অফবিট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও ২৯ বছর ফিলিপিন্সের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল। জাপানের এক সেনার অবাক করা কাহিনী

যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে প্রত্যেক বিভাগকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনও বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শত্রুর বেস আক্রমনের আবার কোনও বিভাগ দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের ও তাকে রক্ষার দায়িত্বে থাকে। এছাড়াও লজিস্টিক সাপ্লাই, সংযোগ রক্ষা, চিকিৎসা সহ একাধিক ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে থাকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যেকোনও দেশের সেনাবাহিনী। যুদ্ধ শেষ হলে সেনাবাহিনী তাদের বেসে ফিরে আসে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। জাপানের একটি সেনা জানতেই পারেনি যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ২৯ বছর ধরে ফিলিপিন্সের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল এক জাপানি সেনা কারন তার কাছে কোনও খবরই ছিলনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ফিলিপিন্সের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ওই জাপানি সেনার ঘটনা রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় বিশ্বে।

সময়টা তখন ১৯৪৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের পর্যায়ে। অক্ষশক্তি অর্থাৎ জার্মানি, জাপান ও ইতালির পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে তখন। এই সময়ে জাপানি সেনাবাহিনীতে যোগদান করে একজন যুবক যার নাম হিরু ওনোডা। জাপানি সেনার কমান্ডার হিরু ওনোডাকে বলে ফিলিপিন্সের লুবাং দ্বীপে তাকে যেতে হবে, ওই জায়গাকে শত্রুর হাত থেকে যে করেই হোক রক্ষা করতে হবে। তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় লুবাং দ্বীপ কোনও ভাবেই ত্যাগ করা চলবেনা, যে কোনও পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করাও চলবেনা। তাকে আরও বলা হয় জাপানি সেনার একটি দলই আসবে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তার আগে ওই দ্বীপ ত্যাগ করা চলবেনা। মজার ব্যাপার হল যে কম্যান্ডিং অফিসার হিরু ওনোডাকে এতসব নির্দেশ দিয়েছিল সে নিজেই কয়েকমাস পর মিত্র শক্তির সামনে আত্মসমর্পন করেছিল। লুবাং দ্বীপ পরবর্তী দুই তিন মাসের মধ্যে মিত্র শক্তি দখল করে নেয়। ওই দ্বীপে থাকা বহু জাপানি সেনাকে গ্রেফতার করা হয়, তবে বেশ কিছু জাপানি সেনা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জঙ্গলে আত্মগোপন করে, এদেরই দলের একজন হিরু ওনোডা। তবে মিত্র শক্তি জঙ্গলেও জাপানি সেনার বিরুদ্ধে অভিযান করে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং গ্রেফতার করে। তবে হিরু ওনোডা ও তার দল বেঁচে যায়। তারা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে এবং রসদের জন্য মাঝেমধ্যে মিত্র শক্তির সেনাদের উপর গোরিলা আক্রমন করে রসদ নিয়ে আবার পালিয়ে যেত। এই ঘটনার কয়েকমাস পর অক্টোবর, ১৯৪৫ সালে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার দুই মাস পরে হিরু ওনোডা একটি লিফলেট পায় যাতে লেখা ছিল জাপানি সেনা ১৫ আগস্ট আত্মসমর্পন করেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। বাইরের জগতের সাথে কোন সংযোগ না থাকায় ওনোডা ও তার সাথিদের বিশ্বাসই হয়নি যে জাপানি সেনা আত্মসমর্পন করে দিয়েছে। তারা এটাও জানতোনা যে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের উপর পরমানু বোম্ব ফেলেছিল যার ভয়াবহতা দেখে জপানি সেনা আত্মসমর্পন করে দিয়েছে। 

ওনোডা ও সাথীরা স্থানীয় মানুষদের বাড়ি, ফার্মে গোরিলা আক্রমন করে রসদ নিয়ে যেত, বারবার এই ঘটনায় বিরক্ত হয়ে স্থানীয়রা সেনাবাহিনীকে অভিযোগ করে। এরপর বোয়িং বি ১৭ বিমান থেকে সেই জঙ্গলের উপর আবারও প্রচুর লিফলেট ফেলা হয়। এই লিফলেটে জাপানের শাসকের লিখিত বার্তা ছিল যে জাপান আত্মসমর্পন করেছে, লুকিয়ে থাকা সমস্ত জাপানি সেনাদের আত্মসমর্পনের আদেশ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু এবারও ওনোডা ও তার সাথীরা বিশ্বাস করেনি। এরপর আবারও বিমান থেকে লিফলেট ফেলা হয় জঙ্গলে, এবার লিফলেটে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার অংশ, কুটনীতিবিদদের বার্তা, এমনকী লুকিয়ে থাকা লোকেদের পরিজনদের চিঠি পর্যন্ত ফেলা হয় কিন্তু তাও ওনোডা ও তার সাথীরা বিশ্বাস করেনি। তারা বিশ্বাস করতো এগুলো মিত্রশক্তির ষড়যন্ত্র তাদের জঙ্গল থেকে বাইরে বার করার জন্য। 

ওনোডা বিশ্বাস করতো তাকে নেওয়ার জন্য যতক্ষননা জাপানি সেনাবাহিনী আসবে, নাহলে সে বেরোবেনা। সেসময় ওনোডার সাথে তিনজন জাপানি সেনা ছিল। এভাবে পাঁচ বছর কেটে যায়, ওই চারজনের মধ্যে একজনের মনে সন্দেহ হয় সে ভবে হয়ত সত্যিই জাপান আত্মসমর্পন করেছে। ওই ব্যক্তি বাকী তিনজনকে কিছু না জানিয়ে লুকিয়ে তাদের থেকে জঙ্গলের অন্যত্র চলে যায় এবং জঙ্গলের বাইরে বেড়িয়ে এসে আত্মসমর্পন করে। ওনোডা সহ তিনজন যখন দেখে তাদের আরেক সাথি নেই তারা তখন এটা ভাবেনি যে সে চলে গেছে, তাদের ধারনা ছিল যুদ্ধ এখনও চলছে এবং তাদের ওই সাথিকে মিত্রশক্তি ধরে ফেলেছে। এরপরে ওনোডা ও বাকী তিনজন জঙ্গলের আরও গভীরে চলে যায়। এই ঘটনার আরও পাঁচ বছর পর বাকী তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়, বাকী থাকে ওনোডা এবং আর একজন সাথি। আরও সতেরো বছর পর ওনোডা ও তার সাথি যখন আবারও রসদের জন্য গোরিলা হামলার জন্য লোকালয়ে আসে তখন স্থানীয়দের সাথে লড়াইয়ে ওনোডার বাকী সাথিটিরও মৃত্যু হয়, ওনোডা জঙ্গলে পালিয়ে যায়। 

স্থানীয়রা ওই মৃত ব্যক্তির শরীরে জাপানি সেনার পোষাক দেখে স্থানীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে জানায়। এরপর পুরো জঙ্গলে বহুবার তল্লাশি অভিযান চালানো হয়, বিমান থেকে লিফলেট ফেলা হয়। এমনকী হিরু ওনোডার ভাই শিগেও ওনোডাকেও পাঠানো হয় জঙ্গলে হিরু ওনোডাকে খুঁজে বের করার জন্য। শিগেও ওনোডা জঙ্গলে গিয়ে রীতিমতো মাইকিং করে তার ভাইকে খুঁজতে থাকে, শিগেও তার ভাইয়ের জন্য গানও করতে থাকে কিন্ত এসব সত্বেও হিরু ওনোডা বাইরে আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ২৯ বছর বা তিন দশক কেটে গেলেও হিরু ওনোডার মনে ধারনা রয়েই গিয়েছিল যে এখনও যুদ্ধ চলছে। সৌভাগ্যক্রমে একজন ফলিপিন্সের যুবক ওই জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিল সেই ওনোডাকে খুঁজে পায়। ওনোডা প্রথমে তাকে মারতে গিয়েছিল কিন্তু ওনোডা লক্ষ্য করে ওই ছেলেটির পায়ে যে জুতো রয়েছে তা সেনাবাহিনীর মতোন না, তখন ওনোডা ছেলেটিকে মারেনি। ওই ছেলেটি ওনোডাকে সমস্ত ঘটনা জানায় এবং এটাও জানায় ফিলিপিন্স এখম জাপানের অংশ নয়, ফিলিপিন্স একটি স্বাধীন দেশ যার নিজস্ব সরকার রয়েছে। কিন্তু তবুও ওনোডা বাইরে আসতে চায়নি কারন তাকে বলা হয়েছিল জাপানি সেনা তাকে নিতে আসবে। ছেলেটি বাধ্য হয়ে জাপান যায় এবং ওনোডাকে নির্দেশ দেওয়া সেই কম্যান্ডিং অফিসারকে খুঁজে বের করে। সেই অফিসার স্বয়ং লুবাং দ্বীপের জঙ্গলে এসে ওনোডাকে বাইরে আসার জন্য বলে। অবশেষে ১০ মার্চ, ১৯৭৫ সালে ৫২ বছর বয়সী হিরু ওনোডা জঙ্গলের বাইরে আসে এবং ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতির সামনে আত্মসমর্পন করে এবং তার সামুরাই তলোয়ার দেয়। হিরু ওনোডার পরনে তখনও ২৯ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনার পোষাকই ছিল। হিরু ওনোডার উপর ফিলিপিন্সের মানুষের কোন সহানুভূতি ছিল না বরং তারা চাইছিলো তার শাস্তি হোক কারন হিরু ওনোডা ও তার সাথীরা বিগত ২৯ বছরে অন্তত ত্রিশ জন সাধারন ফিলিপিন্সের নাগরিককে হত্যা করেছিল রসদ জোগাড় করতে গিয়ে। কিন্তু ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি হিরু ওনোডাকে ক্ষমা করে দেয় এই কারনে যে ওনোডা জানতোনা যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে, সে দেশের জন্য লড়াই করছিলো। জাপানে হিরু ওনোডাকে রীতিমতো সম্মান দেওয়া হয়, জাপানে প্রবল জনপ্রিয় ছিল হিরু ওনোডা সেসময়। জাপানের সরকার ত্রিশ বছরের হিসাবে মাইনে দেয় হিরু ওনোডা কিন্তু ওনোডা প্রথমে মাইনে নিতে চায়নি, পরে মাইনে নিয়ে দান করে দেয়। নো সারেন্ডার মাই থার্টি ইয়ার নামে একটি বই লিখেছে হিরু ওনোডা যাতে ত্রিশ বছর ফিলিপিন্সের জঙ্গলে কিভাবে কেটেছে, বারবার অভিযান সত্বেও কিভাবে আত্মগোপন করেছিল এব্যাপারে বিস্তারিত বর্ননা দিয়েছে ওনোডা। 

২০১৪ সালে ৯১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হিরু ওনোডার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *