অফবিট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পন করেছিল, তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি কেন আত্মসমর্পন করেনি জানেন?

১১ নভেম্বর বিশ্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ন দিন, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ১১ নভেম্বর একটি স্মরনীয় দিন। কারন আজ থেকে প্রায় ১০৫ বছর আগে ১৯১৮ সালে ১১ নভেম্বরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই শুরু হওয়া প্রানঘাতী এই মহা যুদ্ধ অবশেষে ১৯১৮ এর ১১ নভেম্বর শেষ হয়। এইজন্য এই দিনকে আর্মিসটিস ডে বা যুদ্ধবিরতি দিন বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হওয়ার পর আত্মসমর্পন করেছিল কিন্তু মজার ব্যাপার হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হওয়া সত্বেও আত্মসমর্পন করেনি বরং জার্মানি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করে, মিত্রশক্তিও এই প্রস্তাব মেনেও নেয়। যদিও ভার্সেইলের সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির উপর প্রচুর শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। এই ভার্সেইলের সন্ধিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় এসে প্রথমেই এই ভার্সেইলের সন্ধিকে অস্বীকার করে।

২৮ জুন, ১৯১৪ সালে একজন সার্বিয়ান লোক অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির যুবরাজ আর্চডিউক ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে কিছু শর্ত দেয় এবং জানায় যদি সার্বিয়া শর্ত না মানে তাহলে সার্বিয়া আক্রমন করা হবে। সার্বিয়া অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির তুলনায় অনেকটাই ছোট একটি দেশ। সার্বিয়া সাহায্যের জন্য রাশিয়ার কাছে যায় এবং রাশিয়া সার্বিয়াকে সাহায্য করতে রাজি হয়। অন্যদিকে এই খবর জানতে পেরে জার্মানি অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিকে সমর্থন করে। রাশিয়ার সাথে সেসময় ব্রিটেন ও ফ্রন্সের চুক্তি ছিল অর্থাৎ কোন আক্রমন হলে এই দুই দেশ রাশিয়াকে সাহায্য করবে। আর্চডিউক ফার্ডিনান্ডকে হত্যার ঠিক একমাস পর অর্থাৎ ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি সার্বিয়া আক্রমন করে, এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। সেসময় এই যুদ্ধকে বলা হত দি গ্রেট ওয়ার, এমন একটি যুদ্ধ যা অন্য সব ছোট যুদ্ধকে শেষ করে দেবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় জার্মান সেনাদের বলা হয় তারা ২৫ ডিসেম্বর অর্থাৎ ক্রিস্টমাসের আগে ঘরে ফিরে আসবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। 

যুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মান সেনারা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সাফল্য পায় কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হওয়া মার্নের যুদ্ধে ফ্রান্স ও জার্মান উভয় সেনাদলই কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা ট্রেঞ্চ বা পরিখা  খনন করে এক অপরের সামনে। এই পরিখার মধ্যেই যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার এতটা সফল হয় যে জার্মান সেনা আর এগোতেই পারেনি। এই পরিখার ভিতরেই চার বছর কেটে যায় তবুও জার্মান সেনা এগোতে পারেনি। যুদ্ধ যত এগোতে শুরু করে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়ে জার্মান সেনাদল কারন ফ্রান্সকে যুদ্ধে লজিস্টিক সরবরাহ করে ব্রিটেন, আমেরিকা সহ বেশ কিছু দেশ কিন্তু জার্মানি দুই দিকে লড়াই করছিলো একদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং অন্যদিকে রাশিয়া। যার কারনে লজিস্টিক সরবরাহে ব্যাপক সমস্যায় পড়ে জার্মান সেনা। ১৯১৭ সাল আসতে আসতে জার্মানির অবস্থা এমন হয় যে বন্দুক, গুলি, অস্ত্র তৈরির জন্য ধাতুর অভাব দেখা দেয়। জার্মানি সেসময় দেশে যত নিত্যপ্রয়োজনীয় ধাতব জিনিস ছিল সেসব সংগ্রহ করে গলিয়ে অস্ত্র তৈরি শুরু করে। ধাতুর অভাবের পাশাপাশি খাদ্য সংকটও তৈরি হয় জার্মানিতে। 

১৯১৪ সালের দিকে জার্মানি খাদ্যের জন্য পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ন ছিলনা, কাঁচামাল ও খাদ্যের জন্য জার্মানি আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন জার্মানিকে অবরুদ্ধ করে দেয় সমুদ্রপথে যার কারনে বাইরে থেকে কোন সাহায্য পায়নি জার্মানি। অতীতকাল থেকেই ব্রিটেনের প্রধান শক্তি ছিল তাদের নৌবাহিনী। জার্মানিরও নৌবাহিনী ছিল কিন্তু ব্রিটেনের মতোন শক্তিশালী ছিলনা। জার্মানিতে খাদ্য সংকট এতটা তীব্র আকার ধারন করে যে সাধারন জনগনই ঠিক মতো খাবার পেতনা, লোক খাদ্যাভাবে, অপুষ্টিতে মারা যেতে শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে জার্মানির শাসক কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয় জার্মান নৌবাহিনীকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর উপর আক্রমনের আদেশ দেয় কিন্তু জার্মান নৌবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষনা করে দেয় কাইজারের বিরুদ্ধে এবং কোন আক্রমনই করা হয়না। খাদ্য সংকটের প্রভাব জার্মান সেনাবাহিনী উপরও পড়ে। ১৯১৭ এর দিকে রাশিয়া তার আভ্যন্তরীন সমস্যা, গৃহযুদ্ধের কারনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে পীছু হটে যায় তখন জার্মানি কিছুটা হলেও স্বস্তি পায় কারন রাশিয়ার সাথে জার্মানির চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি ইউক্রেনের কিছুটা অংশ পায়, এখান থেকে খাদ্য তৈরি করে সেনাবাহিনী ও সাধারন জনগনকে দেওয়া হয় তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ছিল। আসলে জার্মান রাজনৈতিক বর্গ এত দীর্ঘ যুদ্ধের পরিকল্পনা করেনি, তারা একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের নির্নয় নিয়েছিল। এই যুদ্ধের জন্য জার্মানি প্রচুর ঋনও নিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ এত বেশীদিন ধরে চলায় জার্মান অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জার্মান জিডিপির বেশীরভাগই চলে যেত ঋন মেটাতে। যার কারনে এই যুদ্ধ শেষ হওয়া জার্মানির পক্ষে খুবই দরকার হয়ে পড়ে। 

১৯১৭ সালে জার্মানি খবর পায় আমেরিকাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে সহায়তা করতে সেনা পাঠাচ্ছে। জার্মানি জানতো একবার আমেরিকার সেনা এসে গেলে তাদের পরাজয় পুরো নিশ্চিত তাই আমেরিকার সেনাবাহিনী পৌঁছানোর আগেই একটা শেষ আক্রমনের পরিকল্পনা করে জার্মানি। জার্মানি স্প্রিং অফেন্সিভ বা লুডেনডর্ফ অফেন্সিভ শুরু করে ১৯১৮ সালের ২১ মার্চ। জার্মানির পরিকল্পনা ছিল সাম নদী থেকে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত বিস্তৃত পরিখাতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পরিখা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া। স্প্রিং অফেন্সিভের পুরো মিশনে চারভাগে আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয় যাদের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় মাইকেল, জর্জেট, গ্নিসেনাউ এবং ব্লুচার-ইয়র্ক। এদের মধ্যে মাইকেল ছিল প্রধান আক্রমন। জার্মানি ভেবেছিল এই আক্রমন সফল হলে এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পরাজিত হলে ফ্রান্স যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হবে। এই আক্রমনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জার্মানি স্ট্রোম ট্রুপার বিভাগের উপর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিশেষ ইনফ্রেন্টি বিভাগকে স্ট্রোম ট্রুপার বলা হত। স্প্রিং অফেন্সিভে প্রথমে জার্মানি সফলও হয়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ফ্রান্সের দিকে ষাট মাইল এগিয়ে যায় জার্মান সেনা। 

১৯১৪ থেকে ১৯১৮ অবধি ফ্রান্সের দিকে মাত্র এক দুই কিলোমিটার যেতে প্রচুর সেনা মারা যাচ্ছিল জার্মানির সেখানে হঠাৎ ষাট মাইল বা ৯৬ কিলোমিটার এগিয়ে যাওয়ার অর্থ জার্মানি ব্যাপক সাফল্য পায়। কিন্তু পেছনে পরিখাতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনা ৮ আগস্ট হান্ড্রেড ডেস অফেন্সিভ মিশন শুরু করে যার লক্ষ্য ছিল এগিয়ে যাওয়া জার্মান সেনাকে ঘিরে ফেলে পরাজিত করা অথবা বন্দী করা, ১১ নভেম্বর অর্থাৎ যুদ্ধবিরতি দিন অবধি এই অপারেশন চালায় মিত্রশক্তি। এই অপারেশন যখন শুরু হয় তখন জার্মানির শাসক কাইজার উইলিয়াম দ্বিতীয় বুঝে যায় এবার আর তাদের আত্মসমর্পন ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু জার্মানিতে রাজনৈতিক বর্গের একাংশ ও জার্মান জনগন আত্মসমর্পনের বিরোধীতা করে। ফলে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল গঠন করে জার্মানি যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি করা যতটা কম শর্তে সম্ভব। এই দল প্রথমে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রু উইলসনের সাথে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতির জন্য কারন জার্মানি জানতো আমেরিকার সাথে চুক্তি হলে কঠোর শর্ত কিছুটা কম আসবে, জার্মানি যে করেই হোক ফ্রান্সকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলো। কিন্ত উড্রু উইলসনের সাথে যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হওয়ায় বাধ্য হয়ে জার্মান দলকে মিত্রশক্তির প্রধান কম্যান্ডার ফার্ডিনান্ড ফোচের সাথে আলোচনায় বসতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে মিত্রশক্তি পৌঁছে গিয়েছিল এবং জার্মানি বাধ্য হয় আত্মসমর্পনে কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিতে মিত্রশক্তি যেতে পারেনি কারন পুরো যুদ্ধ হয় ফ্রান্স সীমান্তে। এত দীর্ঘ যুদ্ধের পর মিত্রশক্তির সেনাবাহিনীরও আর ক্ষমতা ছিলনা জার্মানির রাজধানী বার্লিন পর্যন্ত যাবার কারন রাস্তায় আরও ভয়ানক লড়াই হত। দুপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় কিন্ত যেহেতু জার্মানিতে লজিস্টিক সরবরাহ এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয় তাই জার্মানি বাধ্য হয় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিতে আগে। ফার্ডিনান্ড ফোচ যুদ্ধবিরতির জন্য জার্মানির উপর অনেক কঠিন শর্ত আরোপ করে এবং জার্মান প্রতিনিধি দল বাধ্য হয় সই করতে। 

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করে জার্মান প্রতিনিধি দল এবং এর ছয় ঘন্টা পর বেলা এগারোটার সময় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে জার্মান জনগনের একটি বড় অংশ এই যুদ্ধ বিরতির বিরোধী ছিল কারন তাদের ধারনা ছিল পূর্ব প্রান্তে তারা রাশিয়াকে পরাজিত করেছে সুতরাং যুদ্ধ আরও চলুক। যদিও বাস্তবে রাশিয়াকে জার্মানি পরাজিত করতে পারেনি গৃহযুদ্ধের কারনে রাশিয়া নিজেই যুদ্ধ থেকে সরে যায়। ফার্ডিনান্ড ফোচ যুদ্ধবিরতির সময় জার্মানির উপর যেসব কঠিন শর্ত আরোপ করেছিল তা পরে আরও একটি প্রানঘাতি যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অন্যতম প্রধান কারন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *