সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কিভাবে হায়দ্রাবাদকে ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত করেছিল?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় কিন্ত মুসলিম লীগের দাবি অনুযায়ী ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে মুসলিম অধুষ্যিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠন হয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ভারতে ৫৬৫ টি প্রিন্সলি স্টেট ছিল যা ভারতের মোট ৪০ শতাংশ এলাকা ছিল এবং ২৩ শতাংশ জনসংখ্যা যুক্ত ছিল। ভারত ও পাকিস্তান গঠনের সময়ে এসব প্রিন্সলি স্টেট গুলোকে বলা হয় তারা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী যেকোনও একটি পক্ষে যোগ দিতে অথবা স্বাধীন থাকতে। সেসময় হায়াদ্রাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলি ভারত নাকি পাকিস্তান কোন পক্ষে যোগ দেবে তা ঠিক করতে পারছিলো না যার কারনে সে কোন পক্ষেই যোগ দেয়নি প্রথমে। তবে নিজামের সাথে পাকিস্তানের একটা যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের অসাধারন বুদ্ধিমত্তার কারনে জন্য আজ হায়দ্রাবাদ ভারতের অংশ হয়। অপারেশন পোলোর মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদে নিজামের শাসনের অবসান ঘটিয়ে হায়দ্রাবাদকে ভারতে যুক্ত করে।
ভারতের অন্যতম প্রাচীন বিখ্যাত শহর হচ্ছে হায়দ্রাবাদ। অতীতে এই শহরের নাম ছিল ভাগ্য নগর। মহম্মদ কুতুব শাহকে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। কুতুব শাহ তার স্ত্রী ভাগমতীর নামে এই শহরের নাম ভাগ্য নগর রাখে। ভাগমতীর পরে নাম হয় হায়দার মহল এবং তার সম্মানেই এই শহরের নাম হয় হায়দ্রাবাদ। আরবি ভাষায় হায়দার শব্দের অর্থ সিংহ, যার কারনে আরবি ভাষায় হায়দ্রাবাদ শব্দের অর্থ সিংহ শহর। প্রথমে এই শহর তৎকালীন দক্ষিন ভারতের শক্তিশালী গোলকুণ্ডা সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। পরে মুঘল সম্রাট ঔরাঙ্গজেবের সময়ে এই শহর মুঘল সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়।
১৭২৪ সাল থেকে হায়দ্রাবাদে নিজামের শাসন শুরু হয়, এই নিজাম একটা সময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজপ্রতিনিধি ছিল পরে নিজেই হায়দ্রাবাদের শাসক হয়ে যায়। হায়াদ্রাবাদের শেষ নিজাম ছিল মীর ওসমান আলি আসাফ। মীর ওসমান হায়দ্রাবাদের সপ্তম নিজাম ছিল। মীর ওসমানকে সেসময় বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বলা হত, সাথে সাথে মীর ওসমান খুব কৃপণ ব্যক্তিও ছিল। মীর ওসমানের সম্পত্তি সেসময় আমেরিকার মোট জিডিপির দুই শতাংশ ছিল। তার নিজস্ব টাঁকশাল ছিল যেখানে হায়দ্রাবাদি রুপিস তৈরি হত। মীর ওসমানের ব্যক্তিগত সংগ্রহে একশো মিলিয়ন পাউন্ড সোনা ও রূপো ছিল। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী মীর ওসমানের সংগ্রহে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডের অলংকার ছিল। মীর ওসমানের সম্পত্তির প্রধান উৎস ছিল গোলকুণ্ডার হীরের খনি, ভারতের একমাত্র হীরের খনি আছে এই গোলকুণ্ডাতেই। মীর ওসমানের কছে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের জ্যাকব হীরে ছিল যেটা সে পেপারওয়েট হিসাবে ব্যবহার করতো। ভারত স্বাধীন হবার পর হায়দ্রাবাদে নিজাম মীর ওসমানের শাসনের অবসান ঘটিয়ে হায়দ্রাবাদকে ভারতের রাজ্য হিসাবে যুক্ত করা হয়। হায়দ্রাবাদ ব্রিটিশ শাসনের সময় অন্যতম বড় প্রিন্সলি স্টেট ছিল। ৮২,৬৯৮ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরের অন্তর্ভুক্ত ছিল অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রের অনেক এলাকা। এই কারনে হায়দ্রাবাদকে ভারতে যুক্ত করতেই হত। সেসময় হায়াদ্রাবাদের মোট আয়তন ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মিলিত আয়তনের থেকেও বেশী ছিল। হায়াদ্রাবাদের আশি শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা ছিল কিন্তু তা সত্বেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনী সবেতেই মুসলিম আধিপত্য ছিল সেসময়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর মীর ওসমান আলি বুঝতে পারে হায়দ্রাবাদ ভবিষ্যতে ভারতে যুক্ত হয়ে যেতে পারে যার কারনে মীর ওসমান আলি মহম্মদ আলি জিন্নাহকে চিঠি লিখে জানায় জিন্নাহ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হায়দ্রাবাদকে সহায়তা করবে কীনা। কুলদীপ নায়ার তার আত্মজীবনী বিয়ন্ড দি লাইনসে জানায় জিন্নাহ মীর ওসমান আলিকে জানায় সে হায়াদ্রাবাদের জন্য পাকিস্তানের অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলতে চায়না। জিন্নাহ নিজামকে জানায় হায়দ্রাবাদকে যদি ভারত চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে তাহলে হায়াদ্রাবাদে তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছানো যাবেনা। সুতরাং হায়দ্রাবাদকে সহায়তা করে জিন্নাহ পাকিস্তাকে বিপদে ফেলতে রাজি ছিলনা। নিজাম স্বাধীনতার পর দুটো ঘটনা খুব ভালোভবে লক্ষ্য করে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে জুনাগড়ের শাসক মাহবত খান পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দিতে চাইছিলো কিন্তু নভেম্বরে জুনাগড় ভারতে যুক্ত হয় এবং অক্টোবর মাসে কাশ্মীর ভারতের সাথে যুক্ত হয়। নিজাম বুঝে যায় তার সামনে আর কোনও উপায় নেই। তবে নিজাম এত সহজে হার মানার লোক ছিলনা। নিজাম হায়দ্রাবাদের ঘটনা জাতিসংঘে এবং আমেরিকার সামনে নিয়ে যেতে চাইছিলো। নিজাম প্রাক্তন ব্রিটিশ সলিসেটর জেনারেল স্যার ওয়াল্টর মঙ্কটনকে নিয়োগ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের কাছে হায়দ্রাবাদ সমস্যা তুলে ধরার জন্য। ওয়াল্টার মঙ্কটনের সেসময় বার্ষিক পারিশ্রমিক ছিল ৯২ লাখ! উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ হাউস অফ কমনসে হায়দ্রাবাদ নিয়ে ভাষনও দেয়। শুধু তাই নয় নিজাম গোয়াও কিনতে চেষ্টা করেছিল।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত যখন স্বাধীন হয় তখনও গোয়া পর্তুগিজের অধীনে ছিল। নিজাম পর্তুগিজদের সাথে আলোচনা শুরু করে গোয়া কেনা অথবা লিজ নেওয়ার ব্যাপারে। নিজামের আরও কিছু প্রচেষ্টার কথা তারই নিজের লোকের কাছ থেকেই জানা গেছে পরে। নিজামের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল এল এডেরুস তার বই হায়দ্রাবাদ অফ সেভেন লাভসে লিখেছেন নিজাম তাকে ইউরোপে অস্ত্র কেনবার জন্য পাঠাতে চেয়েছিল কিন্তু সে সফল হয়নি কারন হায়দ্রাবাদ কোনও স্বাধীন দেশ ছিলনা। তিনি সেই বইয়ে আরও লিখেছেন নিজামের এজেন্ট জেনারেল মীর নাওয়াজ জাঙ্গ লন্ডন গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান অস্ত্র বিক্রেতা সিডনি কটনের সাথে অস্ত্র কেনার জন্য চুক্তি করতে। সিডনি কটন রাজি হয়ে যায় হায়দ্রাবাদে অস্ত্র পাঠাতে, এই খবর যখন ভারত জানতে পারে তখন ভারত সমস্ত আন্তর্জাতিক বিমান বন্ধ করে দেয়। একটা সময় নিজাম যখন জানতে পারলো ভারত হায়দ্রাবাদ তার সাথে সংযুক্ত করবার জন্য তৈরি হয়ে গেছে তখন নিজাম ঠিক করে ভারতকে হায়দ্রাবাদের বৈদেশিক নীতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব দেবে এবং হায়দ্রাবাদ নিজে একটি স্বাধীন প্রদেশ হিসাবে থাকবে। কিন্তু নিজামের এই পরিকল্পনা সফল হয়নি কারন নিজামের রাজাকার বাহিনীর প্রধান কাসিম রাজাভি এই পরিকল্পনায় সফল হয়নি। এই রাজাকার বাহিনীই প্রকৃতপক্ষে হায়দ্রাবাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন করতো। হায়দ্রাবাদে রাজাকার বাহিনী প্রচুর অত্যাচার করেছিলো। এরকম পরিস্থিতিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল শেষ সুযোগ দেয় নিজামকে, সর্দার প্যাটেল ১৫ জুন, ১৯৪৮ সালে নিজামকে একটি ড্রাফটে জানিয়ে দেয় হায়াদ্রাবাদের প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভারতের অধীনে থাকবে, বাকী হায়দ্রাবাদের সমস্ত ব্যবস্থা নিজামের অধীনে থাকবে কিন্তু এর বদলে রাজাকার বাহিনীকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এই খবর জানার পর নিজামকেই রাজাকাররা গৃহবন্দি করে নেয় যা থেকে বোঝা যায় হায়দ্রাবাদে রাজাকারদের কতটা ক্ষমতা ছিল সেসময়। ভারত সরকার প্রস্তত হয়ে যায় হায়দ্রাবাদে অভিযানের জন্য।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসকে সিনহা তার আত্মজীবনী স্ট্রেইট ফ্রম দি হার্ট বইয়ে লিখেছেন তিনি সেসময় জেনারেল কারিয়াপ্পার সাথে কাশ্মীরে ছিলেন, একদিন জেনারেল কারিয়াপ্পা সর্দার প্যাটেলের থেকে বার্তা পান দ্রুত দিল্লিতে দেখা করার। দিল্লিতে পৌঁছেই সর্দার প্যাটেলের বাড়িতে জেনারেল কারিয়াপ্পার সাথে সর্দার প্যাটেলের বৈঠক হয় সেখানে সর্দার প্যাটেল কারিয়াপ্পাকে জিজ্ঞেস করেন হায়দ্রাবাদের ব্যাপার নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কোন সামরিক সামরিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলে কোনও অতিরিক্ত সাহায্য ছাড়াই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম কীনা! জবাবে জেনারেল কারিয়াপ্পা জানান হ্যাঁ। এরপরেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযানের সম্পূর্ন পরিকল্পনা করেন। হায়দ্রাবাদ অভিযানের আগে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তন হয়।
১) লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৮ সালের ২১ জুন ভারতের গভর্নর জেনারেল থেকে অবসরে যায় এবং নতুন গভর্নর জেনারেল হয় সি রাজাগোপালাচারি। লর্ড মাউন্টব্যাটেন হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযানের পক্ষে ছিলনা কিন্তু সি রাজাগোপালাচারি পূর্ন ছাড় দিয়ে দেয় ভারত সরকারকে।
২) প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু আমেরিকা চলে যায় যার কারনে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কার্যকারী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়। তিনি ক্যাবিনেটে হায়দ্রাবাদে অভিযানের প্রস্তাব পাশ করান।
৩) সেসময় ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান ছিল ব্রিটিশ জেনারেল রয় বুচার। তিনি হায়দ্রাবাদে কোনও ব্রিটিশ সেনার অভিযানে নিষেধ করে দেয়। রয় বুচার হায়দ্রাবাদে অভিযানের পক্ষে ছিলনা, তার ধারনা ছিল হায়দ্রাবাদে অভিযান করলে পাকিস্তান হয়ত আমেদাবাদ ও বোম্বেতে বোম্বিং করতে পারে। সর্দার প্যাটেল ভারতীয় সেনাদেরই হায়দ্রাবাদ অভিযানের নির্দেশ দেয়।
অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদ অভিযান শুরু হয় যা চলে ১৭ সেপ্টেম্বর অবধি। এই অভিযানের দুদিন আগেই ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় মহম্মদ আলি জিন্নাহর, সেসময় পাকিস্তানের রাজধানী ছিল করাচি। হায়দ্রাবাদে এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন পোলো কারন হায়দ্রাবাদে সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পোলো খেলার মাঠ ছিল। এই অভিযানের শেষে হায়দ্রাবাদ ভারতের রাজ্য হিসাবে যুক্ত হয়।