ভারতবর্ষের নামকরনের ইতিহাসের পেছনে কি কারন রয়েছে?
নামই পরিচয়, নামেতেই ভাব অর্থাৎ ব্যক্তি, বস্ত, দেশ, পাহাড়, নদী নির্বিশেষে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রত্যেকটি জীবিত ও জড় পদার্থের নির্দিষ্ট নাম আছে যা সেই ব্যক্তি বা বস্তর পরিচয় বহন করে। যেমন আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে কাল বিশেষে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে। জম্বুদ্বীপ, ভারতখন্ড, হিন্দুস্তান, ইন্ডিয়া, হিমবর্ষ, আর্যাবর্ত সহ বিগত হাজার বছরে বহু নামে ডাকা হয়েছে ভারতবর্ষকে। গত জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি দৌপদী মুর্মু জি ২০ সম্মলনের জন্য দেশগুলির রাষ্ট্রনেতাদের আমন্ত্রন করেন, আমন্ত্রন পত্রে ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রপতির জায়গায় ভারতের রাষ্ট্রপতি লেখা ছিল। এই ঘটনার পরই দেশের মধ্যে চর্চা শুরু হয়ে যায় কেন্দ্রীয় সরকার দেশের নাম ইন্ডিয়া পরিবর্তন করে ভারত রাখবে কীনা!
৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতের নাম ছিল মেলুহা। দক্ষিন ভারতের দ্রাবিড় শব্দ মেল আকাম থেকে মেলুহা শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ পার্বত্য দেশ। সিন্ধু সভ্যতার সময় সুমের বা আজকের ইরাকের সাথে ভারতের বানিজ্য হত, সেসময় ইরাকের লোকেরা ভারতবর্ষকে মেলুসা বা মেলুখা বলত। ইরাক সেসময় ভারতবর্ষ থেকে তিলের তেল আমদানি করতো। ইরাকি ভাষায় তিলকে ইলু বলা হয় আবার দ্রাবিড় ভাষাতেও তিলকে ইলু বলা হয়, সম্ভবত এভাবেই মেলুহা নামটি এসেছল। আবার এটাও বলা হয় মেলুহা নামটি এসেছে মালহা শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ নাবিকদের দেশ। সিন্ধু সভ্যতার সময় ভারতের সাথে বহু দেশের বানিজ্য হত। মেলুহা থেকে ভারতবর্ষ নামের পেছনেও অনেক তথ্য আছে যার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজা দুষ্মন্ত ও রানি শকুন্তলার পুত্র ভরতের নাম থেকে ভারত শব্দটি এসেছে।
মহর্ষি বিশ্বামিত্র এবং অপ্সরা মেনকার মেয়ে হচ্ছে শকুন্তলা। হস্তিনাপুরের মহারাজ দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার গন্ধর্ব বিবাহ হয়। তাদের পুত্র ভরত পরে হস্তিনাপুরের রাজা হয়। মহারাজ ভরত যে ভূখন্ডে রাজত্ব করেছিল তার নামই হয় ভারতবর্ষ। এছাড়া ভারতবর্ষ নামের ব্যাপারে জানা যায় ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদে প্রায় ৩০০ উপজাতিদের কথা আছে যাদের মধ্যে পুরু, যদু, অনু, দ্রুহু এবং দুর্বাসা উল্লেখযোগ্য, এছাড়াও আরও একটি উপজাতির নাম পাওয়া যায় নাম ভারত, যার নেতা ছিল সুদাস। ঋগ্বেদে একটি যুদ্ধের ঘটনা পাওয়া যায় যাকে দশ রাজার যুদ্ধ বলা হয়। রবি নদীর তীরে রাজা সুদাস ও দশটি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই হয় যাতে রাজা সুদাস জিতে যায় এবং সিন্ধু নদীর তীরে বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে ভারত গোষ্ঠীর রাজত্ব শুরু হয়, বলা হয় এর থেকেও ভারতবর্ষ নমাটি এসেছে। হিন্দু পুরানেও ভারতবর্ষের নাম রয়েছে। বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিনে যে দেশ রয়েছে তার নাম ভারত। বৈদিক কালে ভারতের ভূমি ছিল সিন্ধু নদীর আশেপাশে। বৈদিক যুগের শেষের দিকে গঙ্গা নদীর তীরে বসতি স্থাপন শুরু হয়। ভারতবর্ষের আরেক নাম আর্যাবর্ত ছিল। আর্যাবর্ত শব্দের অর্থ যেখানে আর্যরা বসবাস করে। মনু স্মৃতিতে বলা হয়েছে পূর্বে সমুদ্র, পশ্চিমে সমুদ্র, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিনে বিন্ধ্যাচল পর্যন্ত বিস্তৃত দেশকে আর্যাবর্ত বলা হয়। বাল্মিকী রামায়নে ভগবান শ্রীরামকে কোথাও আর্য আবার কোথাও আর্যপুত্র বলা হয়েছে। মহাভারতেও আর্যাবর্ত নামটি পাওয়া যায়। ভারতবর্ষ অতীতে জম্বুদ্বীপ নামেও পরিচিত ছিল।
তৃতীয় শতক খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অশোকের সময়ে জম্বুদ্বীপ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। ভগবান বুূদ্ধের সময়ও জম্বুদ্বীপ কথাটি পাওয়া যায়। অনেক শিলালিপিতে জম্বুদ্বীপের কথা আছে। দশম শতকে মাইসোর শিলালিপিতে প্রাচীন ভারতের নাম জম্বুদ্বীপ লেখা হয়েছে। জম্বুদ্বীপ শব্দের অর্থ জাম গাছের স্থান। ভারতে জামের গাছ প্রচুর আছে সেকারনে প্রাচীনকালে ভারতকে জম্বুদ্বীপও বলা হত। দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিশেষ করে থাইল্যান্ড, বালি, জাভা, মালয়েশিয়াতে এখনও প্রাচীন ভারতের জম্বুদ্বীপ নাম ব্যবহার করা হয় কোথাও কোথাও। ভারতের হিন্দুস্তান নামকরনের পেছনে সিন্ধু নদীর ভূমিকা রয়েছে। ৫১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট ডারিয়াস ১ ভারতবর্ষ বিজয় করে, ডারিয়াস ১ এর লেখা কিছু শিলালিপিতে হিন্দু শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এই শিলালিপিতে সিন্ধু নদীর নিম্নবর্তী অঞ্চলে হিন্দুকুশ শব্দের কথা রয়েছে। পারসি ভাষায় স এর জায়গায় হ উচ্চারন করা হয়, এই কারনে সিন্ধুর নাম হয়ে যায় হিন্দু। গ্রীক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে ভারতে আসেন, তিনি তার ইন্ডিকা বইয়ে হিন্দ শব্দের উল্লেখ করেন। সংস্কৃত ভাষায় একটি শব্দ হচ্ছে স্থানম, বাংলায় এর অর্থ স্থান বা জায়গা। পার্সিয়া বা আজকের ইরানে স্থানকে স্তান উচ্চারন করা হয়। এই কারনে প্রথম শতকেই পার্সিয়াতে ভারতের নাম হিন্দুস্তান হয়ে যায় অনেকটা যেমন উজবেকিস্তান, তুর্কিমেনিস্তানের মতোন দেশের নাম রাখা হয়েছে। ২৬২ খ্রিষ্টাব্দে স্যাসানেডের রাজা সাপুর ১ এর নাকস ই রোস্তাম শিলালিপিতে সিন্ধুস্তানের জায়গায় হিন্দুস্তাম নাম লেখা হয়েছে। সিন্ধু নদীর সাতটি নদীকে সপ্তসিন্ধুর বদলে পার্সিয়ানরা হপ্তহিন্দু বলে এবং এর তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের হিন্দু বলা হয়।
মুঘল আমলে উত্তর ভারতই হিন্দুস্তান নামে বেশী পরিচিত ছিল, বিন্ধ্যাচল এলাকাকে ডেকান বলা হত। হিন্দুস্তান থেকে পরে ভারতের বর্তমান নাম ইন্ডিয়া হয়। পার্সিয়ান সাম্রাজ্য এবং গ্রীকদের মধ্যে বিরোধীতা ছিল বহুবছর ধরে। আলেকজান্ডারের শাসনের দেড়শো বছর আগে পারস্য ও গ্রীসের মধ্যে যুদ্ধে গ্রীসরা পরাজিত হয় এবং পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় গ্রীস। এই ঘটনার দেড়শো বছর পর আলেকজান্ডার পার্সিয়া আক্রমন করে এবং সিন্ধু নদীর তীরে চলে আসে গ্রীকরা। পার্সিয়ানদের কাছ থেকে এই অঞ্চলের নাম হিন্দ জেনেছিল গ্রীকরা। কিন্তু গ্রীক ভাষায় হ এর উচ্চরন হয়না যার কারনে হিন্দ হয়ে যায় ইন্ড, এখান থেকেই ইন্ডিয়া নামের উৎপত্তি। ল্যাটিন ভাষাতেও ইন্ডিয়া নামই ব্যবহার হওয়া শুরু হয় এবং বাকী ইউরোপীয়ান দেশগুলোও ইন্ডিয়া নামই ব্যবহার করে। গ্রীস ঐতিহাসিক হেরোডোটাসও তার বইয়ে ইন্ডিয়া নাম উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় শতকে গ্রীক লেখক লুসিয়ান ল্যাটিন ভাষায় ভারতের জন্য ইন্ডাস নাম লেখেন৷ ভারতে যত ইউরোপীয়ান দেশ এসেছে তারা যখনই ব্যাবসা শুরু করেছে তারা তাদের সংস্থার নাম রেখেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
ভারতে একটা সময় ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল। ভারতকে ইস্ট ইন্ডিয়া লেখার কারনের পেছনে দায়ী কলম্বাস। ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকায় নামেন তখন তিনি ভেবেছিলেন ইন্ডিয়ায় এসেছেন সেকারনে আজও আমেরিকার আদি অধিবাসীদের রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়। কলম্বাস তার যাত্রায় প্রথমে ক্যারিবিয়ান সাগরের একটি দ্বীপে নামেন তখনও তিনি ভাবেন ইন্ডিয়ায় এসেছেন সেজন্য এই জায়গার নাম রাখেন ইন্ডিজ। পরে ইউরোপীয়ানরা যখন কলম্বাসের ভুল বুঝতে পারে তখন ইন্ডিজের নাম রাখা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারতের নাম রাখে ইস্ট ইন্ডিয়া। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ইন্ডিয়া নাম আরও প্রসিদ্ধ হয়।
স্বাধীনতার আগে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকেই একসাথে ইন্ডিয়া বলা হত। কিন্ত পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তার নিজের নাম আলাদা করে নেয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহম্মদ আলি জিন্নাহ জানতে পারলো ভারতীয় সংবিধানেও ইন্ডিয়া নামই ব্যবহার করা হবে, তখন জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে আপত্তি জানায় কিন্তু তখন মাউন্টব্যাটেনের কিছু করার ছিলনা। ভারতীয় সংবিধানের প্রথম আর্টিকেলেই বলা হয়েছে ইন্ডিয়া দ্যাটস ইস ভারত বা ইন্ডিয়াই ভারত। সংবিধান সভায় ইন্ডিয়া নাম রাখা নিয়ে অনেক অলোচনা, মতভেদ হয় তবে শেষপর্যন্ত ইন্ডিয়া দ্যাটস ইস ভারত এটাই রাখা হয়। তবে ইন্ডিয়া নাম পরিবর্তন করে ভারত নাম রাখা এতটা সহজ হবেনা কারন ভারতের সমস্ত সরকারি দপ্তর, প্রকল্প, সংগঠন, অসংখ্য পরিকাঠামো, পাসপোর্ট, আন্তর্জাতিক স্তরে, এমনকী সংবিধানেও অনেক জায়গায় ইন্ডিয়া নাম রয়েছে সুতরাং এত সবকিছু পরিবর্তন করে ভারত নাম রাখতে হলে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক খরচ হতে পারে এবং সময়ও অনেক লাগবে। একটি শহরের নাম পরিবর্তন করতেই আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়, তাহলে একটি দেশের নাম পরিবর্তন করতে আরও অনেক খরচ হবে। দক্ষিন আফ্রিকার এক উকিল ইন্ডিয়া নাম পরিবর্তন করে ভারত রাখতে ১৪,৩০৪ কোটি টাকা গড়ে খরচ হবে।