অফবিট

ইরানের পরমানু প্রোগ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা

একটি মুদ্রার দুটি পিঠ আছে, ঠিক তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। বিজ্ঞান মানুষের উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হয়, মানব সমাজের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটানো হয়। কিন্তু কখনও কখনও এই প্রযুক্তি ধ্বংসেরও কারন হয়। যেমন পরমানু শক্তি, এটি যেমন মানব সমাজের অগ্রগতির প্রতীক তেমন ধ্বংসযজ্ঞও ঘটায়। পরমানু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় যা কয়লা, পেট্রোলিয়ামের বদলে বিকল্প শক্তির উৎস। কার্বন মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পরমানু শক্তির ভূমিকা আছে। তেজস্ক্রিয় মৌল চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার হয়। আবার এই পরমানু বোম্ব তৈরির কাজেও ব্যবহার হয়। পরমানু বোম্বের ধ্বংসযজ্ঞের উদাহারন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি। এর পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করে যার দুটি প্রধান কারন, প্রথমত ক্ষমতা অর্জন, দ্বিতীয়ত বড় শক্তিশালী দেশ গুলোর থেকে রক্ষা পাওয়া। অর্থাৎ পরমানু অস্ত্র অনেকটা ইনশিওরেন্সের মতো কাজ করে। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ ইরানও বিগত কয়েক দশক ধরে পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে চেষ্টা করছে। ইরানের মতো দেশের হাতে পরমানু অস্ত্রের অর্থ ইসরায়েলের মতোন দেশের জন্য বিপদ সংকেত। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের পরমানু কার্যক্রমের উপর নজর রাখে সবসময়। মোসাদ বারংবার ইরানের পরমানু কার্যক্রমকে বাধা দিয়ে এসেছে। যখনই ইরান পরমানু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছেছে তখনই মোসাদ কোনও না কোনও ভাবে তা নষ্ট করে দিয়েছে। ইরানের পরমানু কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মোসাদের এমনই একটি কঠিন অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

সালটা ১৯৮৭ সালের কোন এক সকালের, দুবাইয়ের একটি অভিজাত হোটেলের ঘরে আটজন ব্যাক্তির মধ্যে একটি বৈঠক চলছে। এই আটজন ব্যাক্তির মধ্যে তিনজন ইরানি প্রতিনিধি, দুইজন পাকিস্তানি, তিনজন ইউরোপীয়ান। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন হচ্ছে ডঃ আব্দুল কাদের খান, যে পাকিস্তানের পরমানু পোগ্রামের প্রধান। এই বৈঠকে কাদের খান ইরানের প্রতিনিধিদের পরমানু বোম্ব তৈরির নকশা দেয়, যার বিনিময়ে তাকে মোটা অর্থ দেওয়া হয়। ডঃ কাদের খান ইউরেনিয়ামকে গ্যাসে পরিনত করে তাকে একটি চেন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে পরমানু বোম্ব তৈরির পদ্ধতি তৈরি করে, যা সে লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে বিক্রি করে মোটা অর্থ আয় করে। এই একই পদ্ধতিতে সে পাকিস্তানের জন্য পরমানু অস্ত্র তৈরি করে। তবে এটা কাদের খানের নিজস্ব তৈরি পদ্ধতি নয়, ১৯৭০ সালে ইউরেনকো নামে একটি ইউরোপীয়ান সংস্থায় কাজ করত কাদের খান, সেখান থেকে এই পদ্ধতি চুরি করে সে। পরমানু বোম্ব তৈরির যাবতীয় কাঁচামাল ইরানে খুব গোপন ভাবে আসতে থাকে। এমনকী পাকিস্তানি বিজ্ঞানীরাও গোপনে ইরান আসতে থাকে। ইরান খুবই গোপনে এই কার্যক্রম শুরু করে যাতে কেউ জানতে না পারে বিশেষ করে ইসরায়েল ও আমেরিকা। ইরান কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় পরমানু কার্যক্রম না করে দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপনে এই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ইরান যতই গোপন করুক না কেন, ১৯৯৮ সালের ১ জুন আমেরিকা ঠিকই খবর পেয়ে যায়। সেইদিন আমেরিকার এফবিআইয়ের অফিসে এক পাকিস্তানি বিজ্ঞানী ডঃ ইফতেখার চৌধুরী এসে ইরানের পরমানু কার্যক্রম সম্পর্কে জানায় এবং এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত যাবতীয় তথ্য দেয়। ডঃ চৌধুরী আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। আমেরিকা পুরো তদন্ত করে দেখে যাতে ডঃ চৌধুরীর সমস্ত তথ্য ঠিক বলে প্রমানিত হয় এবং তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় আমেরিকা কিন্তু ইসরায়েলকে এই ঘটনা আমেরিকা জানায়নি। ২০০২ সালের আগস্ট মাসে ইরানের সরকার বিরোধী সংগঠন মুজাহিদ্দিন ই খালেক ইরানের আরাক ও নাতানশ প্রদেশে পরমানু কার্যক্রমের ব্যাপারে আমেরিকার সিআইএকে জানায়। এরপর থেকে এই সংগঠনটি আমেরিকাকে একের পর এক তথ্য দিতেই থাকে। আসলে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এইসব তথ্য আমেরিকাকে পৌঁছাত মুজাহিদ্দিনের মাধ্যমে। একদিন সিআইএকে মুজাহিদ্দিনের এক ব্যাক্তি একটি ল্যাপটপ দেয় যার থেকে সিআইএ ইরানের পরমানু কার্যক্রমের ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। আমেরিকা বুঝে যায় মোসাদই তাদের ল্যাপটপ পাঠিয়েছে। 

ফেব্রুয়ারী, ২০০৪ হঠাৎই কাদের খান সাংবাদিক সম্মেলনে স্বীকার করে সেই লিবিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে পরমানু অস্ত্র তৈরির পদ্ধতি বিক্রি করেছে। এরপরেই যেসব জায়গা থেকে ইরান পরমানু অস্ত্রের কাঁচামাল কিনত সেসব বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু মোসাদ জানত শুধু এভাবে হবেনা, ইরানের পরমানু কার্যক্রমের কোমড় ভাঙতে হবে। জানুয়ারি, ২০০৬ এ ইরানে একটি বিমান ধ্বংস হয়ে যায় যাতে ইরানের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সদস্যের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার একমাস পরেই ইরানিয়ান মিলিটারির একটি পন্য পরিবহন বিমান ধ্বংস হয়ে যায় যাতে বিমানে থাকা ইরানের সেনাবাহিনীর ৯৪ জন সদস্যের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালের নভেম্বরে আরও একটি ইরানের বিমান ধ্বংস হয়, যাতে আবারও ইরানিয়ান সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য মারা যায়। ইরানের ইনটেলিজেন্স বিভাগ তদন্ত করে জানতে পারে এই প্রত্যেকটা ঘটনার জন্য মোসাদই দায়ী। 

এরপর ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমানু কেন্দ্রে একের পর এক বিস্ফোরন হয় যাতে ইরানের পরমানু কার্যক্রম ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হয়। ইরানের প্রধান পরমানু সেন্টার নাতানজের পরীক্ষাগারেও বিস্ফোরন হয়, যাতে ইরানের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়। ইরান তদন্ত করে জানতে পারে প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে মোসাদই দায়ী, ইচ্ছে করে পরীক্ষাগারে কেউ ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র রেখে দিয়েছিল। ইরান এটাও জানতে পারে নাতনজে বিস্ফোরনের জন্য সিআইএ জড়িত ছিল যাদের মোসাদই পাঠিয়েছিল। এসব ঘটনাই প্রমান করে ইরানের পরমানু কার্যক্রম নষ্ট করতে মোসাদ কতটা আগ্রাসী ছিল। ২০০৭ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ সিআইএকে দায়িত্ব দেয় ইরানের পরমানু কার্যক্রমকে ধীরে করে দিতে। মোসাদ ও সিআইএ যৌথভাবে ইরানের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু স্ট্রাটেজি তৈরি করে। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কারনে ইরান পরমানু অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল কিনতে সমস্যায় পড়ে। মূলত পূর্ব ইউরোপের কিছু রাশিয়ান সংস্থার থেকে কাঁচামাল কিনত ইরান। এসব কাঁচামালের বেশীরভাগই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তাছাড়া সিআইএ ও মোসাদ প্রায়ই ইরানের পরমানু সেন্টার গুলোতে সমস্যা তৈরি করতে থাকে। এরই মধ্যে ইরানের পরমানু প্রজেক্টের সাথে জড়িত এক গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী সিআইএর সাথে যোগাযোগ করে সম্পূর্ণ তথ্য দেয় ইরানের ব্যাপারে। এতে সিআইএ তাকে দশ মিলিয়ন ডলার দেয়। মোসাদ, সিআই এবং ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স একত্রে ইরানের বিরুদ্ধে কাজ করত। ইরানের বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সাথে আমেরিকা, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় যার মাধ্যমে আরও তথ্য পাওয়া যেত। ইরান বেশ কিছু মোসাদ ও সিআইএর গুপ্তচরকে গ্রেফতারও করেছিল কিন্তু তারা সবাই ছিল ইরানেরই নাগরিক, শুধু পয়সার জন্য কাজ করত। 

২০০৭ সালে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, ইরানের পরমানু প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আলি আসগর ইস্তাম্বুল সফরকালে হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। চারবছর পর ২০১১ সালে ইরান জানায় আলি আসগরিকে মোসাদই গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে এবং সে ইসরায়েলের জেলে বন্দী আছে। আলি আসগরির উধাও হয়ে যাবার একমাস পর ইরানের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি আমির সিরাজি উধাও হয়ে যায়। ২০০৯ সালে ইরানের পরমানু বিজ্ঞানী শরম আমিরি মক্কা যাবার পথে উধাও হয়ে যায়। ইরান সৌদি আরব সরকারকে অনুরোধ করে শরম আমিরিকে খুঁজে বের করার জন্য। পরে জানা যায় শরম আমিরি পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইরানের পরমানু কার্যক্রমের খবর সিআইএকে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আমেরিকার অ্যারিজোনাতে নতুন পরিচয়ে আছে। মোসাদ খবর পায় ইরানের আরও একজন পরমানু বিজ্ঞানী ফখরি জাদের ব্যাপরে। ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যাক্তি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিল, পরমানু বিস্ফোরনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ফখরি জাদে আঠারো বছর বয়স থেকেই ইরানের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল। ফখরি যাদের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয় আমেরিকা এবং বিদেশী ব্যাঙ্কে থাকা তার সমস্ত পয়সা আটকে দেওয়া হয়। মোসাদ এখানেই থেমে থাকেনি, ২০১০ সালে ইরানের পরমানু কেন্দ্র গুলোতে থাকা হাজার হাজার কম্পিউটার রাতারাতি বিকল হয়ে যায় সব তথ্য নষ্ট হয়ে যায়। এই বিশাল সাইবার অ্যাটাকের জন্য দায়ী ছিল মোসাদ ও সিআইএ। স্টাক্সনেট ভাইরাসের সাহায্যে এই সাইবার অ্যাটাক করা হয়। ১৯৮৭ থেকে এখন অবধি ইরান আজ পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারেনি যার একটাই কারন মোসাদ। এই জন্য মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ইনটেলিজেন্স সংস্থা বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *