অফবিট

সুলতান মাহমুদের মতো বহুবার বিদেশী দস্যুদের আক্রমণের পরে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের সোমনাথ মন্দির

প্রাচীন কাল থেকেই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ভারত। ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিনে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিভিন্ন দেবী দেবতার প্রচুর মন্দির রয়েছে যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। এইসব মন্দিরে প্রতিদিনই কয়েক লাখ ভক্তের সমাগম হয়। ভারতের প্রত্যেকটি মন্দিরের একটি ইতিহাস আছে। এমনই একটি মন্দির হচ্ছে ভারতের পশ্চিম তীরে গুজরাটের বেরাবলে অবস্থিত বিখ্যাত প্রাচীন শিবমন্দির সোমনাথ। সনাতন হিন্দু ধর্মের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য কার্যের এক অসাধারন নিদর্শন। ভগবান শিবের দ্বাদশ জ্যোর্তি লিঙ্গের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে এই সোমনাথ। ইতিহাসে যখনই কোনও স্থাপত্যের কথা আসে তখন কে সেটা তৈরি করেছে সেটাও বলা হয়ে থাকে কিন্তু হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী এই সোমানাথ মন্দির তৈরি করেছিল ভগবান চন্দ্রদেব। ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯৫১ সালে সোমানাথ মন্দির সম্পূর্ণ নির্মানের আগে অন্তত ছয়বার বিভিন্ন বিদেশী দস্যু দ্বারা এই মন্দিরের উপর আক্রমন হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন  সময়ে বিভিন্ন রাজা এই মন্দির পুননির্মান করেছিলেন। কিন্তু সোমানাথ মন্দির প্রথম কবে তৈরি হয়েছিল সেই তথ্য এখনও জানা যায়নি। তবে ধারনা করা হয় নবম শতকের এর আগে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল। পুরো সোমানাথ মন্দির তিনটি ভাগে বিভক্ত, গর্ভ গৃহ, সভা মন্ডপ এবং নিত্য মন্ডপ। সোমনাথ মন্দিরের চূড়া ১৫০ ফুট উঁচু, চূড়ায় থাকা কলসের ওজন দশ টন এবং মন্দিরের প্রধান পতাকা ২৭ ফুট উঁচু। সনাতন ধর্মের এই অসাধারন সোমনাথ মন্দির সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

কপিলা, হিরন ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমে অবস্থিত এই সোমনাথ মন্দির প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান। এই স্থান অতীতে প্রভাস তীর্থ নামে বিখ্যাত ছিল। সোমনাথ মন্দিরে সোমেশ্বর মহাদেবের আরাধনা করা হয়। সোমনাথ অর্থ চন্দ্রদেবের রক্ষাকর্তা। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী প্রজাপতি দক্ষের ২৭ কন্যার সাথে চন্দ্রদেবের বিয়ে হয়েছিল, এদের মধ্যে রোহিনীকে চন্দ্রদেব সবচেয়ে বেশী ভালোবাসত, কিন্ত এই জন্য তার বাকী ২৬ জন স্ত্রী বারবার তাদের পিতাকে অভিযোগ জানাতো। প্রজাপতি দক্ষ এরপর চন্দ্রদেবের এমন আচরনের কারনে তাকে ক্ষয়ে যাবার অভিশাপ দেয়। তখন চন্দ্রদেব এই স্থানে মহাদেবের উপাসনা করেন, মহাদেব সন্তষ্ট হয়ে ওনাকে অভিশাপ মুক্ত করে দেন। প্রজাপতি ব্রহ্মার আদেশে চন্দ্রদেব এখানে একটি সোনার শিবমন্দির নির্মান করেছিলেন, সেটিই আদি সোমনাথ মন্দির। পরে কালক্রমে রাবন রূপো দিয়ে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চন্দনকাঠ দিয়ে এই মন্দির পুননির্মাণ করেছিলেন। হিন্দু ধর্ম অনুসারে, সময় বা কাল চার ভাগে বিভক্ত সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ এবং কলি যুগ। এখন কলি যুগ চলছে। কলি যুগে সোমনাথ মহাদেব সোমেশ্বর নামে বিখ্যাত হলেও বিভিন্ন কালে ওনার নাম আলাদা ছিল। সত্য যুগে ভৈরবেশ্বর, ত্রেতা যুগে শ্রাবনিকেশ্বর এবং দ্বাপর যুগে শ্রীগলেশ্বর নামে বিখ্যাত ছিলেন এই সোমেশ্বর মহাদেব। নবম শতক থেকে সোমেশ্বর মহাদেবের নাম ইতাহাসে পাওয়া যায়।৮০৫ থেকে ৮৩৩(AD) এডিতে গুর্জর প্রতিহার রাজা নাগভট্ট ২ এর সময়ে সোমেশ্বর মহাদেবের কথা উল্লেখিত আছে। নাগভট্ট ২ সৌরাষ্ট্র উপকূলে অনেক মন্দির দর্শন করেছিলেন তার মধ্যে সোমেশ্বর মহাদেব ছিল। কিছু ঐতিহাসিকদের কথায় চালুক্যরাজ মূলরাজ ৯৯৭ (সিইতে) চন্দ্রদেবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। তবে আবার বেশ কিছু ঐতিহাসিকগন বলেন পুরোনো মন্দিরই পুননির্মান করেছিলেন মূলরাজ। ১৯৫০ সালে এই এলাকায় খননকার্যের সময়ে অনেক পুরোনো সোমনাথ মন্দিরের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন দশম শতকের প্রস্তরখন্ড এবং প্রাচীন সোমনাথ মন্দিরের কিছুটা ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। গুজরাটি ঐতিহাসিক মধুসূদন ঢাকি একে গজনির সুলতান মাহমুদের দ্বারা ধ্বংস হওয়া সোমনাথ মন্দিরের অংশ বলেন। ৬৪৯ সালে গুজরাটের এক যাদব রাজা সোমানাথ মন্দির পুননির্মান করেন। এরপর বহুবার বিদেশী শত্রুদের দ্বারা সোমনাথ মন্দির ধ্বংস হয়েছিল।

৭২৫ খ্রীস্টাব্দে আরব শাসক জুনায়েদ ও তার সেনা এই মন্দির ধ্বংস করে দেয়। তারপর গুর্জর প্রতিহার রাজা নাগভট্ট ২ এই সোমনাথ মন্দির পুননির্মান করেন। তিনি লাল বেলেপাথরে এক বিশাল সুন্দর মন্দির নির্মান করেছিলেন। সোমনাথ মন্দিরের উপর সবচেয়ে বড় আক্রমন হয়েছিল ১০২৬ এডিতে। গজনির সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে জ্যোর্তিলিঙ্গকেও ভেঙ্গে দিয়েছিল। বলা হয় মাহমুদ মন্দির ভেঙ্গে ২০ মিলিয়ন দিনারের সম্পত্তি লুঠ করেছিল। বিখ্যাত পারস্য পন্ডিত আল বিরুনী গজনির সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমনের বিষয়ে লিখেছেন। আল বিরুনী ছাড়াও ইবন জাফির, ইবন আল আথির সহ একাধিক খ্যাতনামা ইসলামিক পন্ডিতগন সুলতান মাহমুদের এই আক্রমনের কথা লিখেছেন। ১০৩৮ সাল আসতে আসতে গুর্জর রাজা মালোয়ার ভোজ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের রাজা প্রথম ভীমদেব এই মন্দিরটি আবার পুননির্মান করেন। তবে আক্রমনের বারো বছরের মধ্যে যে মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল সেটি ছিল কাঠের তৈরি। ১১৫০ সাল নাগাদ বৌদ্ধ রাজা কুমারপাল পাথরের তৈরি অসাধারন সোমনাথ মন্দির তৈরি করেন। ১২৯৯ সালে আলাউদ্দিন খিলজীর সেনাপতি উলুঘ খান গুজরাট আক্রমন করে পুনরায় সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে। মুসলিম ঐতিহাসিক হাসিন নিজামি লিখেছেন খিলজীর সেনা ৫০,০০০ সাধারন মানুষকে হত্যা করে এবং ২০,০০০ লোককে বন্দী করেছিল। খিলজীর সেনা সোমেশ্বর শিবলিঙ্গকে দিল্লি নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু জালোরের চাহমানা রাজা রাওয়াল কানহারে খিলজীর সেনার উপর আক্রমন করে সোমনাথ শিবলিঙ্গ উদ্ধার করেছিলেন এবং সমস্ত বন্দীদের মুক্ত করেছিলেন। ১৩০৮ সালে সৌরাষ্ট্রের রাজা মহীপাল দেব এই মন্দিরটি পুননির্মান করেন। তার পুত্র খেঙ্গর ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ এর মধ্যে জ্যোর্তিলিঙ্গ স্থাপন করেছিল। ১৩৭৫ সালে আবারও গুজরাটের সুলতান মুজফফর শাহ সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে। ১৪৫১ সালে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে। মুঘল আমলেও সোমানথ মন্দিরের উপর আক্রমন করা হয়েছিল। মুঘল সম্রাটরা একাধিক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিল যার মধ্যে সোমনাথ মন্দিরও ছিল। ১৭৮৩ সালে ইন্দোরের মহারানী অহল্যাবাই হোলকার পুনরায় সোমনাথ মন্দিরটি তৈরি করেন। বর্তমান সোমানাথ মন্দির থেকে ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত এই মন্দিরটি পুরোনো সোমনাথ বা অহল্যাবাই মন্দির নামে বিখ্যাত। এভাবে মধ্যযুগীয় সময়ে বারবার আক্রমনের স্বীকার হয়েছিল সোমানাথ মন্দির।

আরবের বিখ্যাত ভূগোলবিদ আসারু বিলাদ লিখেছেন গজনির সুলতান মাহমুদ পর্যন্ত সোমনাথ মন্দিরের ঐশ্বর্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এই মন্দিরে লাখ লাখ হিন্দু দর্শনার্থী আসত। সুলতান মাহমুদ ভেবেছিল সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে দিলেই হিন্দুদের ধর্ম পরিবর্তন করা যাবে। কিন্তু তার ধারনা কতটা ভুল ছিল তা আজ প্রমানিত হয়েছে। মাহমুদের কবরের পাশে খুব সুন্দর চন্দন কাঠের দরজা ছিল। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটা বোধহয় সোমনাথ মন্দিরের দরজা। সেজন্য ব্রিটেনের লর্ড এলেনবোরহ নির্দেশ দেয় এই দরজা খুলে ভারতে আনার জন্য। ১৮৪২ সালে এই দরজা ভারতে আনা হয় তবে পরীক্ষা করে দেখা যায় এটা চন্দনকাঠের দরজা নয় বরং আফগানিস্তানের দেবদারু গাছের দরজা। এই দরজা এখন আগ্রা দুর্গে রাখা আছে। সোমনাথ মন্দিরের এলাকা স্বাধীনতার আগে জুনাগড়ের অংশ ছিল। স্বাধীনতার পর জুনাগড়ের রাজা পাকিস্তানে যোগ দেবার কথা ভাবছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত ভারতে যোগ দেওয়ানো হয় জুনাগড়কে। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৭ সালে সোমানাথ মন্দির পুননির্মানের আদেশ দেন। মহাত্মা গান্ধীও এই সোমনাথ মন্দির পুনর্গঠনের পক্ষে মত দেন। ঔরাঙ্গজেব সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করে সেখানে একটি মসজিদ তৈরি করেছিল। ১৯৫১ সালে নতুন করে মন্দির তৈরির সময় কয়েক কিলোমিটার দূরে মসজিদকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অবশেষে ১৯৫১ সালের মে মাসে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সোমনাথ মন্দিরের শিলান্যাস করেন। বারবার এত আক্রমন সত্বেও আজও সগর্বে সোমনাথ মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। সমাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ক্ষমতা কারও নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *