মহাকাশে রাজ করতে চলেছে ভারতবর্ষ
প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন মিলিটারি ফোর্সের মধ্যে বায়ুশক্তির সঠিক মূল্যায়ন এবং তার সঠিক ব্যবহার সবচেয়ে কঠিন। ভারতীয় বায়ুসেনার প্রাক্তন এয়ার মার্শাল দিপ্তেন্দু চৌধুরী জানান প্রায় আট দশক পরে উইনস্টন চার্চিলের এই কথা একবারে সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছে বিশেষ করে ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষেত্রে। কারন বিশ্বের সকল বড় বড় সামরিক শক্তিশালী দেশগুলো তাদের মিলিটারি ফোর্সে দীর্ঘদিন ধরেই শক্তিশালী বায়ুসেনা রেখেছে। কিন্তু ভারতের শত্রু পাকিস্তান ও চীন হওয়ায়, ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকেন্দ্রিক নিরাপত্তায় জোর দিয়েছে অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী তুলনামূলক ভাবে বেশী শক্তিশালী। কিন্তু কিছুদিন আগে ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের নতুন ডকট্রিন প্রকাশ করেছে যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রোডম্যাপ বিয়ন্ড ২০২২ নামক এই ডকট্রিনে প্রযুক্তিগত ও স্ট্রাটেজিক ভাবে ভারতের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি শক্তিশালী বায়ুসেনা গড়ে তোলবার কথা বলা হয়েছে। ৯৪ পাতার এই ডকট্রিনে ভারতীয় বায়ুসেনার এয়ার পাওয়ার থেকে এরোস্পেস পাওয়ার তৈরি করবার ব্যাপারে বিশদে বলা হয়েছে। যার ফলে ভারতীয় বায়ুসেনার শক্তি বৃদ্ধি পাবে ও ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। ভারতীয় বায়ুসেনার এই নতুন ডকট্রিন ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ভারতের তিনবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী হচ্ছে, এই ভারতীয় বায়ুসেনা আকাশপথে ভারতের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে এবং প্রয়োজনে শত্রুর সাথে যুদ্ধ এবং নজরদারি করে। ভারতীয় বায়ুসেনার স্থাপনা হয় স্বাধীনতার আগে, ১৯৩২ সালের ৮ অক্টোবর, তখন একে রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স বলা হত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। স্বাধীনতার পরও ভারতীয় বায়ুসেনার নাম রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সই ছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালে সংবিধান গ্রহন হবার পর রয়্যাল শব্দটি সরিয়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স নাম রাখা হয়। বহু যুদ্ধে ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের দক্ষতা প্রমান করেছে। আকাশ যুদ্ধে অসাধারন দক্ষতার কারনে ভারতের সম্মান বাড়িয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৫৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ এ ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের সুনিপুন দক্ষতার সাথে পাকিস্তানকে বারবার পরাজিত করেছে। অপারেশন বিজয়, অপারেশন মেঘদূত, অপারেশন ক্যাকটাস থেকে বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের মতোন বিখ্যাত সব মিশন করেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। স্থাপনার পর থেকেই ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের নীতি টাচ দি স্কাই উইথ গ্লোরিকে সমার্থ করে আসছে। ভারতীয় বায়ুসেনা ছাড়াও ভারতের নিরাপত্তায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় নৌবাহিনীও সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে। প্রাক্তন ভারতীয় এয়ারমার্শাল দিপ্তেন্দু চৌধুরী বলেন ডকট্রিন ভারতীয় বায়ুসেনার রোডম্যাপ, যার মাধ্যমে ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের প্রশিক্ষন এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন নীতি প্রকাশ করে। প্রত্যেকবার নতুন ডকট্রিন তৈরির আগে বিশ্বের পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করা হয়। নতুন কী ধরনের প্রযুক্তি এসেছে? এবং যুদ্ধে তার কী প্রভাব পড়বে? সেই অনুযায়ী নতুন ডকট্রিন তৈরি করা হয়।
১৯৯৫ সালে ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের প্রথম ডকট্রিন প্রকাশ করেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৯৮ ও ২০০৪ এবং ভারতীয় নৌবাহিনী ২০০৪ সালে তাদের ডকট্রিন প্রকাশ করেছিল। ভারতীয় বায়ুসেনা ২০০৭ এবং ২০১২ তে তাদের নতুন ডকট্রিন প্রকাশ করেছিল। এবারের নতুন ডকট্রিনে তিনটি বিভাগে জোর দেওয়া হয়েছে এয়ার পাওয়ার থেকে এরোস্পেস পাওয়ারে পরিনত হওয়া, যুদ্ধে জয়লাভ করতে শক্তিশালী বায়ুসেনার ব্যবহার এবং যৌথ সামরিক নীতি। বিগত কয়েকবছর ধরে ভারতীয় বায়ুসেনাকে শক্তিশালী করবার পাশাপাশি মহাকাশ ক্ষেত্রেও ভারত উল্লেখযোগ্য কাজ করছে। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে ভারতের আকাশসীমা সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি মহাকাশেও ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সেজন্য ভারতীয় বায়ুসেনা ধীরে ধীরে বায়ু ও মহাকাশ সেনা হিসাবে তৈরি হচ্ছে।
কারন ভবিষ্যতের যুদ্ধ শুধু স্থল, জল ও আকাশে সীমাবদ্ধ না থেকে মহাকাশেও হবে। সেজন্য বিশ্বের সমস্ত সামরিক শক্তিশালী দেশগুলো মহাকাশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তবে এক্ষেত্রেও বাকী সবার থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কয়েক যোজন এগিয়ে। কারন মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট গুলো রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকদেশই নিজস্ব মহাকাশ সেনা তৈরি করছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং আগেই বলেছেন সময় এসেছে ভারতীয় বায়ুসেনাকে মহাকাশ সেনা হিসাবে আপগ্রেড করার। কারন ভারতের প্রতিপক্ষ চীন মহাকাশকে সামরিক ক্ষেত্র হিসাবে ব্যাবহার করার চেষ্টা শুরু করেছে, সেক্ষেত্রে ভারতকেও তার জন্য প্রস্তত হতে হবে। নতুন ডকট্রিন অনুযায়ী ভারতীয় বায়ুসেনার প্রয়জনে আক্রমন ও প্রতিরোধ অপারেশন একটি আইএসিসিএস বা ইন্ট্রিগেটেড এয়ার কম্যান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ন্ত্রন করবে। এই সিস্টেম তৈরি করতে ২০১৮ সালেই ভারত সরকার ৮০০০ কোটি টাকার ছাড়পত্র দিয়েছে। এই সিস্টেম ভারতীয় বায়ুসেনার সমস্ত বেস, মহাকাশ, স্থল ও বায়ুতে থাকা ভারতীয় বায়ুসেনার বিমান সহ রেডারকে একসাথে সংযুক্ত করবে এবং স্যাটেলাইট, বিমান ও ভূমিতে থাকা কন্ট্রোল সেন্টারের ডাটা একসাথে পাওয়া যাবে। এছাড়াও এই সিস্টেমের মাধ্যমে ভারতের এয়ারডিফেন্স সিস্টেম গুলোও নির্দেশ পাবে স্বয়ংক্রিয় ভাবে। ভবিষ্যতের যুদ্ধ বা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধে জল, স্থল, আকাশ ও মহাকাশ ছাড়াও অন্য অনেক সেক্টরে হবে যেমন সাইবার অ্যাটাক, ভুল তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, সাথে শক্তিশালী অর্থনীতি গঠন। তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে হাইপারসনিক মিসাইল, লেজার অস্ত্র সহ, শক্তিশালী আধুনিক ড্রোন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইএর মতোন আধুনিক প্রযুক্তি আসছে যার করনে ভারতীয় বায়ুসেনাতেও এসব প্রযুক্তি ইনস্টলের কাজ চলছে।
ভারত স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধ নয় শান্তিতেই বিশ্বাস করে এসেছে। সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ব যখন আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তখনও ভারত কোন পক্ষেই যোগ না দিয়ে জোট নিরপেক্ষ ছিল। তবে তার মানে এই নয় যে ভারত শক্তিশালী ছিলনা, যতবারই পাকিস্তান ভারত আক্রমন করেছে ততবারই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী অসাধারন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে এবং পাকিস্তানকে লজ্জাজনক ভাবে পরাজিত করেছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান ও চীনের সহযোগিতায় বারবার বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ভারতে আক্রমনের চেষ্টা করে আসছে এবং বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব আবারও দুইভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
ভারত মহাসাগরে বহুদিন ধরেই চীন ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, মালাক্কা প্রনালী, দক্ষিন চীন সাগর জুড়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে সেজন্য আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিচারে ভারতীয় বায়ুসেনা তাদের নতুন ডকট্রিনে প্রতিরোধক ভূমিকা ছেড়ে আক্রমনাত্মক হবার কথা ঘোষনা করেছে। ভারতের বায়ুসেনার ডকট্রিনে নতুন যে অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে যৌথ সামরিক নীতি। এই নীতিতে প্রয়োজনে ভারতীয় বায়ুসেনা, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী যৌথভাবে কাজ করবে। এর জন্য চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনিল চৌহান তিন বাহিনীর প্রধানকে থিয়েটার কম্যান্ড তৈরির নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তিন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বজায় থাকে। থিয়েটার কম্যান্ড হচ্ছে বায়ুসেনা, স্থলসেনা ও নৌসেনার যৌথ কম্যান্ড। অর্থাৎ কোন যুদ্ধে একজন কম্যান্ডারই তিন বাহিনীর সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রন করবে, একেই থিয়েটার কম্যান্ড বলে। আমেরিকার এগারোটি থিয়েটার কম্যান্ড আছে, চীনের পাঁচটি থিয়েটার কম্যান্ড আছে। চীন তাদের পশ্চিম থিয়েটার কম্যান্ড দিয়ে ভারতের উপর নজর রাখে। ভারতেও চারটি থিয়েটার কম্যান্ড তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তবে থিয়েটার কম্যান্ড শব্দ ভারতের জন্য নতুন নয়। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ২০০১ সাল থেকেই ভারতের তিন বাহিনী একসাথে কাজ করে। এছাড়া ভারতের স্ট্রাটেজিক ফোর্স কম্যান্ডও থিয়েটার কম্যান্ড যারা ভারতের পরমানু অস্ত্র নিয়ন্ত্রন করে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের বায়ুসেনাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারেনি সেজন্য এই ঘটনাকে পর্যবেক্ষন করে ভারতীয় বায়ুসেনাও এমন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করছে। লাদাখে চীনের সাথে সংঘর্ষের সময়ও এখানে ভারতীয় বায়ুসেনা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। বায়ুসেনাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ভারত যথেষ্ট পরিমান এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম, রিফিউলার বিমান এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম কিনছে।