়েছে। টর্পেডো টিউবে টর্পেডোর বদলে ত্রিশটি করে মাইন বহন করাও সম্ভব। এই এসইউটি টর্পেডো জার্মানির এটলাস ইলেকট্রনিকের তৈরি যার সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩০ কিলোমিটার। এছাড়াও ফ্রান্সের তৈরি ৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের এসএম ৩৯ এক্সোয়েট অ্যান্টিশিপ মিসাইল রয়েছে স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিনে। ভবিষ্যতে এই সাবমেরিনে ফ্রান্সের এথ্রিএসএম মিকা অ্যান্টি এয়ার মিসাইল ইনস্টল করা যাবে। এই মিকা অ্যান্টি এয়ার মিসাইল ইতিমধ্যেই ফ্রান্সের বিখ্যাত বারকুডা শ্রেনীর পরমানু সাবমেরিনে ইনস্টল করা হয়েছে। তবে ভারতের স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিনে ব্রাহ্মস মিসাইল ইনস্টল করা সম্ভব নয়। বর্তমানে অতিরিক্ত যে তিনটি স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন চুক্তি হতে চলেছে এগুলো কেনার কথা ২০১৫ সালেই ঠিক হয়েছিল। মাজাগাঁও ডকেই এগুলো তৈরি হবে। এই তিনটি সাবমেরিন কিনতে খরচা হবে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬,০০০ কোটি টাকা। এই নতুন তিনটি সাবমেরিনে এআইপি বা এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালশন সিস্টেম থাকবে যা সাবমেরিনকে আরও বেশীদিন জলের তলায় থাকতে সাহায্য করবে। নতুন তিনটি স্করপিয়ান আগের ছয়টি সাবমেরিনের তুলনায় আরও বেশী আধুনিক হবে এবং এতে ফ্রান্সের সুপার স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিনের অনেক বৈশিষ্ট্য। আগের ছয়টি কালভেরী শ্রেনীর সাবমেরিনকে ধাপে ধাপে আধুনিক করা হবে এবং এগুলোতেও এআইপি সিস্টেম যুক্ত করা হবে। ভারতের কাছে এই মহূর্তে আইএনএস কালভেরী, আইএনএস খান্ডেরী, আইএনএস কর্নজ, আইএনএস ভেলা, আইএনএস ভাগির, আইএনএস ভাগশির এই ছয়টি স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন রয়েছে। স্করপিয়ান শ্রেনীর শেষ সাবমেরিন আইএনএস ভাগশির ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল সী ট্রায়ালে গেছে, আগামী ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এটি ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রজেক্ট পি ৭৫ এ মোট নয়টি স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিন আসতে চলেছে ভারতীয় নৌবাহিনীতে। এই কালভেরী শ্রেনীর সাবমেরিন গুলো ভারতের রাশিয়ান কিলো বা সিন্ধুঘোষ শ্রেনীর সাবমেরিন এবং জার্মানির টাইপ ২০৯ বা শিশুমার শ্রেনীর সাবমেরিনকে রিপ্লেস করবে। প্রজেক্ট পি ৭৫ ছাড়াও ভারতীয় নৌবাহিনী পি ৭৫ আই বা ইন্ডিয়া নামেও একটি প্রজেক্ট শুরু করেছে যাতে আরও ছয়টি কনভেনশনাল ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন কেনা হবে। ছয় বিলিয়ন ডলার মূল্যে ছয়টি সাবমেরিন কেনা হবে। 

ভারতে এল এন্ড টি ও মাজাগাঁও ডক লিমিটেডের মধ্যে যেকোনও একটি সংস্থা এই সাবমেরিন তৈরি করবে কোন বিদেশী সংস্থার থেকে প্রযুক্তি নিয়ে। রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, দক্ষিন কোরিয়া, স্পেনের বড় বড় সংস্থার নাম থাকলেও শেষপর্যন্ত স্পেন ও জার্মানির মধ্যে কোনও একটি দেশের সাথেই এই প্রজেক্ট হবার সম্ভবনা রয়েছে। জার্মানি তাদের টাইপ ২১২ এবং স্পেন এস ৮০ সাবমেরিনের প্রস্তাব দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীকে।

প্রথমে মনে করা হচ্ছিল পি ৭৫ এর মতোন হয়ত ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপই তাদের সুপার স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিনের জন্য এই টেন্ডার জিতবে কারন মাজাগাঁও ডক লিমিটেড ইতিমধ্যেই স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন তৈরি করছে। তবে নেভাল গ্রুপ জানিয়ে দিয়েছে তারা এই প্রজেক্ট থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে কারন তাদের কাছে আধুনিক এআইপি সিস্টেম নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে স্পেনের এস ৮০ শ্রেনীর সাবমেরিন নির্মাতা হচ্ছে নাভানতিয়া গ্রুপ যারা স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন তৈরিরও যৌথ সাথী ফ্রান্সের নেভাল গ্রুপের। মাজগাঁও ডক লিমিটেডে স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন তৈরির ব্যাপারে নাভানতিয়া গ্রুপ সহায়তা করেছিল। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে পি ৭৫ আই টেন্ডার জেতার সুযোগ এস ৮০ এরই বেশী। ইতিমধ্যেই গত ১০ জুলাই দিল্লিতে স্পেনের দূতাবাসে এল এন্ড টি এবং নাভানতিয়া গ্রুপের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে ভারতে এস ৮০ সাবমেরিন তৈরির ব্যাপারে। এদিকে পাকিস্তানও চীনের থেকে আটটি হাঙ্গর শ্রেনীর সাবমেরিন কিনছে যা চীনের টাইপ ০৩৯এ/০৪১ এর এক্সপোর্ট ভার্সন। 

২০২৮ এর মধ্যে এগুলো ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে৷ এই সাবমেরিন গুলোর প্রতিটিতে এআইপি সিস্টেম রয়েছে। শুধু এআইপি সিস্টেম বাদ দিলে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে ভারতের স্করপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন অনেক বেশী আধুনিক এবং এতে ব্যবহৃত টর্পেডো ও মিসাইল পাকিস্তানকে দেওয়া চীনের মিসাইলের থেকে আধুনিক। বিশেষ করে স্টেলথ বৈশিষ্ট্যের বিচারে স্কপিয়ান শ্রেনীর সাবমেরিন পাকিস্তানের যেকোনও সাবমেরিনের থেকে এগিয়ে থাকবে। তবে ২০৩০ সাল আসতে আসতে ভারতের কাছে এআইপি সিস্টেম যুক্ত নয়টি স্করপিয়ান এবং অজানা সংখ্যক নিউক্লিয়ার এসএসবিএন, এসএসএন সাবমেরিন থাকবে এবং পি ৭৫ আই সাবমেরিনও যুক্ত হওয়া শুরু হয়ে যাবে। ভারতীয় নৌবাহিনীর যে দ্রুত গতিতে আধুনিকরন হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনী অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *