অফবিট

কান কেটে নেওয়ার জন্য যুদ্ধ

“ওয়ার অব জেনকিন্স ইয়ার” কি নাম শুনতে অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত লাগলেও বিষয়টি ছিল সত্য। ঘটনাটি ছিল জেনকিন্স নামের এই ব্যক্তির কান কেটে নেওয়া হয়েছিল, যার কারনে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে ছিল। কেন স্পেনের অফিসার কেটে নিয়েছিল জেনকিন্সের কান? অবশেষে এই যুদ্ধের পরিনতি কি এসে দাঁড়িয়েছিল? 

আঠারোশ শতকের প্রথমদিকে আমেরিকায় ব্রিটেন এবং স্পেনের কলোনির দখল করা বিভিন্ন জমি-জমার অংশ নিয়ে ঝামেলা লেগেই থাকত। তবে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা ব্রিটেন অধিকৃত ‘জর্জিয়া’ এবং স্পেন অধিকৃত ‘ফ্লোরিডা’ এর সীমানা নিয়ে তৈরি হয়েছিলো। এই ঝামেলার ফলস্বরূপ হিসাবে মাঝে মধ্যে দেখা যেত সমুদ্রে তাদের জাহাজগুলোর মধ্যে দুই-চারটা কামানের গোলা আদানপ্রদান হতে।

ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি অনুসারে আমেরিকার স্পেন অধিকৃত অঞ্চলের বন্দরে ব্রিটেনের জাহাজ বিভিন্ন পণ্য এবং ক্রীতদাস বিক্রয় করতে পারতো। কিন্তু এই কাজটি করতে হয়রানি শিকার হতে হত প্রতিপক্ষ দেশের জাহাজকে। ব্রিটেন এবং স্পেনের  রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষ দেশের জাহাজে উঠে কোস্ট-গার্ড অফিসাররা তাদের হয়রানি করা শুরু করতো। আর এই রকমই ঘটনার শিকার হয়েছিল প্রতিপক্ষ দেশের জাহাজের ক্যাপ্টেন ‘রবার্ট জেনকিনস’। তবে তাকে শুধুমাত্র হয়রানির শিকার হতে হয় নি তার সাথে তাকে খোয়াতে হয়েছিল তার কান। কোস্ট-গার্ড অফিসার জেনকিনসের কান কেটে নেওয়ার কারনেই পরবর্তীকালে শুরু হয়েছিল এক ভয়ানক যুদ্ধ।

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭৩১ সালে। কিন্তু সেই সময় বিষয়টিকে পাত্তা দেয়নি ব্রিটিশরা। তবে এই ঘটনাটি যে তাদের জন্যও লজ্জাজনক বিষয় সেটি বুঝতে ব্রিটিশদের সময় লেগে গিয়েছিল সাত বছর। 

কিভাবে যুদ্ধ বাঁধলো? 

১৭৩৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের মধ্যে শান্তি পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্তু এতটা শান্তি হয় তো সহ্য হল না ব্রিটিশদের। যার ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিলো স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার, কারন তাদের  সাথে স্পেনের সেই  মূহুর্তে সম্পর্কের সমীকরণ একদমই ভালো ছিল না। তবে প্রশ্ন হল কি নিয়ে যুদ্ধ করবে স্পেনের সাথে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পার্লামেন্টে শুরু হল আলোচনা। সেই সময় তাঁদের কাছে বেরিয়ে আসে গত সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া স্প্যানিশদের জেনকিনসের কান কেটে নেওয়ার কাহিনীটি। এরপরই পার্লামেন্টে জেনকিনসকে ডাকলো শুনানি করে এই ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার জন্য। সেই শুনানিতে জেনকিনস আসার পর সবাই যখন দেখে যে তিনি শুনানির কোনো কিছু ঠিকঠাক মতো শুনতেই পারছেন না সেই সময়ই অর্থাৎ সাত বছর পর ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের লজ্জায় কান কাটা যায়। এরপরই ব্রিটিশরা ১৭৩৯ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 

এই যুদ্ধটি চলেছিল প্রায় দুই বছরের মতো। তবে উল্লেখ করার মতো কোনো কিছুই ঘটেছিল না দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে। ফ্লোরিডা এবং জর্জিয়ায় যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাতে খুব এটা সুবিধা লাভ করতে পারেনি কোনো পক্ষই। ব্রিটিশরা নিউ গ্রানাডায় (বর্তমানের কলাম্বিয়া) আক্রমণ করলে তাতে সফলতা লাভ করলেও সফলতার স্বাদ নেওয়ার জন্য বেঁচে ছিল না কেউ, কারন মাস-খানেক পরে জঙ্গলের ভেতরে মশার কামড় খেয়ে অসুখে ভুগে মারা গিয়েছিল সবাই। ক্যারিবিয়ান উপসাগরে এবং ভেনিজুয়েলার উপকূলে সংঘটিত হয়েছিল বেশ কিছু যুদ্ধ। তবে সেই যুদ্ধে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই ঘটেছিল না।   

১৭৪২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা সরাসরি স্পেন আক্রমণের চিন্তা করেনি যা করেছে তারা বাইরে করেছে। কিন্তু কেন সরাসরি স্পেন আক্রমণ করেনি? কারণ তারা ভীত ছিল এই নিয়ে যে, যদি স্পেন আক্রমণ করলে তাদের সাথে ফ্রান্স যোগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে। কিন্তু ওই বছরই পুরো চিত্রপট বদলে গেল। জেনকিনসের কান নিয়ে যুদ্ধটা শুরু হলেও ওই সময় তার রূপ পরিবর্তন হয়ে যায় অর্থাৎ এই যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত গড়ালো অস্ট্রিয়া এর উত্তরাধিকারীর যুদ্ধে। গোটা ইউরোপ জুড়ে সৃষ্টি হল এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির। ব্রিটিশরা পূর্বে যা ভেবেছিল সেটাই ঘটল স্পেনের পক্ষ নিয়ে ফ্রান্স যুদ্ধ করতে নেমে গিয়েছিল। এই যুদ্ধটি ১৭৫৬ সাল থেকে ১৭৬৩ সাল অর্থাৎ এই যুদ্ধ হতেই উদ্ভূত হলো ইতিহাসের দীর্ঘ সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধের।

যুদ্ধে কে জয় লাভ করেছিল? কে পরাজিত হয়েছিল?

যদি এই যুদ্ধে ইউরোপের যোগদানের পূর্বে যে দুই বছর ধরে ব্রিটেন এবং স্পেনের মধ্যে ‘জেনকিনসের কান নিয়ে যুদ্ধ’ চলেছিল তার ফলাফল বিচার করা হয় তাহলে বলা যেতে পারে যে কোনো পক্ষই জয় লাভ করতে পারেনি। তবে এরপর এই যুদ্ধটি গোটা  ইউরোপ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো ‘অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ’ হিসাবে। এই  ‘সাত বছর ব্যাপী যুদ্ধ’ এর ফলাফল হিসাবে দেখা গিয়েছিল যে ব্রিটিশরা সুপারপাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এছাড়াও ব্রিটিশরা আমেরিকার উত্তর অংশে তাদের দাবি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *