প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভিসন ২০৪৭
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষে লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে গত ১৯ এপ্রিল। ইতিমধ্যেই দুই দফা ভোটগ্রহন সম্পূর্ন হয়ে গেছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অন্তত ৪০০টি আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়েছে। তবে তারই মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদী সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ভারতের উন্নয়নের জন্য ২০৪৭ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি সম্পূর্ন হয়ে গেছে। আগামী ২০৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের একশো বছর পূর্তি উপলক্ষে বিগত দুই বছর ধরে যাবতীয় পরিকল্পনা ঠিক করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশ যখন অমৃত মহোৎসব পালন করছিলো তখন থেকেই ভিসন ২০৪৭ এর ব্যাপারে তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন।
এই বিষয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সহায়তাও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রধানমন্ত্রীর এই মহা পরিকল্পনায় সহায়তা করেছে। একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল ভিসন ২০৪৭ নিয়ে যেখানে দেশের অন্তত ১৫ লাখ মানুষ ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের সম্ভাব্য উন্নয়ন সম্পর্কে একটি ধারনা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী ইতিমধ্যেই বলেছেন দেশের সার্বিক বিকাশের জন্য আরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে। তাঁর লক্ষ্য আত্মনির্ভর, উন্নত ভারতবর্ষ গঠন।
প্রধানমন্ত্রীর ভিসন ২০৪৭ এর একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে ব্লু ইকোনমি। ভবিষ্যতে এই ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে ভারতের জিডিপি বহুগুন বৃদ্ধি পাবে। কোনও দেশের কাছে যদি উপকূলীয় অঞ্চল থাকে তাহলে তা সেই দেশটির জন্য একটি বিশাল সম্পদের সমতূল্য। বর্তমানে কোনও দেশের সামুদ্রিক বিভাগ দেশটির জিডিপি বৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। ভারতীয় উপদ্বীপের তিন দিকে সমুদ্র রয়েছে যার জন্য ভারতের একটি সুবিশাল সমুদ্রসীমা ও উপকূল ভাগ রয়েছে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভরতের ব্লু ইকোনমির জন্য দীর্ঘমেয়দি পরিকল্পনা শুরু করেছে। ২০২৩ সালেই মুম্বাইয়ে হওয়া বৈশ্বিক সামুদ্রিক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অমৃত কাল ভিসন ২০৪৭ এর কথা ঘোষনা করেন, যার মধ্যেই রয়েছে এই ব্লু ইকোনমির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ২০২৭ সালের মধ্যে সামুদ্রিক বিভাগে ভারতের পরিকল্পনা ও অর্থনীতির উপর তার প্রভাবের জন্য যাবতীয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এই সম্মেলন থেকে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অমৃত কাল ভিসন ২০৪৭ এর কথা ঘোষনা করেন। ২০২৩ সালের ১৭-১৯ অক্টোবর মুম্বাইয়ে হওয়া এই বিশ্ব সামুদ্রিক সম্মেলন এখনও পর্যন্ত ভারতে হওয়া সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক সম্মেলন। ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে মন্ত্রীরা এই সম্মেলনে যোগ দেয়। এছাড়াও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সিইও, শিল্পপতি, বিনিয়োগকারীরাও উপস্থিত ছিল এই সম্মেলনে। এই সম্মেলনের কারনে ভারতের বন্দরগুলোতে আরও বেশী বিনিয়োগ হবে, বানিজ্য বৃদ্ধি পাবে যার কারনে ভারতের জিডিপিও বাড়বে। ভারতের উপকূলীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিরাও এই বৈঠকে উপস্থাপনা ছিল। তিনদিনের এই বৈঠকে ভবিষ্যতের বন্দর, কার্বন নির্গমনের পরিমান কমানো, উপকূলীয় অঞ্চলে জাহাজ পরিবহন, নদীপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মান ও তার রক্ষা, অর্থনীতি এবং বীমা সহ আরও বেশ কিছু বিষয়ে এই বৈঠকে আলোচনা করা হয়। সমুদ্রপথে বানিজ্য ছাড়াও ভারত নদীপথে পরিবহনে বেশী জোর দিয়েছে।
ভারতের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনার মতো নদীতে পরিবহনের ফলে পন্য পরিনহনে খরচ অনেকটাই কমে যাবে। মুম্বাইয়ে হওয়া এই সামুদ্রিক সম্মেলন ভারতের ব্লু ইকোনমিকে আরও মজবুত করবে যার রূপরেখা ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে ভারত সরকার। বিশ্বব্যাঙ্কের কথায় সমুদ্রের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি বৃদ্ধি, জীবনযাপনের মান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান তৈরিকেই ব্লু ইকোনমি বলা হয়। যেমন ভারত থেকে বানিজ্যিক কারনে একটি জাহাজ অন্যদেশে যায়, জাহাজটি সমুদ্রপথ ব্যবহার করে এবং জাহাজে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তাই এটি ব্লু ইকোনমিরই অংশ। তবে ব্লু ইকোনমির একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে সামুদ্রিক সম্পদকে এমনভাবে কাজে লাগানো উচিৎ যাতে দূষন কম হয় এবং সমুদ্রের বাস্ততন্ত্রে কোনও ক্ষতি না হয়। সামুদ্রিক মাছ শিকার, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উত্তোলন, বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সমুদ্র নির্ভর বানিজ্য এইসবই ব্লু ইকোনমির অংশ। অমৃত কাল ভিসন ২০৪৭ এর দুটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে বন্দরের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগীতা। প্রধানমন্ত্রী মোদী জানিয়েছিন ভিসন ২০৪৭ এর আওতায় পরবর্তী প্রজন্মের বড় বন্দর, আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিবহন বন্দর, মাল্টি মডেল কেন্দ্র তৈরি করা হবে। সমুদ্রকে যত বেশী ব্যবহার করা যাবে তত দূষন কম হবে এবং পন্য পরিবহনে খরচ কম হবে৷ এই জন্য বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের বন্দরে বেশী করো বিনিয়োগের আহ্বান জানান। ব্লু ইকোনমির জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী ২৩,০০০ কোটি টাকার প্রজেক্ট ঘোষনা করেছে, এর মধ্যে ২১টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্টের মোট খরচ ১৮,৮০০ কোটি টাকা। এসব প্রজেক্টের অন্তর্গত ৪,৫০০ কোটি টাকা ব্যায়ে টুনা টেকরা গভীর টার্মিনাল তৈরির কাজ তৈরির সূচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। গুজরাটের দীনদয়াল বন্দরে এই টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে। গুজরাটের কান্ডালা বন্দরকেই দীন দয়াল পোর্ট ট্রাস্ট বলা হয়। ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এই টার্মিনাল একটি গ্রীনফিল্ড প্রজেক্ট অর্থাৎ এখানে আগে কোনও পরিকাঠামো ছিলনা, সম্পূর্ন নতুনভাবে টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রজেক্টে মূলত বন্দরের গভীরতা আরও বৃদ্ধি করা হচ্ছে যাতে পরবর্তী প্রজন্মের বড় বড় পন্যবাহী জাহাজ এখানে আসতে পারে। ভারতে বন্দর অনেক রয়েছে কিন্তু গভীর সমুদ্র বন্দর খুব কম আছে যার জন্য বড় পন্যবাহী জাহাজ এখানে প্রবেশ করতে পারেনা। তাই গুজরাটে কান্ডালা বন্দরের গভীরতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। গত জি ২০ সন্মেলনে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত একটি নতুন সমুদ্র বানিজ্যপথের ঘোষনা করা হয়। এই সমুদ্রপথে যেসব বড় জাহাজ আসবে তারা কান্ডালা বন্দরে আসতে পারবে।
ভারত থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত এই নতুন সমুদ্রপথে ইসরায়েল যুক্ত রয়েছে কিন্তু বর্তমানে ইসরায়েলে যুদ্ধ চলায় আপাতত এই সামুদ্রিক করিডরের কাজ বন্ধ রয়েছে। মুম্বাইয়ে বৈঠক চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশী ও বিদেশী সংস্থাগুলোর সাথে সামুদ্রিক বিভাগে ৩০০টি চুক্তি করেছেন যার মূল্য সাত লাখ কোটি টাকা। এছাড়া অমৃত কাল ভিসন ২০৪৭ এর আওতায় আরও বেশ কীছু প্রকল্প রয়েছে যেমন ১৪টি বৃহৎ কার্বন মুক্ত বন্দর নির্মান, ১৪টি হাইড্রোজেন কেন্দ্র তৈরি , একশো শতাংশ পিপিপি মডেলে বর্তমান বন্দরগুলোর ধারন ক্ষমতা চারগুন বৃদ্ধি করে ১০,০০০ মিলিয়ন টন পর্যন্ত করা এবং পাঁচটি স্মার্ট বন্দর নির্মান। বর্তমানে ভারতে আভ্যন্তরীন নদীপথে ৬ শতাংশ পন্যপরিবহন হয় কিন্তু ভারত সরকার এর পরিমান বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করবার লক্ষ্য নিয়েছে। অমৃত কাল ভিসন ২০৪৭এ ২০ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার গুরুত্বপূর্ন বন্দরগুলোতে জাহাজ পরিবহনের সময় কমিয়েছে। কোনও বন্দরে পন্যবাহী জাহাজ আসার পর জাহাজ থেকে পন্য নামানো হয় এবং মজুতকেন্দ্র থেকে নতুন পন্য জাহাজে ভরা হয়। এরপর জাহাজ বন্দর ছেড়ে নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আগে এই পুরো ঘটনায় অন্তত ৪২ ঘন্টা সময় লাগতো কিন্তু বর্তমানে ২৪ ঘন্টারও কম সময় লাগে। এরফলে খরচও অনেকটাই কম হচ্ছে। ভবিষ্যতে এইসময় আরও কম করার চেষ্টা চলছে ইতিমধ্যেই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে ভারতের জিডিপি আরও বৃদ্ধি পেতে চলেছে।