অফবিট

শরনার্থী সমস্যা বাড়বে অস্ট্রেলিয়ায়। জানুন বিস্তারিত

বিশ্ব রাজনীতিতে দুর্বল ও ছোট দেশগুলোর তেমন কোন প্রভাব নেই, সোজা কথায় শক্তিশালীকেই সবাই সম্মান করে। ঠিক এই অবস্থাই হয়েছে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর। এইসব দেশ গুলির শাসকদের বক্তব্য তারা সমান মর্যাদা পাচ্ছেনা। জাতিসংঘে প্রত্যেক স্বাধীন দেশেরই সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ঔ সবদেশ গুলোর দাবি তাদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। তবে এসব দেশ গুলোর অধিকারের জন্য ভারত বারোটি বিশেষ পরিকল্পনা ঘোষনা করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাপান হয়ে পাপুয়া নিউ গিনি যান এবং সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যান। এই পুরো দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্যই ভারত বারোটি পরিকল্পনা ঘোষনা করেছে। এউ অঞ্চলে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ দেশ রয়েছে যাদের মিলিত আয়তন পনেরো মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই অঞ্চল। ভারত চাইছে এই অঞ্চলে তার কুটনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে যাতে জাতিসংঘে এইসব দেশ গুলোর ভোট পাওয়া যায়। দক্ষিন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে তিনভাগে ভাগ করা হয় মাইক্রোনেশিয়া, মেলেনেশিয়া ও পলিনেশিয়া। মাইক্রোনেশিয়াতে প্রথম থেকেই আমেরিকার প্রভাব ছিল। মেলেনেশিয়া ও পলিনেশিয়ার দায়িত্ব আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে দিয়ে রেখেছিল। তবে সম্প্রতি পলিনেশিয়াতে আমেরিকার উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে, টোঙ্গাতে আমেরিকা একটি দূতাবাস খুলেছে। হঠাৎ করেই ভারত ও আমেরিকা দক্ষিন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে হঠাৎই চিন্তাভাবনা শুরু করেনি এর পেছনে আছে বিশ্ব রাজনীতির এক বড় সমীকরন যার নেপথ্যে রয়েছে চীন।

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যৌথ ভাবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল বলা হয় যা বর্তমানে ভূ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ভারত মহাসাগর যেমন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন, ঠিক তেমনি দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগর অস্ট্রেলিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু এই দুই অঞ্চলের ছোট ছোট দেশ গুলোকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছে চীন। যার কারনে ইতিমধ্যেই ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে কোয়াড জোট গঠন হয়েছে চীনকে প্রতিরোধের জন্য। ২০২২ সালে চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে জানায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীনকে সমর্থন করতে এবং তাদের সামুদ্রিক অঞ্চল ও ভূমি চীনকে ব্যাবহার করতে দিতে। এর বদলে চীন সোলোমন দ্বীপপুঞ্জকে অর্থনৈতিক সহয়তা করবে। সোলোমন দ্বীপপুঞ্জ ওয়াং ই এর প্রস্তাবে প্রথমে সম্মত হয়েছিল। ২০২২ সালেই সোলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাথে চীনের একটি নিরাপত্তা চুক্তির কথা প্রকাশিত হয়েছিল যা অস্ট্রেলিয়ার জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল কারন দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়া এই অঞ্চলের দেশ গুলোকে আর্থিক সহায়তা করে এসেছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সাহায্য করেছে। চীনের সাথে তাইওয়ানের বহু দিন থেকেই ঝামেলা আছে সেই পিপলস রিপাবলিক অফ চীন গঠনের সময় থেকেই। চীন তাদের এক চীন নীতি অনুযায়ী তাইওয়ানকে তাদের অংশ হিসাবেই দাবি করে আসছে কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের আসল চীন দাবি করে। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরে বেশ কিছু দেশ এক চীন নীতিকে সমর্থন করে আবার বেশ কিছু দেশ চীনকে সমর্থন করে। চীন চায় এখানে সব দেশই তাদের সমর্থন করুক। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরে ছোট ছোট দেশ গুলো যেমন ক্রিব্যাটি দ্বীপপুঞ্জ, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মোট ছোট ছোট দেশগুলো বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশ গুলোর মধ্যে পড়তে চায় না, তারা চায় আর্থিক উন্নয়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাঁচতে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে যার কারনে এই সব দ্বীপরাষ্ট্র গুলোর ডুবে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন এসব দেশ গুলোকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যার কারনে এরা চীনকে সমর্থন দিচ্ছে। যেমন সলোমন দ্বীপপুঞ্জকে চীন একটি নতুন চুক্তি করতে বলেছে যাতে বলা হয়েছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ চীনের যুদ্ধজাহাজকে এখানে দাঁড়াবার অনুমতি দেবে। চীন এখানে সরাসরি মিলিটারি বেস বানাবে না কিন্তু চীনের যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি থাকবে। চীন সোলোমন দ্বীপপুঞ্জে পুলিশ প্রশিক্ষন কেন্দ্র তৈরি করার পাশাপাশি নিজেদের সেনা মোতায়েন করবে সোলোমন দ্বীপপুঞ্জকে আভ্যন্তরীন ভাবে রক্ষা করতে। তবে সরাসরি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এখানে আসবেনা বরং উপকূল রক্ষা বাহিনী আসবে। অস্ট্রেলিয়ার এত কাছে চীনের যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিত স্বাভাবিক ভাবেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে অস্বস্তির কারন। এই চুক্তির কথা প্রকাশ হতেই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত সহ দেশগুলো সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সাথে কথা বলে যাতে আপাতত চীনের এই চুক্তি স্থগিত আছে। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে চীন কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে এখানে। 

১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়,এই বিস্তীর্ন অঞ্চলের সিংহভাগ এলাকায় জাপানের নিয়ন্ত্রন ছিল, সেসময় চীনেরও বেশ কিছু অংশ জাপানের দখলে ছিল। এসব দেশ জাপানিজ অত্যাচারের সাক্ষী। এরই সুযোগ নিয়ে চীন এসব দেশ গুলোকে কোয়াডের বিরুদ্ধে বোঝাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই অঞ্চলের তেমন কোন গুরুত্ব ছিলনা তবে চীন এই এলাকায় নতুন করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করছে। দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চোদ্দটি স্বাধীন দেশ এবং সাতটি অঞ্চল রয়েছে বিভিন্ন দেশের যা বিশ্বের মোট স্থলভাগের পনেরো শতাংশ। এখানকার মোট জনসংখ্যা প্রায় তেরো মিলিয়ন। এই সব এলাকায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা। ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র এবং একটি দেশের থেকে অন্য দেশটির দূরত্ব বেশী হওয়ায়, আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির কারনে এই সব দেশে কোন বড় সংস্থা বিনিয়োগ করছে না, ফলে দেশ গুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে চলেছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনেও প্রচুর সমস্যা রয়েছে। এই অবস্থায় এগিয়ে এসেছে চীন। চীন নিজেও জানে এসব সমস্যা কোনওদিন মিটবে না কিন্তু চীন এখানে তার সেই পুরোনো লোনের ফাঁদ বা ডেব্ট ট্রাপ নীতি প্রয়োগ করছে। চীন দেশগুলোকে প্রচুর ঋন দিচ্ছে বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর তৈরি করতে যার নির্মান কাজ চীনা সংস্থা গুলিই পাচ্ছে। যদি দেশ গুলো ঋন শোধ করতে না পারে তাহলে সেগুলো চীনই ব্যাবহার করবে অর্থাৎ সুচতুর ভাবে চীন সামরিক বেস তৈরি করছে। চীন এসব দেশের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের অর্থের মাধ্যমে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করছে যাতে দেশগুলোতে দূর্নীতি বৃদ্ধি পায়, ফলে দেশের আর্থিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে। যার ফলে এসব দেশের মানুষ অদূর ভবিষ্যতে অস্ট্রেলিয়ায় পালাবে। এসব দেশ গুলো থেকে অস্ট্রেলিয়া খুবই কাছে। যেমন পাপুয়া নিউ গিনি থেকে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে। চীন কয়েক হজার কিলোমিটার দূর থেকে সমস্যা তৈরি করবে যার ফলে শরনার্থী সমস্যা বাড়বে অস্ট্রেলিয়ায়। যার কারনে আমেরিকা সহ তার মিত্র দেশ গুলে এই অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছে।

যার কারনে ভারত বারো দফা পদক্ষেপ নিয়েছে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ গুলোর জন্য :— 

১) ফিজিতে ভারত একটি সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল তৈরি করছে সম্পূর্ন নিজের খরচে এবং সেখানকার কর্মীদের প্রশিক্ষনও দিচ্ছে। 

২) এই অঞ্চলের চোদ্দটি দেশে ভারত বিশেষ ডায়ালিসিস ইউনিট তৈরি করছে।

৩) চোদ্দটি দেশকে ভারত সামুদ্রিক অ্যাম্বুলেন্স দিচ্ছে।

৪) পাপুয়া নিউ গিনিতে ২০২৪ থেকে প্রতি বছর দুই বার করে জয়পুর ফুট ক্যাম্প করবে ভারত সরকার ও বেশ কিছু ভারতীয় সংস্থা যেখানে স্থানীয়দের চিকিৎসা হবে।

৫) জন ঔষধি কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে যেখানে কম মূল্যে বা বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যাবে।

৬) যোগ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। 

৭) পাপুয়া নিউ গিনিতে আইটি কেন্দ্র তৈরি করছে ভারত যেখানে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়েও শেখানো হবে।

৮) ফিজিতে ২৪×৭ সাহায্য কেন্দ্র তৈরি করছে ভারত।

৯) ভারত এই অঞ্চলে ছোট ও মধ্যম ব্যাবসায়িক কেন্দ্র তৈরি করছে যার ফলে দেশ গুলোর আর্থিক বিকাশ হবে। ভারত নিজেই যান্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি সহায়তা দিচ্ছে। এই একই পদক্ষেপ ভারত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও শুরু করেছে। 

১০) এই অঞ্চলের দেশ গুলোর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাড়িতে সোলার প্যানেল ইনস্টল করছে ভারত।

১১) পানীয় জল সরবরাহের ব্যাবস্থা করছে ভারত।

১২) সাগর আমরুত স্কলারশিপ প্রজেক্ট ভারত আগামী পাঁচ বছরে এই অঞ্চলের  ১০০০ জনকে কারিগরি প্রশিক্ষন দেবে।

চীনকে প্রতিরোধ করবার জন্য কোয়াড এখানে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। তবে চীনের কোনও কুটনীতি তেমন সফল হয়নি। ভানুয়াতু ছাড়া এই অঞ্চলের কোনও দেশই চীনের কাছ থেকে ঋন নেয়নি এখনও পর্যন্ত কারন চীনের অভিসন্ধি সব দেশই বুঝে গেছে। চীনের থেকে কম সুদে ঋন এসব দেশগুলো ভারত, আমেরিকা থেকেই পেয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *