অফবিট

মৃত্যুর আগে মানুষের শরীরের পরিবর্তন দেখার জন্য জলের মধ্যে বরফ রেখে তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হত। হিটলার বাহিনীর অবাক করা রহস্য

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ অবধি সাত বছর চলা এই প্রানঘাতী যুদ্ধে প্রায় ছয় কোটির বেশী মানুষ প্রান হারিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ পুরো অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জার্মানির সর্বাধিনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের নাজি সেনা এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছিল তা হয়ত অতি পাষান হৃদয় মানুষের চোখেও জল এনে দেবে। নির্বিচারে ইহুদি গনহত্যা বা হলোকাস্টের পাশাপাশি নাজি বৈজ্ঞানিক ও ডাক্তাররা নিরপরাধ মানুষদের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা করতো এসময়। মানুষের উপর এমন পরীক্ষা মানব ইতিহাসে এমন কোনওদিনও করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাজি ডাক্তারদের করা এসব পরীক্ষার কথা প্রকাশ পায়, যা দেখে হোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। 

১৯৩৯ সালে অ্যাডলফ হিটলার পোল্যান্ড আক্রমনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এরপর হিটলারের নাজি সেনা প্রায় গোটা ইউরোপ দখল করে নেয়। একসময় বিশ্বের সুপার পাওয়ার ফ্রান্স পর্যন্ত হিটলারের কাছে পরাজিত হয়। ব্রিটেন বাদে গোটা ইউরোপ হিটলারের অধীনে চলে যায়। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় হিটলার অসংখ্য ক্যাম্প তৈরি করেছিল যাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদি, জিপসী, চেক, সার্ব, প্রতিবন্ধী, মানসিক ভাবে অসুস্থ ব্যাক্তি এবং শত্রু দেশের সেনাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কারন হিটলারের মতে এদের ইউরোপে থাকার কোন অধিকার ছিলনা। ক্যাম্পে এসব বন্দীদের প্রায় অনাহারে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হত। যদি কেউ কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেত তাকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হত। নাজি সেনা প্রায় ষাট লাখ ইহুদি এবং পঞ্চাশ লাখ যুদ্ধ অপরাধীকে হত্যা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এই সময়েই নাজি ডাক্তাররা তাদের পরীক্ষা শুরু করেছিল। নাজি ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিকরা এসময় অদ্ভুত সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলো। যেমন হিটলার জার্মানিতে একটি আইন পাশ করিয়েছিল প্রত্যেক জার্মান মহিলাকে অন্তত চারটি বাচ্চার জন্ম দিতে হবে যাতে ইউরোপে শুদ্ধ জার্মান জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। হিটলার এর জন্য নাজি ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিকদের নির্দেশ দেয় এমন কিছু ঔষুধ তৈরি করতে যাতে জার্মান মহিলারা প্রতিবারে যমজ বাচ্চার জন্ম দেয়, এভাবে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়বে। জার্মান বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান যদি সমুদ্রে পড়ে যায় তাহলে নাজি পাইলট সমুদ্রের লবনাক্ত জল খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারবে, সমুদ্রের গরম জল কিংবা ঠান্ডা জলে নাজি সেনা কীভাবে বেঁচে থাকতে পারবে সেই বিষয়েও গবেষনা চলত। যুদ্ধে নাজি সেনা সর্বোচ্চ কতদিন বিনা আহারে থাকতে পারবে, গুলি লাগলে বা বিষাক্ত গ্যাস থেকে কীভাবে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা যাবে, টিবি ও ম্যালেরিয়া থেকে নাজি সেনা কীভাবে সুস্থ থাকবে এই বিষয়েও গবেষনা চলতো। নাজি দলের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল দ্রুত শুদ্ধ জার্মান জনসংখ্যা বৃদ্ধি। শুদ্ধ জার্মান মানুষ চিহ্নিত করা হত তাদের নীল চোখ দেখে। ক্যাম্পে বন্দী থাকা মানুষদের চোখের রঙ নীল কী ভাবে করা যায় সে ব্যাপারেও চিন্তা শুরু করে নাজি দল। এর কারনে ২৩ জন ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিকের একটি দল গঠন করে অ্যাডলফ হিটলার এবং নির্দেশ দেওয়া হয় বন্দীদের উপর পরীক্ষা নীরিক্ষা করার। এদের মধ্যে অনেক ডাক্তারই এসব কাজ বাধ্য হয়ে করেছে কারন তারা হিটলারের আদেশ অমান্য করলে মৃত্যুদন্ড পেত এবং তার পরিবারকেও শাস্তি ভোগ করতে হত। ১৯৪১-৪২ সাল থেকে এস পরীক্ষা শুরু হয়। মোট ৩০ রকমের প্রজেক্টে কাজ চলছিলো।

১) উচ্চতার পরীক্ষা :– ১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমনের সময় একটি জার্মান যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়ে যায়। তখন নাজি ডাক্তার রেসচার একটি পরীক্ষা শুরু করে যে অত্যাধিক উচ্চতায় মানুষের শরীরের সাথে কী হয় এবং মানুষ অত্যাধিক উচ্চতায় মানুষ বেঁচে থাকবে কী করে। এর জন্য একটি ঘরে অধিক উচ্চতায় যেমন বাতাস থাকে তেমন পরিবেশ করা হয়। বন্দী শিবির থেকে ২০০ জন লোককে নিয়ে এসে এই ঘরে রাখা হয়। এই পরীক্ষায় আশি জন লোক কম অক্সিজেনের কারনে ফুসফুস ফেটে নৃশংস ভাবে মারা যায়। বেঁচে যাওয়া বাকী ব্যাক্তিদের পরীক্ষা শেষে হত্যা করা হয়।

২) বরফে পরীক্ষা :– সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমনের সময় প্রচন্ড ঠান্ডায়, বরফে জমে গিয়ে অনেক নাজি সেনা মারা যায়। তাই নাজি ডাক্তাররা একটি ঘরে বড় বড় বাথটবে জলের মধ্যে বরফ রেখে তার মধ্যে বন্দীদের ডুবিয়ে রাখত। মানুষগুলো মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাতো, নাজি ডাক্তাররা পরীক্ষা করতো মৃত্যুর আগে ওইসব মানুষ গুলোর শরীরে কী পরিবর্তন হয়। এই পরীক্ষার কারনে অন্তত একশো জন মানুষের মৃত্যু হয়।

৩) সালফোনামাইড পরীক্ষা :– কোন নাজি সেনার গুলি লাগলে তাকে কীভাবে তাড়াতাড়ি সুস্থ করা যায় তার জন্য এই পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিল। এরজন্য ডাক্তাররা বন্দীদের ধরে এনে ইচ্ছে করে আঘাত করত এবং গুলি করত। তারপর তাদের উপর সালফোনামইড দিয়ে পরীক্ষা করতো। সাধারনত অপারেশন করতে হলে রুগীকে অজ্ঞান করা হয় কিন্তু নাজি ডাক্তাররা অজ্ঞান না করেই সালফোনামইড প্রয়োগ করতো। ফলে অসহ্য যন্ত্রনায় অনেক মানুষের মৃত্যু হয়।

৪) যমজ বাচ্চা পরীক্ষা :– বলা হয় ২৩ জন নাজি ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস ছিল ডাঃ জোসেফ ম্যাঙ্গেলে, তাকে মৃত্যুর দূত হিসাবেও ডাকা হতো। জোসেফ ম্যাঙ্গেলে বন্দী লোকেদের বাচ্চার চোখ নীল করার জন্য পরীক্ষা শুরু করে, কারন বাচ্চার চোখ নীল হলে তাকে শুদ্ধ জার্মান বলা যেত এভাবে ইউরোপে শুদ্ধ জার্মানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। ডাঃ জোসেফ ম্যাঙ্গেলে ৩০০০ বাচ্চার উপর পরীক্ষা শুরু করে, পরীক্ষা শেষ হতে হতে মাত্র ২০০ জন বেঁচে ছিল, এতটাই নৃশংস ছিল ডাঃ ম্যাঙ্গেলে।

৫) মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপর পরীক্ষা :— যুদ্ধে কোন নাজি সেনার হাত পা বা কোন অঙ্গ কেটে গেলে তা কী করে জোড়া লাগানো সম্ভব তার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। এর জন্য ক্যাম্প থেকে কিছু মানুষকে ধরে এনে অজ্ঞান না করেই জোর করে তার হাত, পা সহ কিছু অঙ্গ কেটে দেওয়া হত, এরপর সেগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করা হত। এই পরীক্ষায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

৬) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন:– নাজি ডাক্তার কার্ল ক্লুবার্গ এই পরীক্ষা শুরু করে। এই পরীক্ষার লক্ষ্য ছিল ইহুদি, জিপসী লাখ লাখ পুরুষকে দ্রুত নপুংসক তৈরি করা যাতে ইহুদি, জিপসি জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। তেজষ্ক্রিয়তা ও বিভিন্ন রাসায়নিক প্রয়োগে ক্যাম্পে থাকা প্রায় চার লাখ পুরুষকে নপুংসক করে দিয়েছিল এই কার্ল ক্লুবার্গ।

৭) টিবির পরীক্ষা :– টিবির ঔষধ বের করাী জন্য ক্যাম্প থেকে মানুষকে অরে এনে জোর করে তাদের শরীরে টিবির ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে ঔষধ তৈরির চেষ্টা করা হয়। এখন পরীক্ষায় প্রায় ২০০ মানুষ ও ২০ জন শিশুর মৃত্যু হয়।

৮) বিষের পরীক্ষা :– বিষ প্রয়োগ করলে মানুষের শরীরে কেমন পরিবর্তন ঘটে তা জানবার জন্য নাজি ডাক্তাররা কয়েদিদের বিভিন্ন বিষের ইনজেকশন দিত এবং অনেক সময় কয়েদিদের খাবারে বিষ মেশানো থাকতো। এই পরীক্ষায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

৯) ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা :– কয়েদিদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবানু প্রবেশ করিয়ে ঔষধ তৈরির চেষ্টা করা হত যাতে প্রায় এক হাজার মানুষ মারা যায়।

১০) মাস্টার্ড গ্যাস পরীক্ষা :– প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাদের উপর ব্রিটেন এই গ্যাসের প্রয়োগ করেছিল। হিটলার নিজেও তখন গ্যাসের স্বীকার হয়েছিল যার কারনে সে বহুদিন অন্ধ হয়েছিল। তাই নাজি ডাক্তাররা মাস্টার্ড গ্যাস থেকে বাঁচার উপায় জানতে কয়েদিদের ঘরে মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করা হত, তারপর তাদের ঠিক করার চেষ্টা করা হতো। এই গ্যাসের প্রভাবে বহু মানুষের চামড়া জ্বলে গিয়ে করুন মৃত্যু হয়।

১১) সমুদ্রের জলের পরীক্ষা :– এই পরীক্ষায় ৯০ জন রোমান জিপসি কয়েদিদের বারোদিন ধরে শুধুই সমুদ্রের জল খাওয়ানো হত, কোন খাবার দেওয়া হত না। সমুদ্রের জলের প্রভাবে মানুষের শরীরে কী পরিবর্তন ঘটে তা লক্ষ্য করত নাজি ডাক্তাররা। জল ও খাবারের অভাবে মানুষ ধীরে ধীরে যান্ত্রনাদায়ক মৃত্যু পেত।

এছাড়াও ইলেকট্রনিক শক, রক্ত জমাট বাধানো সহ ত্রিশ রকমের নারকীয় পরীক্ষা করেছিল নাজি ডাক্তাররা। 

১৯৪৫ সালে হিটলারের আত্মহত্যার পর জার্মানির পতন হয় এবং তখন এই অমানবীয় পরীক্ষা বন্ধ হয়। এরপর আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ দেশগুলো একটি আদালতে বিচার শুরু করে এই ডাক্তারদের। বিচারে বেশীরভাগ ডাক্তারকে আজীবন কারাবাস ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়্ কিন্তু সবচেয়ে নিষ্ঠুর ডাক্তার ডাঃ জোসেফ ম্যাঙ্গেলে পালিয়ে যায় প্যারাগুয়েতে। 

১৯৬১ সালে সেখান থেকে সে ব্রাজিলে চলে আসে এবং নাম পাল্টে উলফগ্যাং গেরহার্ড রাখে। ১৯৭৯ সালে ব্রাজিলের এক সমুদ্রতীরে স্নান করার সময় মৃত্যু হয় তার। ১৯৮৫ সালে ওই ব্যাক্তির মাথার খুলি পরীক্ষা করে সরকারি ভাবে জানা যায় ব্রাজিলে মৃত্যু হওয়া ওই ব্যাক্তি ডাঃ জোসেফ ম্যাঙ্গেলেই ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাজি বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়াররা এমন কিছু সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি তৈরি করেছিল যা আজও ব্যাবহৃত হয়। আমেরিকা এসব দেখে তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল। যার কারনে আমেরিকান সরকার একটি গোপন মিশন শুরু করে যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন পেপারক্লিপ যাতে প্রায় ১,৬০০ নাজি বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রযুক্তিবিদকে আমেরিকাতে এনে চাকরি দেওয়া হয়, ১২০ জন নাজি মহাকাশ বিজ্ঞানিকে নাসাতে চাকরি দেওয়া হয়। আজ যে আমেরিকা বিশ্বের সুপার পাওয়ার সেই আমেরিকান অনেক প্রযুক্তি তৈরিতে তৎকালীন নাজি জার্মান বিজ্ঞানীদেরই অবদান আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *