জাপানিদের হাতে বন্দি হয়েছিল প্রায় ৬০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য। জাপানের ডেথ রেলওয়ে
আজও পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে মর্মাহত যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম হলো প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যদিও এই দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আরো অনেক যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী, কিন্তু তারপরেও এই দুটি যুদ্ধে এত মানুষের হত্যা ও নির্যাতন হয়েছে যে তা শুনলে আজও কেঁপে ওঠে গোটা পৃথিবী। এই ভয়ংকর ২টি যুদ্ধের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপানীরা যে রেললাইন তৈরি করেছিলেন সেটি বর্তমানে ডেথ রেলওয়ে নামে পরিচিত। কিন্তু কেন এই রেললাইনকে ডেথ রেলওয়ে বলা হয় সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
তাহলে একবার ঘুরে আসা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট থেকে। সেই সময়কালীন জাপানি বাহিনীর হাতে আটক হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী তথা মিত্র বাহিনীর বিরাট অংশ। আর সেই সকল বন্দী সৈন্যদের দিয়ে থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করানোর কাজ চলতো বাধ্যতামূলক। আসলেই এ রেললাইন তৈরি করতে কত মানুষ বাধা দিয়েছেন এবং কিভাবে হারিয়েছেন সেটি জবানবন্দী দিয়েছিলেন জাপানীজদের হাতে বন্দি এক ব্রিটিশ সৈন্য সেসিল ডয়।
তিনি বিস্তারিত ভাবে জানিয়েছিলেন,” যখন জাপানীজরা আমায় আটক করেছিল তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। যুদ্ধে পরাজয়ের পর বন্ধু অবস্থায় এমন পরিস্থিতি ছিল যে মনে হচ্ছিল সভ্যতা থেকে কয়েক হাজার পিছনে চলে গিয়েছিলাম। আদিম যুগের মধ্যে প্রবেশ করেছি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তোয়ালে, টুথপেস্ট, গরম জল সেটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি আমাদের। এমনকি গায়ের সম্পূর্ণ বস্ত্র খুলে নিয়ে সামান্য নেংটি দেওয়া হয়েছিল, লজ্জা নিবারণের জন্য। মূলত ১৯৪২ সালের শুরুর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি সিঙ্গাপুরের পতন হওয়ায় জাপানিদের হাতে বন্দি হয়েছিল প্রায় ৬০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য। আর সেই সকল বন্ধু সৈন্যদের রাখা হয়েছিল থাইল্যান্ডের এক গহীন জঙ্গলে ক্যাম্প করে। যার প্রতিটাতে থাকতো একজন করে কমান্ডেন্ট এবং পাহারা দিতে কোরিয়ান সৈন্য। অথচ ওই ক্যাম্পের চারিদিক কোন কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা ছিল না। যেহেতু কাঁটা তারে কোন প্যারা ছিল না, তাই তিনজন বন্দি সৈন্য পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। অথচ আশেপাশে কোন মানুষের অস্তিত্ব না থাকার জন্য তারা বাইরে কোথাও যেতে পারিনি বরং পরে কমান্ডেন্টের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল সকলেই। আর যারা পালাতো এবং পরে ধরা পড়ে যেত তাদের একটাই শাস্তি থাকতো যে নিজের হাতেই নিজের কবর খুঁড়তে হবে।তবে শুধুমাত্র এখানেই থেমে থাকেনি জাপানিদের অত্যাচার। তারা থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ রেল লাইনের পথ নির্মাণের জন্য কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন বন্দি সৈনিকদের। এই রেলপথ দিয়ে জাপানিরা খাবার, সৈন্য এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন। কিন্তু রেলপথ নির্মাণ করতে প্রায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক লক্ষের বেশি বন্দী। এই রেলপথ নির্মাণ করতে ঝর জল উপেক্ষা করে পাহাড়-পর্বত জঙ্গল কেটে নিজেদের প্রাণের বলিদান দিত বন্দী সৈন্যরা। সকল বন্দী সৈনিকদের মধ্যে সেসিল ডয়ের কাজ ছিল কোয়াই নামের নদীর আশেপাশের জঙ্গল কেটে সাফ করা।
জাপানিরা যেহেতু ইংরেজি বলতে পারতো না তাই তারা একটিমাত্র শব্দ শিখেছিল স্পিড। তাই সকল বন্দিদের হুমকি দিত স্পিডো, স্পিডো বলে। তিনি এও জানিয়েছেন যে নির্যাতিত জাপানি সৈন্যরা বন্দিদের দিয়ে অক্লান্ত কাজ করাতে এবং তারা বদলে খেতে দিতো হাফ কাপ ভাত। টনকে টন মাটি ও পাথর টানার বদলে মিলতো এক মুঠো অন্ন।
সেসিল তার জীবনীতে আরো জানিয়েছেন, বন্ধুদের বিশ্রামের জায়গায় তার পাশে শুয়েছিল আর একজন বন্দী যার গা ভর্তি ছিল ফোঁড়াতে। এমনকি সেই ফোঁড়া ফেটে পোকা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল এবং তার ভেতরে অনবরত ঢুকে পড়ছিল মাছি। একসময় এই দুরারোগ্য অসুখ থেকে জ্বর হয়েছিল এবং তারপরে মৃত্যুবরণ করেছিল সেই বন্দি। থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত এই রেললাইন নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ মাস। আর এই চোদ্দ মাস ধরে যেমন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল, সেরকমই নির্যাতনও সহ্য করতে হয়েছিল। যারা এই নির্যাতন সহ্য করতে পারেনি তাদের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার বন্দী ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান এবং ডাচদের মৃত্যু হয়েছিল।
আনুমানিক চার বছর পর্যন্ত বন্দী দশায় ছিল সকলে। কিন্তু তারপর যখন হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন আত্মসমর্পণ করেছিল জাপানিরা। এরপরই তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তি পেয়েছিল বন্দীদের বন্দী দশা।
তবে সেসিল ডয় একটি কথাই বলেছিলেন যে, এই বন্দী থাকাকালীন মানুষ কোনদিনই নিজের আত্মবল হারায় না। তারা সব সময় মনে করতে থাকে যে কোন না কোনদিন নিশ্চয়ই এই বন্দী দশা থেকে মুক্তি পাবে তারা।