চীনের জন্য সাক্ষাৎ নরক ছিল জাপানের অত্যাচার। ন্যানকিং হত্যাকাণ্ড জানা আছে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইতালি একটি জোট গঠন করেছিল যাকে বলা হত অক্ষশক্তি, অন্যদিকে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জোটকে বলা হত মিত্রশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উভয়পক্ষই ভিন্ন ভিন্ন সামরিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করছিলো। বহু গোপন প্রজেক্ট শুরু করা হয় এইসময়। জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা অ্যাডলফ হিটলারের নাজি জার্মান সেনা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য শত্রুদের বিশেষ করে ইহুদিদের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা করতে শুরু করেছিল। এসমস্ত পরীক্ষা অত্যন্ত নৃশংস ছিল যাতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু হত। শুধু জার্মানি নয় জাপানও মানুষের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা করা শুরু করেছিল এসময়। ইউনিট ৭৩১ নামে জাপানের একটি বিশেষ পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল যেখানে মানুষের উপর পরীক্ষা করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নাজি সেনা ও জাপানের এসব নারকীয় পরীক্ষার কথা জানা যায়। এই জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস সেনা বলা হত অক্ষশক্তির জাপান ও জার্মানির সেনাবাহিনীকে।
উনবিংশ শতক এবং বিংশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত চীনের উপর মারাত্মক অত্যাচার করা হয়েছে বিদেশীদের দ্বারা। এসময় চীন সমস্ত যুদ্ধে পরাজিত হয়। চীনে প্রথমে আফিমের নেশা ধরায় ব্রিটিশরা এবং প্রথম ও দ্বিতীয় আফিমের যুদ্ধে চীনের পরাজয় হয়। এরপর জাপান ক্রমাগত চীন আক্রমন করে। জাপানি সেনাবাহিনী চীনে যে বর্বরতা করেছিল তার কোনও তুলনাই যথেষ্ট নয়। চীনে জাপানি নৃশংসতার একটি বড় উদাহারন ইউনিট ৭৩১ যা চীনের মানুষদের জন্য সাক্ষাৎ নরক ছিল। ইউনিট ৭৩১ বা ডিটাচমেন্ট ৭৩১ ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বিশাল একটি এলাকা যেখানে ১৫০টির বেশী বাড়ি ছিল। এই এলাকাকে ক্যামো ডিটাচমেন্ট ও ইশিই ইউনিটও বলা হত। জাপানি সেনাবাহিনী এখানে জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের পরীক্ষা করতো। এখানে মানুষের মধ্যে টাইফয়েড, গনোরিয়ার মতোন বিভিন্ন ধরনের রোগের জীবানু প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হত।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় সিনো জাপান যুদ্ধের সময় এটি তৈরি করা হয়। জাপানের মানচুকুও শহরের হারবিন জেলার পিংফ্যাং অঞ্চলে এই ইউনিট ৭৩১ তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে এই এলাকা উত্তরপূর্ব চীনের অংশ। ইউনিট ৭৩১ এর বিভিন্ন অংশ সেসময় চীন ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতেও ছিল। ১৯৩০ সাল থেকেই জাপান জৈবিক অস্ত্র তৈরির প্রজেক্ট শুরু করে, তবে জাপান এই প্রজেক্ট অত্যন্ত গোপনে শুরু করে কারন ১৯২৫ সালে জেনেভা চুক্তিতে জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
জাপান ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশ দখল করে নেয়। এখানেই জৈবিক অস্ত্র তৈরির কেন্দ্র তৈরি করে জাপান। মাঞ্চুরিয়াতে কেন্দ্র তৈরি করা হয় কারন এই এলাকা জপাানের মূল ভূখন্ড থেকে দূরে ছিল যার কারনে এখানে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেও তার প্রভাব জাপানে পড়তো না এবং এই এলকার চাইনিজ নাগরিকদের সহজেই পরীক্ষাগারে ব্যবহার করা যেত। ১৯৩২ সালে জাপানি সেনাবাহিনীর সার্জেন জেনারেল শিরো ইশিইকে জাপান তাদের আর্মি এপিডেমিক প্রিভেনশন রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা এইপিআরএলের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। সার্জেন শিরোর প্রধান সহযোগী ছিল কর্নেল চিকাহিকো কোইজুমি।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কোইজুমি জাপানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিল। এই কোইজুমি ১৯১৫ সালে একটি বিষাক্ত গ্যাস তৈরির গোপন প্রজেক্টে যুক্ত ছিল। এই প্রজেক্টে বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস তৈরি করা হয়। জার্মানরা এই বিষাক্ত গ্যাস বেলজিয়ামে মিত্রশক্তির উপর প্রয়োগ করে যাতে ৫০০০ সেনার মৃত্যু হয় এবং ১৫,০০০ লোক আহত হয়। ১৯৩৬ সালে জাপানের শাসক হিরোহিতো একটি বিশেষ পরীক্ষা বিভাগ তৈরির নির্দেশ দেয় যা জাপানি সেনাবাহিনীর কাওয়ানতুং বিভাগের সাথে যুক্ত করা হয়। কাওয়ানতুং বিভাগ জাপানে মহামারী নিয়ন্ত্রনের জন্য কাজ করতো।
১৯৪০ সালে ইউনিট ৭৩১ তৈরি করা হয়, এছাড়াও ইউনিট ১০০, ইউনিট ৫১৬ নামে আরও কয়েকটি বিভাগ তৈরি করা হয় এখানে। ইউনিট ৭৩১ এ মারুতা নামের একটি বিশেষ প্রজেক্ট শুরু করা হয় যাতে মানুষের শরীরকে পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়। এখানে যেসব নৃশংস পরীক্ষা করা হয় তার একটা উদাহারন আমেরিকার ঐতিহাসিকবিদ শেলডন এইচ হ্যারিসের বক্তব্য থেকে জানা যায়। শেল্ডন এইচ হ্যারিস জানান এখানে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ সংরক্ষনের জন্য কাজ করা হত। যদি ডঃ ইশির মানুষের মাথার উপর পরীক্ষার দরকার হত তাহলে জেল থেকে একজন বন্দীকে নিয়ে আসা হত। একজন রক্ষী সেই বন্দীটিকে ধরে রাখতো এবং অন্য একজন রক্ষী বন্দীর মাথা একটি কুঠারের সাহায্যে ভেঙে দিত, এরপর সেই বন্দীর মাথার ভিতরের অংশ সংরক্ষন করা হত এবং বাকী শরীর ফেলে দেওয়া হত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা এক অধ্যাপক নাকাগাওয়া ইয়োনেজো পরে জানান ইউনিট ৭৩১ এ এমন সব পরীক্ষা হত যার সাথে রোগ নিরাময় ও উন্নত ঔষুধ তৈরির কোন সম্পর্কই ছিলনা, এসব পরীক্ষা শুধু কৌতুহল বশত করা হত যাতে বহু মানুষের মৃত্যু হত। তিনি আরও জানান এখানে বন্দীদের শরীরে দুরারোগ্য রোগের জীবানু প্রবেশ করিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির জন্যও কাজ করা হত। ইউনিট ৭৩১ এ হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চাকে ভিভিশন করা হয়। ভিভিশনের অর্থ জীবন্ত মানুষের শরীর কেটে তার ভিতরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষকে অজ্ঞান না করেই ভিভিশন করা হত যা সবচেয়ে বেশী যন্ত্রনাদায়ক ছিল। বন্দীদের শরীরে রোগের জীবানু প্রবেশ করিয়ে সেই জীবানু শরীরে কেমন প্রভাব ফেলে তা পরীক্ষার জন্য ভিভিশন করা হত। রক্ত পরীক্ষার জন্য অনেক সময় বন্দীদের অঙ্গচ্ছেদন করা হত। বন্দীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন পাকস্থলী, ফুসফুস, মাথা, লিভার কেটে নিয়ে পরীক্ষার করা হত ইউনিট ৭৩১ এ।
জাপানি সেনাবাহিনীর সার্জেন কেন ইউয়াসার দাবী ছিল ইউনিট ৭৩১ এর বাইরেও ভিভিশনের পরীক্ষা করা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্তত এক হাজার জাপানি সেনাসদস্য চীনের বিভিন্ন এলাকায় সাধারন মানুষের উপর এসব নারকীয় পরীক্ষা করতো। দি নিউইয়র্ক টাইমস ইউনিট ৭৩১ এর প্রাক্তন একজন সদস্যের সাক্ষাৎকার নেয়, সেই সদস্য সাক্ষাৎকারে জানায় জাপানের সেনাবাহিনী সেসময় প্লেগ বোম্ব তৈরির জন্য ইচ্ছে করে বন্দীদের শরীরে প্লেগের জীবানু প্রবেশ করানো হত। ইউনিট ৭৩১ ও ইউনিট ১৬৪৪ এ চীনের জনসংখ্যাকে ধ্বংস করবার জন্য প্লেগ বাহী মাছি কম উচ্চতায় ওড়া বিমান থেকে চীনের শহর গুলোতে ছড়িয়ে দিত যাতে চীনের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। জাপানিদের কারনে চীনে রীতিমতো প্লেগ মহামারী দেখা দেয়। জাপানি সেনারা টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড রোগের জীবানু চীনের বিভিন্ন শহরের জলের কুয়োয়, খাদ্যদ্রব্যে মিশিয়ে দিত যার কারনে চীনে টাইফয়েড মহামারীও শুরু হয়। এছাড়া স্মলপক্স, কলেরা সহ একাধিক রোগের জীবানু ছড়িয়ে চীনের জনসংখ্যা পুরো ধ্বংস করে দেবার নারকীয় চেষ্টা করেছিল জাপানি সেনাবাহিনী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের এগারোটি শহরের উপর অন্তত বারোটি বৃহত জৈবিক অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিল জাপানি সেনাবাহিনী। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট জাপানকে সতর্ক করে এসব নৃশংস কার্যকালাপের জন্য। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে জাপানিজ নৌবাহিনী আমেরিকার উপর জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। জাপান এই মিশনের নাম দিয়েছিল অপারেশন পিএক্স যাকে অপারেশন চেরি ব্লোসমস এট নাইট। এই অপারেশনে পরিকল্পনা করা হয় সেইরান বিমান থেকে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে বিশেষ করে সান ডিয়েগো, লস অ্যাঞ্জেলস এবং সানফ্রান্সিসকো শহরের উপর কলেরা, বিউবোনিক প্লেগ, টাইফয়েড, ডেঙ্গুর জীবানু ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া এই মিশনে ঠিক হয় জাপানের কিছু সাবমেরিনের ক্রু আত্মঘাতী মিশনে নিজেদের শরীরে জীবানু ঢুকিয়ে আমেরিকার উপকূল বরাবর দৌড়াবে যাতে আমেরিকাতে মহামারী প্রবেশ করানো যায়। ঠিক হয় ২৬ মার্চ, ১৯৪৫ সালে অপারেশন পিএক্স শুরু করা হবে কিন্তু জাপানের সেনাবাহিনীরই একাংশের আপত্তিতে এই অপারেশনের পরিকল্পনা বাতিল করা হত। যদি এই অপারেশন করা হত তাহলে আমেরিকার জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলার আগেই বিশ্ব আরও একটি নরাকীয় ঘটনার সাক্ষী থাকতো। এমনকী চীনের বন্দীদের কাঠের সাথে বেঁধে তাদের উপর গ্রেনেড, আগুনের শিখা, রাসায়নিক হাতিয়ার, বিভিন্ন ধরনের বোম্ব পরীক্ষা করতো জাপানি সেনাবাহিনী।
মানুষের শরীরে জলের পরিমান প্রচন্ড কমে গেলে শরীর কীভাবে সাড়া দেয় তার পরীক্ষাও করা হত ইউনিট ৭৩১ এ। বহু চাইনিজ বন্দীদের অভুক্ত রেখে তাদের গরম পাখার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হত, তাদের কোনও জল দেওয়া হতনা৷ প্রচন্ড গরমে, ঘেমে গিয়ে মানুষগুলো যখন তীব্র যন্ত্রনায় মারা যেত তখন শরীরের প্রতিটি অংশের পরিবর্তন লিখে রাখতো জাপানিরা। ইউনিট ৭৩১ এ কোন বন্দীদের শরীরে যে রক্তের শ্রেনী রয়েছে তার বিপরীত শ্রেনীর রক্ত প্রবেশ করিয়ে শরীরের পরিবর্তন করা হত। এছাড়া বন্দীদের একটি কাঁচের ঘেরা জায়গায় রেখে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে শরীরের পরিবর্তন লক্ষ করা হত।
ইউনিট ৭৩১ এ মানুষকে দুই টুকরো করে তাদের শরীর ফরমালডিহাইডে রেখেও পরীক্ষা করা হত। মহিলা বন্দীদের এবং সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের উপরও নারকীয় অত্যাচার হত এখানে। আরও বিভিন্ন ধরনের নৃশংস অত্যাচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ইউনিট ৭৩১. বর্বরতার বিচারে জার্মানির নাজি সেনাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল জাপনি সেনারা। ইউনিট ৭৩১ এর মাধ্যমে চীনে নৃশংস বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল জাপানি সেনাবাহিনী। যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় না হত তাহলে চীনের একটি বড় জনসংখ্যা শেষ করে দিত জাপান।