অফবিট

হামাসের কোমর ভেঙে দিতে ইসরায়েলের অবাক করা অপারেশান

পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র শহর বলা হয় ইসরায়েলের জেরুজালেমকে। ইহুদি, খ্রীষ্টান ও মুসলিম তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র স্থান এই জেরুজালেম। এই শহরে মুসলিমদের পবিত্র আল আকসা মসজিদ রয়েছে, যীশু খ্রীষ্টের জন্ম জেরুজালেমের বেথেলহামে এবং ইহুদিদের পবিত্র ওয়েলিং ওয়াল অবস্থিত, এই কারনে এই শহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন তিন ধর্মের মানুষের কাছে। তবে ফিলিস্তিনিদের সাথে জেরুজালেমের অধিকার নিয়ে ইসরায়েলের বিরোধীতা রয়েছে। ফিলিস্তিন দাবি করে জেরুজালেম তাদের, অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করে জেরুজালেম তাদের রাজধানী কিন্তু গোটা বিশ্ব মানে তেল আভিব ইসরায়েলের রাজধানী। ইহুদিদের ইতিহাস খুবই করুন। বর্তমান ইসরায়েলের ভূমিতেই তাদের আদি ঘর ছিল কিন্তু এখান থেকেই তাদের অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ইহুদিরা রাশিয়া, জার্মানি সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু সব জায়গায় তাদের উপর অত্যাচার করা হয়। জার্মানির নিষ্ঠুর শাসক অ্যাডলফ হিটলার লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ধনী ইহুদিরা বর্তমান ইসরায়েল এলাকায় জমি কিনতে শুরু করে প্যালেস্টইনিদের থেকে। সেসময় বর্তমান ইসরায়েলের জায়গা প্যালেস্টাইনদের অধীনে ছিল। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠিক হয় এখানে ইহুদিদের জন্য স্বাধীন দেশ তৈরি হবে। যার বিরোধীতা শুরু করে আশেপাশের আরব দেশ গুলো। 

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল তৈরি হবার পর থেকে জর্ডান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, মিশরের মতোন আরব দেশ গুলোর সাথে একাধিক বার যুদ্ধ হয়েছে ইসরায়েলের কিন্তু প্রতিবারই লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত হয়েছে আরব দেশ গুলো। ইসরায়েলকে প্রথম থেকেই সমর্থন করে আসছে আমেরিকা, ব্রিটেন। আমেরিকাতে ইহুদিরা সেই ১৯০০ সালের দিকে চলে যায়। একমাত্র আমেরিকাতেই ইহুদিদের উপর কোন অত্যাচার হয়নি। আমেরিকায় যথেষ্ট ইহুদি নাগরিক রয়েছে। এমনকী আমেরিকার রাজনীতিতেও ইহুদিদের প্রভাব রয়েছে। আরব ইসরায়েলের যত যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে ১৯৬৭ এর যুদ্ধ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কারন এই যুদ্ধের পরই ইসরায়েল জর্ডানের থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, সিরিয়ার থেকে গোলান হাইটস এবং মিশরের থেকে সিনাই পেনিনসুলা জিতে নেয়। 

ইসরায়েলের কাছে বারবার পরাজিত হবার পর মিশরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদত ১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়লি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের সাথে ডেভিড ক্যাম্প শান্তিচুক্তি করে যাতে মিশর ইসরায়েলকে মান্যতা দেয়। এই চুক্তির কারনে নোবেল শান্তি পুরস্কার পায় আনোয়ার সাদাত কিন্তু এই চুক্তির কারনেই পরে তাকে হত্যাও করা হয়। মিশরের সাথে এই চুক্তির পর বেশ কিছু আরব দেশ আর ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করা থেকে সরে আসে। কিন্তু ইসরায়েলকে অন্য বিপদের মুখে পড়তে হয়। সন্ত্রাসের সাথে লড়াই শুরু হয় ইসরায়েলের। ঘটনার সূত্রপাত ভূমধ্যসাগরের তীরে গাজা উপত্যকাকে কেন্দ্র করে, এই অঞ্চল ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে বিতর্কিত অঞ্চল হিসাবে ছিল। গাজা উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও নামে একটি সংগঠন তৈরি হয় যার নেতা ছিল ইয়াসির আরাফত। এই সংগঠন মূলত ওয়েস্টব্যাঙ্ক ও গাজা উপত্যকায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে কাজ করত। পরে এই সংগঠন ফাতেহ নামে একটি রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও  পিএলও এর মধ্যে অসলো চুক্তি হশ যাতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা উপত্যকাকে নিয়ে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর সাথেই ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে শান্তির সূচনা হয়। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে এই শান্তি চুক্তি বারবার ভেঙে দেওয়া হয়। বিশেষ করে প্যালেস্টাইনের পিএলও সংগঠন ধীরে ধীরে সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের পর ইসরায়েলের সাথে প্যালেস্টাইন বিরোধ শুরু হয়।

২০০৫ আসতে আসতে প্যালেস্টাইনে আরও একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের উদ্ভব হয় যার নাম হামাস। এরই মধ্যে প্যালেস্টাইনে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ঘটে। ইন্তিফাদা শব্দের অর্থ প্যালেস্টাইনিদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরব হওয়া। প্রথম ইন্তিফাদা ঘটে ১৯৮৭-১৯৯৩ সালে। এই সময় প্যালেস্টাইন স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ঘটে ২০০০ থেকে ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যার কারনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ২০০৩ সাল আসতে আসতে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েল সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেবার পরিকল্পনা শুরু করে। ২০০৪ সালে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্তে শিলমোহর পড়ে এবং ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে ইসরায়েল সেনাবাহিনী ফিরে আসে গাজা উপত্যকা থেকে। কিন্তু ইসরায়েল সেনাবাহিনী প্যালেস্টাইনিদের দাবী মেনে নেবার পরও হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী বিস্ফোরন হতে থাকে। প্যালেস্টাইনে হামাসের এত দ্রুত উত্থান হয় যে ২০০৬ প্যালেস্টাইন সাধারন নির্বাচনে হামাস ফাতেহকে পরাজিত করে। এই ঘটনায় রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যায় ইসরায়েল ও আমেরিকা। 

হামাস ইসরায়েলের সাথে হওয়া পূর্বের সমস্ত চুক্তি অস্বীকার করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ইসরায়েল ও আমেরিকার চাপে ফাতেহ এর সাথে যৌথ সরকার গঠন করে হামাস। হামাসের বিরোধীতা করে ইসরায়েলকে সমর্থন করে মিশর। ২০০৭ সালে ফাতেহর সাথে হামসের ঝামেল শুরু হয় যার করনে ফাতেহ হামাসকে সরিয়ে পুরো গাজা উপত্যকায় সরকার গঠন করে। কিন্তু হামাস জোর করে গাজা উপত্যকা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। ইসরায়েল পুরো গাজা উপত্যকা ঘিরে নেয় যাতে হামাস বাইরে থেকে কোন সহায়তা না পায়  কারন বেশ কিছু দেশ গোপনে হামাসকে অস্ত্র সাহায্য করছিলো। ফলে ২০০৮ সাল থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ২০১১ সালে হামাস ও ফাতেহর মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স শুরু করে। এই অপারেশনে হামসের প্রধান কম্যান্ডো আহমেদ জাবারি এয়ারস্ট্রাইকে মারা যায়। এরপর হামাস ইসরায়েলে একের পর এক রকেট হামলা করতে শুরু করে। এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২১ নভেম্বর মিশর হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল। উভয়পক্ষই সম্মত হয় কিন্তু ২০১৪ সালে আবারও হামাস লুকিয়ে ইসরায়েলে আক্রমন করা শুরু করে। এইসময় প্যালেস্টাইনে নতুন ঐক্যদল ক্ষমতায় আসে। ইসরায়েলের এই দলকে সমর্থন করেনি। এদিকে ২০১৪ সালের ২ জুন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু জানায় ইসরায়েল নতুন সরকারের সাথে কোন শান্তিচুক্তি করবেনা। সেই বছরই তিনজন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরন করে হত্যা করে হামাস। কিন্তু প্রথমদিকে হামাস এই ঘটনা স্বীকার করছিলনা। পরে জানা যায় এই ঘটনার পেছনে হামাসই দায়ী। ইসরায়েল তাদের কোন শত্রুকে ক্ষমা করেনা, এই তিনজন ইসরায়েলি সেনার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ইসরায়েল প্রোটেকটিভ এডজ এবং ব্রাদার’স কিপার শুরু করে। 

অপারেশন প্রোটেকটিভ এডজকে গাজা যুদ্ধও বলা হয়। বেশীরভাগ সন্ত্রাসী প্রধান নেতৃত্বকে গ্রেফতার করা হয়। রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুপক্ষের মধ্যে যা হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ ছিল। উভয়পক্ষের মধ্যেই রকেট হামলা শুরু হয়। হামাসের অধিকাংশ রকেটই ইসরায়েল তার আয়রন ডোম এয়ারডিফেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। ওয়েস্টব্যাঙ্কে সমস্ত হামাস নেতৃত্বকে গ্রেফতার করে ইসরায়েল। মোট তিন দফায় অপারেশন করে ইসরায়েল। প্রথমে ইসরসয়েল এয়ারস্ট্রাইক করে যাতে বহু হামাস জঙ্গির মৃত্যু হয়। এরপর ইসরায়েল সেনা অভিযান শুরু করে যাতে প্রায় দশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়। ২২ থেকে ২৬ আগস্টের মধ্যে হামাস ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গা লক্ষ্য করে প্রায় সাতশো রকেট ছোড়ে, এতে তিনজন সাধারন ইসরায়েলি নাগরিকের মৃত্যু হয়। প্রায় দেড় মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাজা উপত্যকা। 

ইসরায়েলের ৬৭ জন সেনা ও ছয়জন সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়। এছারাও ৪৬৯ জন সেনা ও ৮৭ জন সাধারন মানুষ আহত হয়। অন্যদিকে প্যালেস্টাইনে সাধারন মানুষ ও সন্ত্রাসী মিলিয়ে ২,৩১০ জন মারা যায় এবং প্রায় ১০,৬২৬ জন আহত হয়। মিশর ও জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে অনেক সাহায্য পাঠায় কিন্তু হামাস সাহায্যে আসা কাপড়, ওষুধ, খাবার, জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিস সব নিজেদের লোকেদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে বাকী জিনিস কালোবাজারি করে বিক্রি করে দেয়। ২,৭৩,০০০ প্যালেস্টাইন সাধারন মানুষ জাতিসংঘের বিভিন্ন কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। গাজাতে ১৩৮ টি বিদ্যালয়, ২৫ টি হসপিটাল ধ্বংস হয়ে যায়। জল, খাদ্যের কারনে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৩,৭৩,০০০ বাচ্চাকে মানসিক ভাবে চিকিৎসা করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ২০০ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৬০ কোটি টাকার শস্য নষ্ট হয়ে যায়। গাজাতে ২২০ টি ফ্যাক্টরি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাবস্থা তীব্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাত্র দুই ঘন্টা করে বিদ্যুৎ থাকপ গাজার বিভিন্ন এলাকায়। প্রায় ৯০,০০০ এর বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। 

অন্যদিকে ইসরায়েলের ৫০০০-৮০০০ মানুষ সাময়িক ভাবে ঘরছাড়া হয়। এই পুরো অপারেশনে ইসরায়েলের ২.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। শেষপর্যন্ত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়। এই দেড় মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে হামাস সাড়ে সাত হাজার রকেট ছোড়ে যার বেশীরভাগ ইসরায়েলের আয়রন ডোম আটকে দেয়। ইসরায়েল হামাসের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টার্গেট ধ্বংস করে। হামাসের দশ হাজার রকেটের ভান্ডার ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। অপারেশন প্রোটেকটিভ এডজে ইসরায়েলের ব্যাপক বিজয় হয়, হামাসের কোমড় ভেঙে যায় কিন্তু হামাসের কারনে গাজা উপত্যকার ৬৫ শতাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *