অফবিট

মধ্য প্রাচ্যে কেন কুর্দিদের সমর্থন করার পেছনে কি কারন রয়েছে ভারতবর্ষের?

ইতিহাস সাক্ষী আছে যে দেশ তার সংস্কৃতিকে ধরে রাখবার জন্য একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব গঠন করেনি তার সবসময় পতন হয়েছে। যদি কোন জাতি ভেবে থাকে তাদের রক্ষা করবার জন্য অন্য কোন শক্তিশালী দেশ আছে বা বিশ্বে কোন সংগঠন আছে তাহলে সেই জাতি মূর্খের স্বর্গে বাস করে। এরই স্পষ্ট উদাহারন কুর্দি জনজাতি। তবে বিগত কয়েক দশকে কুর্দি জাতি নিজেদের শক্তিশালী করেছে এবং এই প্রক্রিয়া বর্তমান রয়েছে। বলা হচ্ছে মধ্য প্রাচ্যে নতুন রাজনৈতিক সংকট কুর্দিস্তানকে ঘিরেই তৈরি হবে। কুর্দিস্তানকে ঘিরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকটের দিকে নজর রাখছে ভারতও। কুর্দিস্তানকে ঘিরে ভারতের কী নীতি হতে পারে সেটাও ভারতের বিদেশনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ন।

জগ্রোস ও তোরোস পর্বতমালা অধুষ্যিত তুরস্ক, ইরান, আর্মেনিয়া, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী প্রায় চার লাখ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে কুর্দি জাতির প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি জনসংখ্যার লোক বসবাস করে। এরা কুর্দি ভাষায় কথা বলে। এই বিস্তীর্ন অঞ্চলকেই কুর্দিস্তান বলা হয় যদিও এই নামে সরকারি ভাবে কোন দেশ নেই। তবে মধ্যযুগে এই অঞ্চলে কুর্দি জাতির নিজস্ব শাসকও ছিল। এইসব অঞ্চল জুড়ে কুর্দিস্তান গঠনের ডাক প্রায়ই ওঠে। যার জন্য বিগত কয়েক বছরে তুরস্ক ও সিরিয়া সরকার চেষ্টা করেছিল তাদের কুর্দি জনগোষ্ঠীকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করার যাতে ওইসব অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। তুরস্কের সুলতান সাঞ্জার বারোশো শতকে এই অঞ্চল বিজয় করে। তিনিই প্রথম এজায়গার নাম কুর্দিস্তান দিয়েছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল বর্তমান ইরানের হামদান শহরের কাছে বাহার নামে একটি শহরে। তবে সময়ের সাথে কুর্দরা নিজেদের সংঘটিত করতে পারেনি বলে তাদের নিজস্ব দেশও কোনওদিন গঠন হয়নি। তবে বিগত কয়েক দশকে আবারও কুর্দিস্তান গঠনের দাবি পূর্নাঙ্গ রূপে আলোচিত হচ্ছে। ইরাকের স্বৈরাচারী শাসক সাদ্দাম হোসেন একটা সময় বহু কুর্দি মানুষকে হত্যা করেছিলো, তাও কুর্দিদের দমিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৭০ সালে ইরাক সরকার তাদের কুর্দ অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়, এই অঞ্চলকে ইরাকি কুর্দিস্তান বলা হয়। ইরানের কু্র্দি জনগোষ্ঠী অধুষ্যিত অঞ্চলকে কোর্দেস্তান বলা হয়। 

১৯২০ সালের আগে এই পুরো অঞ্চলে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে নতুন চুক্তি অনুযায়ী এইসব অঞ্চলে দেশগুলো তাদের সীমানা তৈরি করতে থাকে। তখন কুর্দিস্তান গঠনের কথা ওঠে। সেসময় পশ্চিমা দেশগুলো জানিয়েছিল যেহুতু কুর্দি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যথেষ্ট বেশী সেকারনে তাদের একটি আলাদা দেশ দেওয়া হবে। কিন্তু ১৯২৩ সালে লোসেন চুক্তি অনুযায়ী কুর্দিস্তানকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। কীছু ঐতিহাসিকবিদ বলেন কুর্দিস্তানকে বিভক্ত করবার সময় ইচ্ছে করেই এমন করা হয়েছিল যাতে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ঝামেলা হতেই থাকে। সিরিয়াতে মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশই হচ্ছে কুর্দি জনগোষ্ঠি। সিরিয়াতে মোট তিনটি বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ হয়। একটি হচ্ছে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদের গোষ্ঠী। বাসার আল আসাদকে সমর্থন করে রাশিয়া। এর বিরুদ্ধে রয়েছে কুর্দিরা। আমেরিকা একটা সময় কুর্দদের সহয়তা করতো কারন সিরিয়াতে একটা সময় আইএসআইএস বা ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রভাব বাড়ছিলো। এই আইএসআইএসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল লড়াই করে কুর্দিরাই। এদিকে তুরস্ক সিরিয়ার কুর্দিদের উপর আক্রমনের জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহয়তা করে। কারন তুরস্ক চায়না সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের কুর্দিদের সাথে মিশে কুর্দিস্তান গঠনের দাবি করুক। এর জন্য তুরস্ক ত্রিশ কিলোমিটারের একটি নিরপেক্ষ অঞ্চলও তৈরি করেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন বর্তমান তুরস্ক গঠন হয় তখন থেকে তুরস্ক সরকার তাদের পূর্বদিকের কুর্দি অধুষ্যিত জনগোষ্ঠীকে জোর করে নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে। তুরস্ক সরকার কুর্দি জনগোষ্ঠীকে জানিয়ে দেয় তারা যেন নিজেদের মউন্টেন তু্র্ক বা পাহাড়ি তুর্কি জনগোষ্ঠী হিসাবে পরিচয় দেয়। চীন যেমন তিব্বত দখলের পর সেখানের সংস্কৃতি বদলে দেয় জোর করে ঠিক তেমনি তুরস্ক সরকার জোর করে কুর্দিদের সংস্কৃতি, শিক্ষা, পোষাক বদলে দেয়। এই পুরো ঘটনায় প্রায় ৪৭,০০০ কুর্দি মানুষের মৃত্যু হয়। তুরস্কে লায়লা জানা নামে একজন বিখ্যাত কুর্দি নেতা রয়েছে যাকে ১৯৯১ সালে তিন বছরের জন্য জেলে ভরে দেওয়া হয় কুর্দিদের অধিকারের কথা বলায়। ১৯৯৪ সালে তিনি মুক্তি পাওয়ার পর সাধারন নির্বাচনে অংশ নিয়ে মন্ত্রী নির্বাচিত হয়। কিন্তু সংসদে শপথ নেবার সময় তিনি প্রথমে টার্কিশ ভাষায় শপথ নেন পরে কুর্দি ভাষায় নেন, এই কারনে তার উপর দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে তাকে পনেরো বছরের জেলের সাজা শোনানো হয়। অর্থাৎ তুরস্ক কোঠোর হাতে কুর্দিদের দমন করে। কুর্দিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯৭৮ সালে সিরিয়াতে আবদুল্লাহ ওকলান নামে এক ব্যাক্তি কুর্দিস্তান ওয়ার্কারস পার্টি বা পিকেকে নামে একটি দল গঠন করে। পিকেকে মূলত তুরস্কের পূর্বাংশ ইস্টার্ন অ্যানাটোলিয়াতে তুরস্কের সরকারী স্থাপনার উপর গোরিলা যুদ্ধ করত যাতে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে কু্র্দি জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়। পিকেকের লক্ষ্য ছিল ঐক্যবদ্ধ কুর্দিস্তান গঠন। 

২০০৮ সালে লায়লা জানা পিকেকে সমর্থনের জন্য তাকে আবারাও জেলে ভরে দেওয়া হয়। ১৯৮০-৯০ পর্যন্ত ব্যাপক গোরিলা যুদ্ধ চলে তুরস্কের বিরুদ্ধে পরে ১৯৯৯ সালে ওকলানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তারপরেও গোরিলা যুদ্ধ চলতেই থাকে। ২০০২ সালে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য চাপ দেয় যে কু্র্দি ভাষা, সংস্কৃতিকে সমর্থন করার। বাধ্য হয়ে তুরস্ক তাই করে। এরপর সিরিয়াতে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন তুরস্ক সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদের সাথে যৌথভাবে কুর্দিদের উপর দ্বিমুখী আক্রমন করে এবং সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দিদের মধ্যে ত্রিশ কিলোমিটারের একটি নিরপেক্ষ অঞ্চল তৈরি করে।

এবার মনে হতে পারে কুর্দিস্তানে ভারতের কেন নজর রয়েছে! এর একটা প্রধান কারন অর্থনীতি। ইরাকি কুর্দিস্তানে বেশীরভাগ তেলের কেন্দ্র ও শোধনাগার রয়েছে। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন সংস্থায় প্রচুর ভারতীয় কাজ করে, এখান থেকে ভারত একটি বড় রেমিট্যান্স পায়। ইরাকি কুর্দিস্তানের অর্থনীতিও মজবুত সুতরাং এই অঞ্চলে বিনিয়োগে ভারতের লাভ আছে। এছাড়া তুরস্কের নেতা রিসেপ তাইপে এরদোগান কাশ্মীর নিয়ে প্রায়ই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। রিসেপ তাইপে এরদোগান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নতুন নেতা হিসাবে মানে। তুরস্ক সরকার সমর্থিত একটি সংগঠন তুর্কিয়ে দিয়ানেত সংগঠন পাকিস্তানি আইএসআই এর সাথে মিলে ভারত বিরোধী প্রচার করে। 

তুরস্কের সরকার বিরোধী গোষ্ঠী ইসলামিক সাদতের সাথেও ভাল সম্পর্ক রয়েছে আইএসআই এর। অর্থাৎ তুরস্ক সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল উভয়েই ভারত বিরোধী। কাশ্মীরে ধারা ৩৭০ তোলা নিয়েও বিরোধীতা করেছিল এই এরদোগান। তুরস্কের এই দিনায়েত সংগঠন ভারতীয় ছাত্রদের বিশেষ করে বিহার, কেরালা ও উত্তর প্রদেশের ছাত্রদের স্কলারশিপ দিয়ে পড়বার জন্য তুরস্কে নিয়ে গিয়ে শিক্ষার নামে তাদের ব্রেনওয়াশ করছে। যার কারনে ভারত সরকারের উচিত কুর্দিস্তানকে সমর্থন করার। সোজা কথায় তুরস্কের ভারত বিরোধী কাজকর্ম বন্ধ করবার একটাই উপায় কুর্দিস্তানকে সমর্থন করা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তুরস্কের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করা। আলকায়দা এবং আইএসএস এই দুই সন্ত্রাসী সংগঠনই ভারতের শত্রু। এই দুই সংগঠনের মধ্যে সংযোগ রয়েছে। আবার এই দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সফল কুর্দি যোদ্ধারা। তাই ভারত যদি কুর্দিদের সমর্থন করে তাহলে তা ভারতের জন্যও লাভজনক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *