অফবিট

বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আলকায়দার বড় নেতা আবদুল্লাহকে কেন হত্যা করেছিল ইসরায়েল?

তারিখটা ৭ আগস্ট, ২০২০, গভীর রাতে ইরানের রাজধানী তেহরানের এক ফাঁকা রাস্তায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে একটি দামী মটর সাইকেল যাতে দুজন যাত্রী আছে। বাইকটি অনেকক্ষন ধরে একটি গাড়িকে অনুসরন করে এগিয়ে যাচ্ছে। গভীর রাত ও জনমানবশূন্য রাস্তা হওয়ায় গাড়িটিও বেশ গতিতেই যাচ্ছে। বেশ খানিক্ষন পর বাইকটি গতি বাড়িয়ে গাড়িটির পাশে চলে আসে এবং বাইকের পেছনে বসা আরোহী বন্দুক বার করে গাড়ির যাত্রীকে লক্ষ্য করে পরপর চারটি গুলি করে এবং দ্রুত উধাও হয়ে যায়। পরেরদিন ইরানের সমস্ত মিডিয়ায় এই খবরটি হেডলাইন হয় যে রাতের অন্ধকারে তেহরানের রাস্তায় এক ৫৭ বছর বয়সী লোক ও তার ২৭ বছর বয়সী কন্যাকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যাক্তি গাড়িতে গুলি করে হত্যা করেছে। জানা যায় বয়স্ক ব্যাক্তিটির নাম আবু মহম্মদ আল মাসেরি। ইরান ও লেবাননের মিডিয়া থেকে জানা যায় সেই ব্যাক্তিটি লেবাননের একজন ইতিহাসের অধ্যক্ষ ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ তদন্ত করে কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়না। ইরানের বিদেশমন্ত্রী সরাসরি জানায় এই ঘটনার জন্য ইসরায়েল ও আমেরিকা দায়ী। ইরানের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল জানায় নিহত ওই ব্যাক্তির প্রকৃত নাম আবদুল্লা আহমেদ আবদুল্লাহ, যে বিশ্বের কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আলকায়দার একজন বড় নেতা ছিল। এরপরেই গোটা বিশ্ব জেনে যায় আবদুল্লা আহমেদ আবদুল্লাহকে হত্যার জন্য ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদই দায়ী। আবদুল্লাহ আহমেদকে কেন মোসাদ হত্যা করল? ইরানে তাকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া গেল! মোসাদের এই অপারেশন সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

১৯৬৩ সালের ৬ জুন মিশরে জন্ম হয় আবদুল্লাহ আহমেদ আবদুল্লার। ছোট থেকেই ফুটবলের ভক্ত আবদুল্লাহ মিশরে ক্লাব গজলের হয়ে ফুটবল খেলত। ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত আফগান যুদ্ধের সময় আবদুল্লাহ আফগানিস্তানে চলে যায় এবং সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। সেখান থেকেই সে যোগ দেয় আল-কায়েদায়। বহু কুখ্যাত ও নৃশংস অপারেশন করেছে আবদুল্লাহ আল-কায়েদার হয়ে। এই কারনে সে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালে আবদুল্লাহ আল-কায়েদার কিছু শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডার এবং সুদান ও সোমালিয়ার বেশ কিছু আল-কায়েদা সদস্যকে বিশেষ প্রশিক্ষন দেয় যার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে সোমালিয়াতে যুদ্ধ করা।

সোমালিয়ায় ১৯৯১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছিল। সোমালিয়ার চারটি সন্ত্রাসী সংগঠন সোমালি ন্যাশানাল অ্যালিয়ান্স নামে একটি দল গঠন করেছিল যার প্রধান মহম্মদ ফারাহ আদিদ, একে গ্রেফতার করার জন্য আমেরিকা ১৯৯৩ সালের ৩-৪ অক্টোবর একটি বিশেষ অপারেশন শুরু করে অপারেশন গোথিক সারপেন্ট। সোমালিয়ার মোগাদিশু নামক জায়গায় আমেরিকা এই অপারেশন করেছিল বলে একে ব্যাটেল অফ মোগাদিশু বা ব্ল্যাক হক ডাউন বলা হয়। মহম্মদ ফারাহ আদিদ সোমালিয়ায় জাতিসংঘের সেনার উপর আক্রমন করেছিল, তাই তাকে গ্রেফতারের জন্য অপারেশন শুরু করেছিল আমেরিকা। আল-কায়েদার সদস্যদের আবদুল্লাহ প্রশিক্ষন দিয়েছিল এই মোগাদিশুর যুদ্ধের কথা ভেবেই। আমেরিকার এই অভিযান ব্যার্থ হয়েছিল, মহম্মদ ফারাহ আদিদ পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর আমেরিকা সোমালিয়া থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নিয়েছিল। এরপর আবদুল্লাহ বিভিন্ন সময়ে কেনিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরানে আশ্রয় নেয়। ২০০০ সালে আল-কায়েদার প্রশাসনিক সংগঠনের সদস্য হয়। ২০০৩ সালে আবদুল্লাহ ইরানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু প্রথমদিকে ইরান সরকার তাকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল। তবে ততদিনে আমেরিকার ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও মোসাদের নজরে এসে গিয়েছিল আবদুল্লাহ, তাকে যেকোন প্রকারে থামানো তাদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। কিন্ত আবদুল্লাহ কেন আমেরিকা ও ইসরায়েলের শত্রু হয়ে উঠেছিল? সে বিষয়ে একটু বলা যাক। 

১৯৯৮ সালের ৭ আগস্ট কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি এবং তানজানিয়ার দার আল সালাম শহরের আমেরিকার দূতাবাসে সন্ত্রাসী আক্রমন হয়। এই ঘটনায় ২২৪ জনের মৃত্যু হয় এবং চার হাজারের বেশী লোক আহত হয়। এই ঘটনায় জড়িত ছিল ওসামা বিন লাদেন, আয়মান আল জাওহারি, আবদুল্লাহ এবং সইফ এল আদিল। এই সইফ এল আদিলকেও প্রশিক্ষন দিয়ে সোমালিয়ায় পাঠিয়েছিল আবদুল্লাহ। এই পুরো ঘটনার পরিকল্পনা ছিল আবদুল্লাহর। কেনিয়া ও তানজানিয়ায় আমেরিকান দূতাবাসে এই সন্ত্রাসী আক্রমনের ঘটনায় মোট একুশ জনের নাম পাওয়া যায়। পরবর্তী কিছু বছরের মধ্যে এই হামলায় জড়িত উনিশ জনকে বিভিন্ন অপারেশনে শেষ করে দেয় আমেরিকা, বাকী ছিল শুধু দুইজন আয়মান আল জাওহারি এবং আবদুল্লাহ আহমেদ আবদুল্লা। এটা তো গেল সিআইএ কেন আবদুল্লাহকে খুঁজছিল? 

এবার মোসাদের ব্যাপারে জানা যাক। ২০০২ সালের ২৮ নভেম্বর কেনিয়ার মোম্বাসা শহরে একটি ইসরায়েলি নাগরিকের প্যারাডাইস হোটেলের সামনে আল-কায়েদা আত্মঘাতী বিস্ফোরন ঘটায়, এই ঘটনায় ১৩ জন মারা যায় ও ৮০ জন আহত হয়। এই ঘটনার কিছুক্ষন পরে ওই ইসরায়েলি ব্যাক্তিরই একটি যাত্রীবাহী বিমানে মিসাইল হামলা করে আল-কায়েদা কিন্তু ভাগ্যক্রমে মিসাইল বিমানে লাগেনি। ২৮ নভেম্বর দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল কারন এইদিন ছিল ইসরায়েলের ইহুদীদের পবিত্র উৎসব হানুক্কাহ। এই ঘটনার পর ওসামা বিন লাদেন, আয়মান আল জাওহারির পর আল-কায়েদার তৃতীয় সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠে আবদুল্লাহ আহমেদ আবদুল্লা। আমেরিকা আবদুল্লাহ আহমেদ আবদুল্লাকে খুঁজে পাবার জন্য দশ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য ঘোষনা করে কিন্তু তা সত্বেও তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দুই গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং মোসাদ প্রায় ১৮ বছর ধরে তাকে খুঁজছিল কিন্তু তাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সিআইএ অনুসন্ধান করে খুঁজে পায় বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে আত্মগোপন করে আছে আবদুল্লাহ যেমন আবু মরিয়ম, মুস্তফা, খালিদ আবু আল মাসারি সহ আরও অনেক নামে। এরপর সিআইএ ও মোসাদ যৌথভাবে একটি অভিযান শুরু করে। সিআইএর কাজ ছিল আবদুল্লাহর অবস্থান খুঁজে বের করা এবং মোসাদের কাজ ছিল তাদের এজেন্ট পাঠিয়ে তাকে হত্যা করা। সিআইএ খুঁজে বের করে আবদুল্লাহ ইরানে একজন লেবানিজ অধ্যক্ষের পরিচয়ে রয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল ইরান একটি শিয়া মুসলিম ধর্মীয় দেশ, যেখানে আবদুল্লাহ আল-কায়েদার নেতা যে সুন্নী মুসলিম, তাহলে ইরান কেন তাকে আশ্রয় দিয়েছিল!!! এর উত্তর জানতে হলে ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে একটু জানতে হবে। আল-কায়েদার নেতা হবার জন্য ১৯৯১ সালে ওসামা বিন লাদেনের সৌদি আরবের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। তখন লাদেন সুদানে চলে আসে। সেখানে তার সাথে বন্ধুত্ব হয় মহম্মদ আল তুরাবির যে সুদানের একজন বড় রাজনৈতিক নেতা ছিল। তার মাধ্যমেই আল-কায়েদার সাথে ইরানের সংযোগ তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে চলে বসে। ৯/১১ আমেরিকায় আক্রমনের পর, আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে আক্রমন করে আল-কায়েদাকে ঘিরে ফেলে তখন ওসামা বিন লাদেনকে পালিয়ে আসতে সাহায্য করে ইরানের নিরাপত্তা বিভাগের সদস্যরাই। ইরানের সেনাবাহিনীর অফিসার কাসেম সুলেমানি লাদেন ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল। আবদুল্লাহকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মোসাদের দুই সদস্যকে। অবশেষে ২০২০ সালের ৭ আগস্ট মোসাদের দুই সদস্য আবদুল্লাহ ও তার মেয়েকে হত্যা করে। আবদুল্লাহর এই মেয়ে ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হামজা বিন লাদেনের বৌ ছিল। হামজা বিন লাদেনকে আমেরিকা আফগানিস্তান পাকিস্তান সীমান্তে ২০১৯ সালেই হত্যা করেছিল। আবদুল্লাহকে মারবার আগে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারী ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাসেম সুলেমানিকে প্রিডেটর ড্রোন থেকে হেলফায়ার মিসাইল দিয়ে হত্যা করে আমেরিকা। এভাবে আঠারো বছর ধরে একে একে নাইরোবী ও তানজানিয়ার আমেরিকান দূতাবাসে আক্রমনের সাথে জড়িত একুশ জনকেই হত্যা করে আমেরিকা ও ইসরায়েল। এজন্য মোসাদ ও সিআইএকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক গোয়েন্দা সংস্থা বলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৭ আগস্টের দিনই নাইরোবি ও তানজানিয়ার আমেরিকান দূতাবাসে হামলা করেছিল আল-কায়েদা। তার ২২ বছর পরে এই ঘটনার সাথে জড়িত শেষ ব্যাক্তিটিকেও খতম করে মোসাদ ও সিআইএ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *