জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো যে ভয়ঙ্কর শাস্তি গুলির প্রচলন ছিল প্রাচীন রোমে
প্রাচীন দিনে এমন কিছু নিয়ম ছিল যা শুনলে বুকের ভেতর কেঁপে উঠবে। আর সেই নিয়ম না মানলেই সেই দেশের নাগরিকদের জন্য এক বিশেষ ধরনের শাস্তিও নির্ধারণ করে রাখত দেশের সরকার। তবে বেশ কয়েক বছর পূর্বে নজর দিলে দেখা যাবে প্রাচীন রোমে এমন কিছু শাস্তির প্রচলন ছিল যা বর্তমানে মানুষদের ভয় পাইয়ে দেবে। এমনই বেশ কিছু ভয়ঙ্কর ও অভাবনীয় শাস্তির বেশ কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে আজকের প্রতিবেদনে-
I) ব্যারেলে নির্যাতন:- রোমের সম্রাট ডোমিশিয়ানের আমলে ভয়ংকর শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল তখনকার রোমবাসিরা। তখনকার সময় কাল ছিল আনুমানিক ৮১ থেকে ৯৬ খ্রিস্টাব্দ। রোমের এই একাদশ সম্রাটের আমলে ভয়ংকর শাস্তিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হল ব্যারেলে নির্যাতন। এমন শাস্তি থেকে একেবারে মৃত্যুই কামনা করতো সেই সময়কার রোমানিয় অপরাধীরা। এই শাস্তির ধরনটি ছিল প্রথমে অপরাধীদের পুরো দেহ মধু ও দুধ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে দেওয়া হতো। এরপর তাকে একটি ব্যারেলে আটকে রাখা হতো, এবং খেতে দেওয়া হতো পচে যাওয়া ও পোকা ধরা সব খাবার। এসব নষ্ট খাবার ততদিন পর্যন্ত অপরাধীদের খাওয়ানো হতো যতদিন না তারা সম্পূর্ণরূপে অসুস্থ হয়ে পরে। এবার সেসব খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরার প্রায় দু’সপ্তাহ পর মৃত্যু হত তার।
II)জীবন্ত কবর:- রোমে সম্রাট নিরোর শাসনকালে পূর্ব সম্রাটের তুলনায় আরো ভয়ংকর শাস্তির প্রচলন ছিল। সেই সময়কার সম্রাট অপরাধীদের নিজেদের হাতে মাটি খনন করে তাদের জ্যান্ত কবর দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। তবে শুধুমাত্র জ্যান্ত কবর দিয়েই শান্ত হতেন না তিনি। কোন অপরাধীর অপরাধ গুরুতর হলে তাকে তৎক্ষণা কবরের মধ্যে মৃত্যু দিতেন সে সম্রাট। এই জীবন্ত কবর প্রক্রিয়াটিতে দেখা গিয়েছে অপরাধীকে প্রথমে নিজের কবর নিজেকেই খনন করতে হতো। এরপর সেই কবরে রাখা হতো সূক্ষ্ম ও সূচালো একটি লাঠি। লোকটিকে হাত-পা বেঁধে কবরে ফেলা হত। যদি তার অপরাধের মাত্রা বেশি হতো, তাহলে এমনভাবে সেই সূচালো অস্ত্রটি নিক্ষেপ করা হতো, যেন লাঠির চোখা অংশটি সরাসরি তার হৃদপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়, অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। আর যদি কারো অপরাধের মাত্রা কম হত, তাহলে এমনভাবে নিক্ষেপ করা হতো, যেন সে মারাত্মক রকমের আহত হয়। এরপর তাকে সেখানেই ফেলে আসা হতো, কিংবা দেওয়া হতো জীবন্ত কবর। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ভার্জিন মহিলাদের জীবন্ত কবর দিয়ে এক পৈশাচিক আনন্দ পেতেন সম্রাট নিরোর। সতীত্ব সংক্রান্ত শপথ ভঙ্গের জন্য এমন শাস্তি দিতে দেখা গিয়েছে যাজিকা রুব্রিয়াকে। তাকে একটি ছোট গুহায় আটক করে রেখে আসা হয়েছিলো কোনো রকম জল ও খাদ্য ছাড়াই। সেখানেই কিছুদিন পর না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি।
III) ক্রুশবিদ্ধকরণ :- ক্রুশবিদ্ধকরণ হয়ে মৃত্যু ঘটনা এক ভয়ঙ্কর শাস্তির উদাহরণ। এমনকি এই ভয়ানক শাস্তি হাত থেকে রক্ষা পাননি স্বয়ং ঈশ্বরও। যীশু খ্রীষ্টকেও এরকম ভাবেই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে বৃদ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছিল গোটা বিশ্ব। রোমের অমানবিক শাস্তি গুলির মধ্যে এটি হল আরেকটি ভয়ংকর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে অপরাধীকে হাত-পা বেঁধে ক্রুশে তুলে দুই হাতে ও পায়ে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করা হতো। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে শাস্তির নাম ক্রুশবিদ্ধ হলেও এর ধরন ছিল বিভিন্ন। প্রথমে জল্লাদেরা অপরাধীকে উলঙ্গ করে মাথা ঢেকে দিতো, এমনকি উল্টো করে ঝুলিয়েও মাঝে মাঝে পেটাতো যতক্ষণ না তার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার প্রথাগতভাবে হাত-পায়ে পেরেক মেরে আটকে রাখা হতো যতক্ষণ না সেই মানুষটি মারা যাচ্ছে। এমনকি মৃত্যু প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে মাঝে মাঝে দোষীদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে দেওয়া হতো, কখনো আঘাত করা হতো জননাঙ্গে।
IV) মৌমাছির আক্রমণ :- এক প্রাণীর সাহায্যেই আরেক প্রাণীর হত্যা করা হতো এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অপরাধিদের উপর শারীরিক নির্যাতনের এক অন্যতম পদ্ধতি ছিল মৌমাছি আক্রমণ। এখানে প্রথমে দোষী ব্যক্তিকে উলঙ্গ করে ঢোকানো হতো বড়সড় ফাঁকা ফাঁকা করে বোনা বিশেষ একধরনের ঝুড়িতে। সেই ঝুড়ি পরবর্তীতে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো বড় কোনো গাছের শাখায়, যার আশেপাশে থাকতো বড় কোনো মৌচাক। এরপরই মৌমাছিরা ঝাঁপিয়ে পরতো লোকটির উপর এবং হুলের যন্ত্রণায় একসময় মৃত্যু হতো তার।
V) কলড্রন টর্চার :- দিন যত অতিবাহিত হয় ততোই যেন ভয়ঙ্কর রূপ ধারন করতে থাকে রোম। এমনই সব হৃদয় মর্মাহত শাস্তিগুলির মধ্যে কলড্রন টর্চার সবথেকে পৌশাচিক শাস্তি বলেই দাবি করেন রোমবাসীরা। কারণ এই টর্চারের মাধ্যমে প্রথমে কোনো ক্ষুধার্ত ইঁদুর, কুকুর কিংবা বেড়ালকে ছোট কলড্রনে আটকে রাখা হতো। এরপর কলড্রনের খোলা প্রান্তটি অপরাধীর পেটের দিকে মুখ করে আটকে দেওয়া হতো। এবার শাস্তিদানে নিয়োজিত ব্যক্তি এসে কলড্রনের পেছনে আগুনের উত্তাপ দিতো, যার ফলে ক্ষুধার্ত প্রাণীটি তখন জীবন বাঁচাতে সামনের দিকে ছুট লাগাতো এবং সামনে থাকা বন্দীর পেটের মতো নরম মাংস পেয়ে সে সেটা খেয়েই তার ভেতর দিয়ে পালাতে চাইতো। নরক যন্ত্রণার থেকেও কষ্টকর মৃত্যুর মুখে পরতো অপরাধীরা।
VI) সিনেটরের দুর্ভাগ্য :-৩৭ থেকে ৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের ৩য় সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সম্রাট ক্যালিগুলা। তিনি তার শাসনকালে এমন মর্মান্তিক শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছিলেন সেটা ছিল ব্যাপক ভয়াবহ। তবে অবাক হওয়ার বিষয় যে এমন ভয়াবহ ও নির্মম শাস্তিকে সমর্থন করতেন রোমবাসীরা।
ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে যে সেই সময় এক ব্যক্তির উপর ভয়ঙ্কর ক্ষেপে উঠেছিলেন সম্রাট, যার শাস্তি স্বরূপ লোকটিকে চিরে ফেলা হয়। তার পরেও লোকটির প্রাণ অবশিষ্ট থাকলে সম্রাটের নির্দেশে লোকটির চোখ দুটো তুলে নেওয়া হয়েছিল। এরপর গরম সাঁড়াশির সাহায্যে তার দেহের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো একে একে টেনে বের করা হতে থাকে, এবং সবশেষে দেহটি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল।
VII) মানুষকে তরবারি দিয়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলতো :- প্রাচীন রোমে আর একটি প্রথারও বিশেষ ভাবে প্রচলন ছিল, সেটি হলো উচ্চ এবং নিম্ন বৃত্তের ভেদাভেদ। অর্থাৎ যার ক্ষমতা এবং অর্থ যত বেশি তার অন্য লোকের কাছে জবাবদিহিতা ততই কম। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতেই পারে এক দেশের সম্রাটের জবাবদিহিতা করার কোন প্রয়োজন নেই কেননা তিনি অর্থ এবং শক্তির দিক থেকে সকলের উর্ধ্বে। এমনকি সেই সময়ে এমন ভেদাভেদের নিয়ম কঠোরভাবে পালন করত রোমানিয়রা। কিন্তু এই নিয়ম না মানলে তার শাস্তি ছিল মারাত্মক। কোন নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তির উচ্চ শ্রেণীর মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে অস্বীকার করলে তাকে জনতার সামনে খোজা (পুরুষত্বহীন অথবা নপুংসক) করে ছেড়ে দেওয়া হত। আর একজন সৈনিক যদি এটা স্বেচ্ছায় মেনে না নিত, তাহলে জনতার সামনে পেট কেটে তার নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা হতো। এমনই ছিল নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি।
VIII) যৌনাঙ্গ বেঁধে ফেলা :- সম্রাট টাইবেরিয়াসের সময়কালে আরো জঘন্য শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল রোমের বাসিন্দারা। এই সম্রাট শুধুমাত্র বদমেজাজি নয় ছিলেন বিকৃত চিন্তাধারার মানুষও। এই সম্রাটের শাসনকালে সাধারণ মানুষেরা তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। যার বেশ কিছু কারণ হলো একদা এক বলিদানের অনুষ্ঠানে সেবাদানরত ভৃত্যকে মনে ধরে যায় টাইবেরিয়াসের, এরপরই ক্ষমতাবলে শুধু ভৃত্যকেই না, সেই সাথে তার ভাই, যে কিনা অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজিয়েছিলো, তাকেও ধরে আনান সম্রাট। মনের অসুস্থ কামনা চরিতার্থ করে। এরপর যখন নির্যাতিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল এতে তখন ক্ষেপে গিয়ে তাদের পা ভেঙে দেন টাইবেরিয়াস। শুধু তাই নয় নিজের অনাগত শত্রুদের ছলনার মাধ্যমে মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানাতেন টাইবেরিয়াস। এরপর অতিরিক্ত মদ্যপানে লোকটি মাতাল হয়ে গেলে শুরু হতো সম্রাটের খেলা। ধারণাকৃত শত্রুর জননাঙ্গ বেঁধে ফেলতেন তিনি। এরপর শুরু হতো নির্যাতন। ভরপেটে এমন নির্যাতনের মুখে মারাত্মক প্রস্রাবের বেগ চাপলেও কিছুই করার থাকতো না সেই দুর্ভাগার।
IX) গাধার ভেতর ঢুকিয়ে রাখা :- একটি নিরীহ প্রাণীকে মানুষের আতঙ্ক করে তোলার উদাহরণ দেখিয়েছিল পূর্ব রোমের সম্প্রাটেরা। প্রাণীদের মধ্যে সবথেকে নিরীহ হিসেবে পরিচিত প্রাণীটি হলো গাধা। আর সেই গাধার শরীরের মধ্যে জীবন্ত মানুষকে ঢুকিয়ে রোমবাসীর কাছে ভয়াবহ উদাহরণ কায়েম করেছিল তখনকার সম্ভ্রাট। অ্যাপুলিয়াস অর্থাৎ প্লেটোনীয় দার্শনিক ও লুসিয়ান মানে (গ্রীক ব্যঙ্গসাহিত্য রচয়িতার সাহিত্যকর্ম থেকে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে – কোন ব্যক্তি অপরাধ করলে তাকে শাস্তি স্বরূপ গাধার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এই প্রক্রিয়াটিতে প্রথমে একটি গাধাকে মারা হতো। এরপর পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করা হতো। এবার অপরাধীর পরনের জামা-কাপড় খুলে হাত-পা বেঁধে তাকে গাধার ভেতর ঢুকিয়ে সেলাই করে দেওয়া হতো গাধার পেট, শুধু বাইরে রাখা হতো মানুষটির মাথা। এবার গাধার মৃতদেহ কিংবা গাধার ভেতরে লোকটিকে রেখে দেওয়া হতো উত্তপ্ত রোদের নীচে। সূর্যের তাপে আস্তে আস্তে মৃতদেহে পচন ধরতে শুরু করতো। অন্যদিকে তখন গরমে গাধার শরীর পচতে শুরু করলে পচা অংশে জন্ম নেওয়া পোকামাকড় উঠতে শুরু করতো লোকটির শরীরেও, আকাশ থেকে নেমে আসা শকুনের দল ঠোকরাতে শুরু করতো তার শরীরে। এভাবে বেশ কিছুদিন অমানবিক কষ্ট ভোগের পর অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরতো সেই অপরাধী।
X) মানুষ হতো বুনো শূকরের খাবার :- গাধার পর এবার শূকরকেও মাধ্যম বানানো হতো রোমে। যদিও এই শাস্তি বেশিরভাগ লাগু হয় কুমারী মেয়ে ও মহিলাদের উপর। রোমের একাধিক নিয়মের মধ্যে অন্যতম একটি নিয়ম দেশের কোন কুমারী মেয়েকে শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। সেই কারণে কুমারী কোন মেয়ে অপরাধ করলে প্রথমে তাকে একজন গ্ল্যাডিয়েটরের হাতে তুলে দেওয়া হতো। সেই গ্ল্যাডিয়েটর মেয়েটিকে ধর্ষণ করার পরই প্রথমে সবার সামনে তার পরনের জামা-কাপড় খুলে নেওয়া হতো। এর পরপরই মেয়েটির পেট চিরে ফেলা হতো। মেয়েটি যখন যন্ত্রণায় কুকরে যেত তখন শাস্তি প্রদানকারীরা ব্যস্ত থাকতো তার পেটের কাটা অংশটি যব দিয়ে ভরতে। ভরা হয়ে গেলে আবার পেট সেলাই করে দেওয়া হতো। এত অত্যাচারের পর মেয়েটিকে ছেড়ে দেওয়া হতো বুনো শূকরের সামনে। প্রাণীটি এরপর মেয়েটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।
বর্তমানে অনেকের কাছে এসব ঘটনা আজব মনে হলেও এই শাস্তির শিকার হয়েছিলেন সেইন্ট অ্যাগনেস, সেইন্ট প্রিস্কা ও সেইন্ট ইউফেমিয়া অফ অ্যাকুইলেইয়া। হেলিওপোলিস যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো, তখনকার সময়ের শাস্তি স্বরূপ এমন নরক যন্ত্রণা দেওয়া হতো অপরাধীদের।