স্ট্রাটেজিক্যালি ভারতবর্ষের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন মঙ্গোলিয়া
আগামী পাঁচ বছরে ভারতের বিদেশনীতিতে মঙ্গোলিয়া ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে। ভারতের কাছে স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন মঙ্গোলিয়া। পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত মঙ্গোলিয়ার সাথে পৃথিবীর দুটি অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়া ও চীনের সীমান্ত রয়েছে। মঙ্গোলিয়া তেল ও বিদ্যুৎ এর জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। ভারত মঙ্গোলিয়াতে একটি শোধনাগার তৈরি করছে যাতে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমে। মঙ্গোলিয়ার পঞ্চাশ শতাংশ বানিজ্যই চীনের সাথে হয়। মঙ্গোলিয়া চীনের থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনে, অন্যদিকে মঙ্গোলিয়া চীনে তামা, কয়লা ও সোনা রপ্তানি করে। মঙ্গোলিয়ায় একটা সময় নৃশংস শাসক চেঙ্গিস খানের রাজত্ব ছিল। তার নাতি কুবলাই খান প্রায় পুরো চীনের উপর শাসন করত, তার সাম্রাজ্যের নাম ছিল ইউয়ান। চীনের বর্তমান কারেন্সির নামও ইউয়ান। ইউয়ান বংশের পতনের পর মঙ্গোলদের ক্ষমতা কমতে থাকে এবং মঙ্গোলরা চীন ছেড়ে বর্তমান মঙ্গোলিয়া অঞ্চলে চলে আসে। এরপর চীনে কিং রাজবংশের রাজত্ব শুরু হয়।১৯১১ সালের সময় চীনের মধ্যে কিং রাজবংশের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতে শুরু করে। এই সুযোগে মঙ্গোলরা স্বাধীনতা দাবি করে। ১৯২১ সাল আসতে আসতে মঙ্গোলিয়াকে সমর্থন করতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মঙ্গোলিয়ায় স্বাধীন সরকার গঠন হয়। কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা বড় প্রভাব ছিল মঙ্গোলিয়ার উপর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পূর্ব এশিয়ায় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন দেখা যায়। চীন মঙ্গোলিয়ার দক্ষিনাংশের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়, এই অংশের নাম ইনার মঙ্গোলিয়া। একটা সময় এখানে বর্তমান মঙ্গোলিয়ার দ্বিগুন মঙ্গোল লোক বসবাস করতো কিন্তু ধীরে ধীরে চীন এখানে নিজের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়। চীনে জিন জিয়াং প্রদেশ, তিব্বত ও ইনার মঙ্গোলিয়া প্রদেশে প্রায়ই স্বাধীনতার দাবি ওঠে যার কারনে চীন এই তিনটি প্রদেশ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। ১৯২১ সালে মঙ্গোলিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয়েছিল কিন্তু ১৯৮৮ সাল আসতে আসতে মঙ্গোলিয়াতে কমিউনিস্ট সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কারন সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমে আসছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেই আভ্যন্তরীন ও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। অবশেষে ১৯৯০ সালে মঙ্গোলিয়ায় গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়, এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য হয় স্বাধীন বিদেশনীতি। কিন্তু একদিকে চীন এবং অন্যদিকে রাশিয়ার মাঝে মঙ্গোলিয়া আবদ্ধ বা ল্যান্ড লকড দেশ। মঙ্গোলিয়ার অবস্থানটাও অদ্ভুত দুই দিকে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশেই গনতন্ত্র নেই, মাঝখানে মঙ্গোলিয়ায় গনতন্ত্র রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ফেঁসে থাকা মঙ্গোলিয়া জানে তার প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার হয়নি এতদিন, যার জন্য মঙ্গোলিয়া রাশিয়া, চীন ছাড়া তৃতীয় একটি শক্তিশালী দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। চীন ইনার মঙ্গোলিয়া দখল করে সেখানকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন করছে এবং সংস্কৃতি পরিবর্তন করছে, এছাড়া চীন ক্রমশ অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে শক্তিশালী হতে থাকায় মঙ্গোলিয়া নিজেও চাপে আছে কারন চীন ভবিষ্যতে পুরো মঙ্গোলিয়া তাদের বলে দখল করতে পারে। চীন এইভাবে অতীতে তিব্বতও দখল করেছে। চীনের প্রত্যেক প্রতিবেশীর সাথেই জায়গা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ইনার মঙ্গোলিয়ায় এখন মঙ্গল জনসংখ্যার অনুপাত ৬ঃ১, মানে প্রতি ছয়জন চাইনিজ প্রতি একজন মঙ্গোলিয়ান। একটা সময় ইনার মঙ্গোলিয়ায় মঙ্গোল ভাষায় পড়ার জন্য ১,৯০,০০০ আসন সংরক্ষিত ছিল, চীন বর্তমানে এই সংখ্যা কমিয়ে মাত্র ১৭,০০০ করে দিয়েছে৷ চীন জানিয়েছে মঙ্গোল ভাষার পরিবর্তে মান্দেরিন ভাষায় পড়তে হবে। ইনার মঙ্গোলিয়ায় রাজনীতি, ইতিহাস সবকিছুই মান্দেরিন ভাষায় পড়ানো হচ্ছে অর্থাৎ চীন পুরো ইনার মঙ্গোলিয়ার জনজীবন ও সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন করছে। চীন এই একই কাজ তিব্বত ও জিন জিয়াং প্রদেশেও করছে। ইনার মঙ্গোলিয়ায় ধর্মীয় স্বাধীনতাও নিয়ন্ত্রন করছে চীন। এই অঞ্চলে চীন তাদের বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরনের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ইনার মঙ্গোলিয়ানরা তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্ম ও দলাই লামার আদর্শকে মানে। চীন দলাই লামার বিরোধী।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মঙ্গোলিয়া সফরের সময় থেকে ভারত ও মঙ্গোলিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হতে শুরু করে। মঙ্গোলিয়ার সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা এবং সিভিল নিউক্লিয়ার বিভাগে চুক্তি রয়েছে। মঙ্গোলিয়ান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষন দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারত ও মঙ্গোলিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে যৌথ সামরিক অনুশীলন নোমাডিক এলিফ্যান্ট সংঘটিত হয়। এছাড়া খান কোয়েস্ট নামে একটি অনুশীলনেও নিয়মিত অংশ নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারত ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে তিনটি বিষয়ে মিল আছে বৌদ্ধ ধর্ম, চীনের সাথে সমস্যা এবং গনতন্ত্র। ভারতের সাথে চীনের সীমানা নিয়ে সমস্যা রয়েছে সেই একই সমস্যা মঙ্গোলিয়ার সাথেও। সুতরাং মঙ্গোলিয়া ও ভারত উভয়েরই উভয়কে দরকার এটা স্বাভাবিক। মঙ্গোলিয়া চীনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ভারতের সহায়তা চেয়েছে। কারন মঙ্গোলিয়া খুব ভালো করেই জানে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় চীনকে টক্কর দেবার মতোন ক্ষমতা শুধু ভারতেরই আছে। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতে মঙ্গোলিয়াকে গুরুত্বপূর্ন সদস্য হিসাবে ভাবা হচ্ছে। যদি চীনকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করা হয় দেখা যাবে চীন ভারতের আশেপাশের দেশ গুলোকে সাথে আনার চেষ্টা করে ভারতকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। যেমন পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর আগেই চীনের অধীনে চলে গেছে। চীন বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল, মায়ানমার, মালদ্বীপের সরকারকে ভারতের বিরুদ্ধে করবার চেষ্টা করছে। চীনের এই নীতিকে বলা হয় স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি। আসলে চীন পুরো ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায় কারন ভারত মহাসাগরের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের আশি শতাংশ সামুদ্রিক বানিজ্য হয়। তবে ভারতও বসে নেই, চীনকে প্রতিরোধ করবার জন্য ভারতও তাদের নেকলেস অফ ডায়মন্ড নীতি শুরু করেছে। যেখানে ইরানাের চাবাহার বন্দর, ওমানের ডুকাম বন্দর, সেশলসের অ্যাজামসান দ্বীপ, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বন্দর, ইন্দোনেশিয়ার সাবাং বন্দর, ভিয়েতনাম, জাপান এবং শেষে মঙ্গোলিয়া হয়ে ভারতও চীনকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করছে। মঙ্গোলিয়া ভারতের নেকলেস অফ ডায়মন্ড নীতির খুব গুরুত্বপূর্ন অংশ।
চীন রাশিয়া থেকে মঙ্গোলিয়া হয়ে পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া ২ নামে ২,৬০০ কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইন তৈরি করছে যার মাধ্যমে রাশিয়া থেকে এনার্জি আনবে চীন। ভারতের সাথে মঙ্গোলিয়ার কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের অর্থ চীন চাপে থাকবে কারন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত এই পাইপলাইন আটকে দিতে পারবে।মঙ্গোলিয়ায় তামা, সোনা সহ অনেক রেয়ার আর্থ খনিজ পাওয়া যায়। এই রেয়ার আর্থ খনিজ পদার্থ ভারতের সেমিকন্ডাক্টর ক্ষেত্রের জন্য খুবই প্রয়জনীয়। তাছাড়া মঙ্গোলিয়ার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ১৭.৫ শতাংশ। সুতরাং মঙ্গোলিয়া বিনিয়োগের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় জায়গা। মঙ্গোলিয়ায় ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়, ২০০৯ সালে ইতিমধ্যেই ভারত ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে সিভিল নিউক্লিয়ার ডিল হয়েছে যার মাধ্যমে ভারত মঙ্গোলিয়া থেকে ইউরেনিয়াম কেনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চীন যেখানে ছোট দেশগুলোকে লোনের ফাঁদে ফেলে বা জোর করে তাদের ভূমি দখলের চেষ্টা করে আসছে। সে জয়গায় ভারত ছোট দেশ গুলোর সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য চেষ্টা করছে। যার কারনে চীনের জন্য সমস্যায় পড়া মঙ্গোলিয়া সহ ছোট ছোট দেশ গুলো ভারতের সাহায্য চাইছে। ভারত মঙ্গোলিয়ায় তেল শোধনাগার নির্মান করছে যা ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এই প্রজেক্টের প্রথম ধাপ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই প্রজেক্টের জন্য ভারত মঙ্গোলিয়াকে ১.২ বিলিয়ন ডলার অল্প সুদে ঋন দিয়েছে। এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে মঙ্গোলিয়া তাদের প্রয়োজনীয় তেলের ৭০ শতাংশই এখান থেকে পাবে সুতরাং রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমবে।
মঙ্গোলিয়া রেল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে ভারতের সাহায্য চেয়েছে। এর জন্য আরআইটিইএস নামে একটি সংস্থা কাজ করছে। আরআইটিইএস বা রেল ইন্ডিয়া টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনমিক সার্ভিস হল ভারতীয় রেলের অধীনস্থ একটি সংস্থা যারা বিভিন্ন দেশে রেলওয়ে প্রজেক্টে কাজ করে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়ার ৫৫ টি দেশে রেলওয়ে প্রজেক্টে কাজ করছে এই সংস্থাটি। বর্তমানে এখন সংস্থাটি নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মোজাম্বিক, বাংলাদেশ ও বতসোয়ানাতে কাজ করছে।