ইসরায়েল বারবার তার শত্রুদের খতম করেছে, আজও করছে। প্যালেস্তাইনকে সন্ত্রাস মুক্ত করতে ইসরায়েলের এক অসাধারন অপারেশান
দিনটা ২৮ মার্চ, ১৯৭৮, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ হত্যা করে শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী ওয়াদি হাদাদকে। এই অপারেশন সফল হয়, তবে এরই মধ্যে ইসরায়েলের দিকে আরও একটি সংকটে ছিল। ইসরায়েলের আরও একটি গোয়েন্দা সংগঠন সিনবেট এক এজেন্টের মাধ্যমে খবর পায় প্যালেস্তাইনের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ইসরায়েলে সন্ত্রাসী আক্রমনের পরিকল্পনা করছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে সিনবেট এবং দেশের বাইরের সমস্ত বিভাগের দায়িত্বে থাকে মোসাদ। এই দুই সংগঠনই একে অপরের সাথে যৌথভাবে কাজ করে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থার ডিরেক্টর আমোস গিলাদ সেই এজেন্টের সাথে জেরুজালেমে দেখা করে সমস্ত তথ্য দেখেন। সেই এজেন্টের ছদ্মনাম হাউসমেড। সে গিলাদকে একটি ফাইল দেয় যেখানে প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসী সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট বা পিএলও সাইপ্রাসে ইসরায়েলে আক্রমনের পরিকল্পনা এবং পিএলওর বেশ কিছু নেতার নাম ছিল। ইয়াসির আরাফত ও আবু জিহাদ নামে দুই পিএলও লিডার এই পুরো অপারেশনের দায়িত্বে ছিল। এই সংগঠনের কেন্দ্র ছিল লেবাননে।
১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ ইসরায়েল নেভির কম্যান্ডো টিম লেবাননে পিএলওর ঘাঁটিতে অপারেশন করে যাতে বেশ কিছু পিএলও সদস্য নিহত হয়। তবে আমোস গিলাদ তখনও সন্তষ্ট না হওয়ায় সেখানে আবারও অপারেশন করাতে চাইছিল কিন্তু ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়াশিংটন সফরে যাওয়ায় অনুমতি দেওয়া হয়নি আমোস গিলাদকে, এটা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। ১১ মার্চ সকালে ইসরায়েলের হাইফায় সমুদ্র তীরে একটি নৌকায় করে কিছু লোক আসে। প্রায় তিনদিন ধরে সমুদ্রে থেকে তারা তীরে পৌঁছায়। সেই নৌকা থেকে নেমে এক ব্যাক্তি একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করে জায়গাটা হাইফা কীনা? জবাব দেওয়ার পরই মহিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আসলে এই নৌকায় থাকা লোকগুলো পিএলওর সদস্য। আবু জায়েদ ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবের একটি হোটেলে আক্রমন করবার উদ্দেশ্যে তাদের পাঠিয়েছিল। কিন্তু তারা পরে পরিকল্পনা পাল্টে দুটি বাসকে হাইজ্যাক করে তেল আভিবের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর গিয়েই ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের এনকাউন্টার শুরু হয়। মোট এগারোজন পিএলও সন্ত্রাসী এসেছিল ইসরায়েলে, একাউন্টার চলাকালীনই একজন সন্ত্রাসী বাসের মধ্যেই হ্যান্ড গ্রেনেড বাস্ট করায় যাতে ঘটনাস্থলেই ৪৮ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৩৮ জন ইসরায়েলি নাগরিক ও দশজন সন্ত্রাসী। মৃত্যু হওয়া লোকেদের মধ্যে তেরোজন শিশুও ছিল। একজন আহত সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে স্থানীয় হসপিটালে ভর্তি করা হয়। সেখানে সিনবেট অফিসাররা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে এই পুরো ঘটনার মূলে রয়েছে আবু জায়েদ। এই কথা শুনেই সেই আহত সন্ত্রাসীর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেওয়া হয় এবং সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়।
১৯৭৮ এর দিকে ইসরায়েলের সাথে মিশরের ধীরে ধীরে যোগাযোগ শুরু হয়েছিল। আবু জায়েদ এই সম্পর্ক ভাঙার জন্য এই পরিকল্পনা করেছিল। কারন একসময় প্যালেস্টাইনের বড় বন্ধু ছিল মিশর। এরপরই পুরো লেবানন জুড়ে পিএলওকে খতম করার জন্য একের পর এক মিশন শুরু করে ইসরায়েল।
১৯৭৮ সালে ইসরায়েলে এই সন্ত্রাসী আক্রমনে ইসরায়েলের সরকারের উপর চাপ বাড়ে পিএলওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল সেনাবাহিনী ও বিশেষ বাহিনীকে লেবাননে পিএলও এর ঘাঁটিতে আক্রমনের আদেশ দেয়। ১৪ মার্চ ইসরায়েল সেনাবাহিনী অপারেশন লিথানী শুরু করে যাতে দক্ষিন লেবাননে পিএলওর ঘাঁটিতে অভিযান করা হয়। লেবাননের লিথানী নদীর তীরে এই অভিযান করা হয়েছিল বলে এর নাম দেওয়া হয় অপারেশন লিথানী। ১৪-২১ মার্চ অবধি চলা এই অভিযানে লেবানন ও প্যালেস্টাইনের ১১০০-১২০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ৩০০ এর বেশী পিএলও সন্ত্রাসী নিহত হয় এই অভিযানে। পুরো দক্ষিন লেবানন থেকে পিএলওকে উৎখাত করে দিয়েছিল ইসরায়েল সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের এই অভিযান, ব্যাপক আকারে মানুষের মৃত্যু হওয়ায়, আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা উঠতে শুরু করে। এরপরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কাউন্টার টেরিরিজম অপারেশন ছোট ছোট বিভাগে বিভক্ত হয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন কথা না ওঠে। লেবাননে আবারও অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার দায়িত্ব দেওয়া হয় নেভাল কম্যান্ডো বিভাগ ফ্লোটিলা ১৩ কে। এর অপারেশনের প্রধান করা হয় ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান জেনারেল রাফু লিথেনকে। এর আগে মোসাদ ও ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের যৌথ মিশন অপারেশন অপেরার কম্যান্ডার ছিল এই রাফু লিথন। ইসরায়েলের নেভির একটি বিশেষ বিভাগ হচ্ছে এই ফ্লোটিলা ১৩, ১৯৪৯ সালে এই বিভাগটি তৈরি করা হয়। সমুদ্রপথে ইসরায়েলের শত্রুদের উপর আক্রমনে পারদর্শী এই বিভাগ। অত্যন্ত কঠিন আঠারো মাসের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এই বিভাগে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ২৩ বার ফ্লোটিলা ১৩ এর কম্যান্ডোরা লেবাননে অপারেশন করেছিল যাতে ১৩০ জন পিএলও সন্ত্রাসী নিহত হয়েছিল এবং একশোর বেশী ঘায়েল হয়েছিল।
১৯৮০ সালের ৫ আগস্ট ফ্লোটিলা ১৩ এর কিছু কম্যান্ডো লেবাননের কাছে পৌঁছে স্নাইপার দিয়ে পিএলও এর শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী আসমি জারিরকে হত্যা করে। আবু জায়েদের ডান হাত আজমি জারির উপরেই দায়িত্ব ছিল ইসরায়েলে ১৯৭৮ সালে আক্রমনের। ১৯৭৮ সালের পর থেকে লেবাননে ইসরায়েল প্রায়ই বিভিন্ন অভিযান করতো যাতে পিএলওর বহু সদস্য নিহত হয়। লেবাননের খ্রীষ্টান রাজনৈতিক দল কাতেবের সাথে গোপনে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল মোসাদ। কাতেবের সদস্যদের প্রশিক্ষন দিয়েছিল মোসাদ, তারা মোসাদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করতো। কাতেবের থেকেই সিরিয়া ও লেবাননে পিএলওর এর সমস্ত তথ্য পেত মোসাদ। কাতেবের সদস্যরা মোসাদের হয়ে কিলিং মেশিন হিসাবে কাজ করত। কাতেবের এক সদস্য রবার্ট হাতেম প্রায় তিন হাজার পিএলও সদস্যকে হত্যা করেছিল।
১৯৭৯ সালের ২২ এপ্রিল কিছু পিএলও সন্ত্রাসী ইসরায়েলের নাহারিয়া শহরে প্রবেশ করে একটি ঘরকে জোর করে দখল করে সেখানে থাকা পরিবারকে হত্যা করে। পুলিশের একাউন্টারে সন্ত্রাসীদের মৃত্যু হয় কিন্তু রাফি লিথেন এই ঘটনার বদলা নিতে আবারও লেবাননে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মীর দোগানকে যিনি পরে মোসাদের প্রধান হয়েছিলেন। তবে এবারের অভিযান একটু ভিন্ন ধরনের ছিল। কারন এবারে পুরো মিশনকে অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল। এমনকী ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এমনকী ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে লুকিয়ে এই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। রাফি লিথেন ও মীরদোগান বিশেষ কিছু এজেন্টকে লেবাননে মোতায়েন করে, তারা পিএলও সদস্যদের গাড়ি ও বাড়িতে টাইম বোম্ব লাগিয়ে দিত, এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই গোটা লেবানন জুড়ে পিএলও সদস্যরা বিস্ফোরনে নিহত হতে থাকে। বলা হয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পূর্ন ভরসা ছিল রাফি লিথেনের উপর, সেজন্য লেবাননে এই অপারেশনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সন্দেহ হলেও তিনি কিছু বলেননি।
১৯৮১ সালের ৫ আগস্ট ইসরায়েলের নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয় অ্যারল শ্যারন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মিশরের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন এইসময় চাইছিল যাতে পিএলও ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয় কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিল রাফি লিথেন ও এ্যারল শ্যারন।
১৯৮১ সালের ১ অক্টোবর লেবাননের রাজধানী বেইরুটে একটি বিস্ফোরন হয় যাতে ৮৩ জনের মৃত্যু হয় এবং একশো জন আহত হয়, কিছুদিন পর পিএলওর হেডঅফিসেও বিস্ফোরোন হয় যাতে বেশ কিছু পিএলও সদস্য মারা যায়। এইসব ঘটনার দায় স্বীকার করে একটি বিদেশী সংগঠন, যদিও পিএলও মোসাদকে অভিযুক্ত করেছিল এসবের জন্য। পিএলওকে আরও ধাক্কা দেবার জন্য রাফি লিথেন ও মীর দোগান অপারেশন অলিম্পিয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই মিশনে পূর্ব বেইরুটের একটি অভিজাত জায়গায় পিএলওর উচ্চপদস্থ অফিসারদের নৈশভোজের স্থানে দুই টন বিস্ফোরক দিয়ে বিস্ফোরনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্ত নৈশভোজ পরে বাতিল হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর মীরদোগান খবর পায় বেইরুট স্টেডিয়ামে পিএলওর স্থাপনা দিবস উদযাপন হবে ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারি। সাথে সাথে অপারেশন অলিম্পিয়া ২ এর পরিকল্পনা করা হয়।
১৯৮১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনজন মোসাদ এজেন্ট স্টেডিয়ামে পিএলও সদস্যদের বসার জায়গার নীচে বিস্ফোরক রেখে দেয়। স্টেডিয়ামের বাইরে একটি ট্রাকে দেড়টন বিস্ফোরক ও দুটি মার্সিডিজ গাড়িতে পাঁচশো টন বিস্ফোরক রাখা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর আদেশে অলিম্পিয়া ২ কে বন্ধ করা হয় কারন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সেখানে আসার কথা ছিল। এরপরেও ইসরায়েল থেমে থাকেনি, ইসরায়েল বারবার তার শত্রুদের খতম করেছে, আজও করছে।