অফবিট

ইসরায়েল যুদ্ধে হার মানাতে পারে রূপকথার উপন্যাসকেও

১৯৪৮ সালে যখন জন্ম হয় ইসরায়েল নামক দেশটির তখন ইসরায়েলের কোন অস্ত্র ও সেনাবাহিনী ছিলনা। পরে ইসরায়েল এক গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ইউরোপের পুরোনো অস্ত্র নিয়ে আসে। কিন্ত জন্মলগ্ন থেকেই আরব দেশগুলো ইসরায়েল বিরোধীতা করা শুরু করে যার কারনে ১৯৪৮ সালেই আরব ইসরায়েল যুদ্ধ হয়। সদ্য তৈরি হওয়া একটি দেশ আশেপাশের সংঘবদ্ধ শক্তিশালী আরব দেশগুলোকে যুদ্ধে পরাজিত করে মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা দেয়। এরপরে আর ইসরায়েলকে কোনসময় পিছু হটতে হয়নি। বর্তমানে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী ইসরায়েলকে মধ্য প্রাচ্যের সিংহ বলা হয়। তবে ১৯৪৮ সালে হওয়া আরব ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয়গাথা কোন রূপকথার উপন্যাসকেও হার মানাবে।

ইসরায়েলের নির্মান হঠাৎ করেই হয়নি। আজকের যে ইসরায়েল ভূমি ঐতিহাসিক ভাবেই তা ইহুদীদেরই ছিল। প্রায় তিনহাজার বছর আগে বর্তমান ইসরায়েলের ভূমিতে ইহুদিরাই থাকতো। কিন্তু বারবার রোমান আক্রমনের কারনে ইহুদিরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু ইহুদিরা যেখানেই গেছে সেখানেই তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে কারন ইহুদিরা তাদের অসামান্য বুদ্ধি মত্তায় একের পর এক সফল ব্যাবসা পরিচালনা করতো যার কারনে স্থানীয় মানুষ তাদের উপর বিরূপ হয়ে ওঠে। যার কারনে ১৮৫০ সাল থেকে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী উঠতে শুরু করে। ব্রিটেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের জানায় তারা যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের সহায়তা করে তাহলে স্বাধীন ইহুদি দেশ তৈরি করতে ব্রিটেন সহায়তা করবে। সেই অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিরা ব্রিটেনকে সহায়তা করে। যার পর ফলস্বরূপ ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বাধীন ইসরায়েল তৈরি হয়। কিন্ত প্রতিষ্ঠা দিবসেই ইসরায়েলের উপর আক্রমন করে মিশর, ইরাক, সিরিয়া ও জর্ডান। এইসব দেশগুলোকে সহায়তা করে সৌদিআরব, ইয়ামেন, লেবানন ও সুদান। অর্থাৎ সব আরব দেশগুলোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্ত দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারিত ইহুদিরাও ঠিক করে তারা তাদের ভূমি জীবন দিয়েও রক্ষা করবে। ইসরায়েলের সেসময় কোন সেনাবাহিনী ছিলনা। হ্যাগানা, ইরগুন ও লেহি নামে তিনটি সংগঠন ছিল। এদের সদস্যরা অল্প লড়াই জানতো। এদের কাজ ছিল আরব সেনাকে আটকে রাখা, এগোতে না দেওয়া। 

১৫ মে ব্রিটেন প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে যায়, এরপর আরও বিশাল সংখ্যায় ইহুদিরা দলে দলে ইসরায়েলে আসতে থাকে। যুদ্ধ শুরু হবার এগারো দিন পরে ২৬ মে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী আইডিএফ বা ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের প্রতিষ্ঠা হয়। তবে এখানে মনে হতে পারে ইসরায়েলে যেহুতু কোন সেনাবাহিনী ছিলনা তাহলে যুদ্ধ শুরু হবার এগারো দিন ধরে কী করে বিশাল আরব সেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ইসরায়েল? এর পেছনেও ইসরায়েলের তৎকালীন নেতা ডেভিড বেন গুরিয়েনের অসাধারন দূরদৃষ্টি ছিল। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার দাবি যখন জোরালো ভাবে উঠছিল তখন প্যালেস্টাইন আরবরা বিদ্রোহ শুরু করে। সেজন্য ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ডেভিড বেন গুরিয়েন ১৯৪৭ সালে একটি আদেশ জারি করে যে ইসরায়েলে আসা সমস্ত ইহুদিদের বাধ্যতা মূলক সামরিক প্রশিক্ষন নিতে হবে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ইহুদিরা প্রচুর আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলে আসতে শুরু করে। সেকারনে যুদ্ধ শুরু হবার সময় ইসরায়েলের কোন সেনাবাহিনী না থাকলেও ততদিনে হাজার হাজার ইসরায়েলি নারী পুরুষ সামরিক প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ছিল। এদিকে ১৯৪৭ সালে আরও একটি ঘটনা ঘটে, ইসরায়েলে আসা ইহুদিদের সামরিক প্রশিক্ষন দেবার জন্য সামরিক অস্ত্র দরকার ছিল। যার জন্য ধনী ইহুদিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধ বিমান, ট্যাঙ্ক, বন্দুক সহ গোলা বারুদ স্বল্প্য মূল্যে কিনে ইসরায়েলে পাঠাতে থাকে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন বালাক, যার নেতৃত্বে ছিল নয়জন ইহুদি লোক। তিন মাস ধরে চলা এই অপারেশনে যথেষ্ট পরিমানে অস্ত্র এসে ইসরায়েলে জমা হতে থাকে। ফলে যুদ্ধ শুরু হবার আগেই ইসরায়েল প্রস্তত ছিল। এমনকী ইসরায়েলের কাছে বেশ কিছু আধুনিক যুদ্ধবিমান পর্যন্ত ছিল। ইসরায়েলে আক্রমনকারী দেশ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সেনা ছিল মিশরের যাদের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিব দখল করা। কিন্তু ২৯ মে থেকে ৩ জুন অবধি ইসরায়েল বায়ুসেনার একের পর এক বোম্বিং মিশর সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেসময় জেরুজালেম শহর ছিল জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রনে। পশ্চিম জেরুজালেমে বসবাস করত ইহুদি লোকেরা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস করত আরবরা। তেল আভিব থেকে পশ্চিম জেরুজালেমে খাবার সহ জরুরী জিনিস যেত। তেল আভিব ও পশ্চিম জেরুজালেমের মাঝে ল্যাটরান নামে একটি গুরুত্বপূর্ন এলাকা ছিল, এই অঞ্চলের দখল নিয়ে জর্ডন ও ইসরায়েলের সেনার মধ্যে ২৪ মে থেকে ১৮ জুলাই অবধি লড়াই চলে যাতে জর্ডান জিতে যায়। ফলে পশ্চিম জেরুজালেমে প্রয়জনীয় জিনিসপত্র যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে আরবা পশ্চিম জেরুজালেম আক্রমন করে দখল করে নেয়, সেখানে থাকা ইহুদিরা পালিয়ে যায় এবং অনেককে হত্যা করা হয়। এদিকে ইরাক ও সিরিয়ার সেনা তুল্করাম ও জেনিন আক্রমন করে। ইসরায়েল সেনা তুল্করাম নিজদের নিয়ন্ত্রনে আনে কিন্তু জেনিন চলে যায় ইরাকের অধীনে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করে দুই পক্ষের জন্য ১১ জুন থেকে ৮ জুলাই অবধি। এই সময়ে ইসরায়েল চেকোশ্লোভিয়া থেকে অনেক যুদ্ধ বিমান কেনে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিজ্ঞ পাইলটরা ইসরায়েলের হয়ে যুদ্ধ করেতে আসে। এই একমাস যুদ্ধ বিরতি থাকাকালীন ইসরায়েল ইউরোপ থেকে প্রচুর অস্ত্র কেনে, সাথে ৬৫,০০০ নতুন সদস্যকে প্রশিক্ষন দিয়ে সেনায় ভর্তি করে। ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে থাকা তিনটি ব্রিটিশ জাহাজকে যুদ্ধপযোগী করে তোলে ইসরায়েল এবং নৌসেনার স্থাপনা করল। অর্থাৎ এই যুদ্ধ বিরতির একমাসে ইসরায়েল ব্যাপক সামরিক উন্নয়ন ঘটায়। 

৮ জুলাই মিশরীয় বায়ুসেনা তেল আভিবে আক্রমন করে নতুন করে যুদ্ধের সূচনা করে। কিন্তু ইসরায়েল বায়ুসেনা আগে থেকেই প্রস্তত ছিল যার কারনে মিশরীয় বায়ুসেনা পরাস্ত হয়। এরপর আরও তিনবার মিশরীয় বায়ুসেনাকে পরাস্ত করে ইসরায়েল বায়ুসেনা। মিশরের প্রচুর সেনা মারা যায়। এরপর মিশর আর আক্রমন করতে সাহস পায়নি ইসরায়েলকে। ইসরায়েল সেনা একের পর এক আরব শহর জিততে শুরু করে। জর্ডনের অধিকারে থাক ল্যাটরান এলাকা পুনরায় নিজেদের অধীনে আনে ইসরায়েল। প্যালেস্টাইনের বড় অংশ জিতে নেয় ইসরায়েল। রীতিমতো আরব সেনা পীছু হটতে শুরু করে। ইসরায়েল সেনা এরপর জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৮ জুলাই জাতিসংঘ পুনরায় যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করে। জাতিসংঘ একাধিক প্রস্তাব রাখে দুই পক্ষের সামনে কিন্তু দুই পক্ষই কোন প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। যুদ্ধ বিরতির তিন মাস পরে ১৫ অক্টোবর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েল গ্যালিলি অঞ্চলে বারবার আরব সেনা আক্রমন করছিল যাতে অনেক ইহুদি মারা যায় যার করনে ইসরায়েল অপারেশন হিরাম শুরু করে। তিন দিন ধরে চলা এই অপারেশনে আরব সেনা লেবাননে পালিয়ে যায়, চারশো আরব সেনা মারা যায় এবং পাঁচশো আরব সেনা গ্রেফতার হয়। ইসরায়েল লেবাননেরও কিছু অংশ জিতে নেয়। এরপর ইসরায়েল মনোনিবেশ করে দক্ষিন অংশে। এখানে নেগিভ মরুভূমি ছিল যেখানে মিশরের প্রধান্য ছিল। ইসরায়েল অপারেশন ইয়োভ ও হোরেভ শুরু করে যার লক্ষ্য মিশর সেনা ও মিশরের নৌসেনাকে সম্পূর্ন পরাস্ত করে মিশরকে যুদ্ধ বিরতির জন্য বাধ্য করা। পাঁচ দিনের যুদ্ধের পর মিশর সেনাকে নেগিভ থেকে বের করে দিয়ে মিশরের সিনাই পেনিনসুলার বেশ কিছু অংশ জিতে নেয় ইসরায়েল। 

তবে ১৯৪৯ সালের ২ জানুয়ারি আমেরিকা ও ব্রিটেনের কথায় ইসরায়েল সিনাই পেনিনসুলা মিশরকে ফিরিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে ৭ জানুয়ারি মিশর ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ বিরতির আলোচনা করে। নেগিভ মরুভূমির কিছু অংশ জর্ডানের অধীনে ছিল। ইসরায়েল অপারেশন উভডা শুরু করে যাতে জর্ডানের সেনাকে হটিয়ে পুরো নেগিভ ইসরায়েলের হয়ে যায়। এরপরই শেষ হয় আরব ইসরায়েলের প্রথম যুদ্ধ। যাতে ইসরায়েল নিজের আসল ভূমির বাইরেও বেশ কিছু অংশ জিতে নেয়। জুলাই মাস আসতে আসতে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাকের সাথে শান্তি চুক্তি হয় ইসরায়েলের। এই যুদ্ধে ইসরায়েলের প্রায় ৬,৩৭৩ লোক মারা যায় যাতে চার হাজার সেনা ও বাকী সব সাধারন মানুষ ছিল। অন্যদিকে প্রায় ১৩,০০০ আরবসেনা মারা যায়। এই যুদ্ধে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি লোক অন্য আরব দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়, এই ঘটনা নাকবা নামে পরিচিত। 

ইসরায়েল তৈরি হবার আগে প্যালেস্টাইনে ফিলিস্তিনি লোকের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে এগারো লাখ, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবার পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ, এরা ইসরায়েলের নাগরিক হয়ে গেছিল। এই মহূর্তে বিভিন্ন আরবদেশে প্রায় পঞ্চাশ লাখ ফিলিস্তিনি শরনার্থী রয়েছে। আরবদেশ গুলোও এদের নাগরিকত্ব দেয়নি। যুদ্ধ চলাকালীন আরবদেশে থাকা ইহুদিদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় যার কারনে সমস্ত আরবদেশ থেকে ইহুদিদের ফিরিয়ে আনতে ইসরায়েল একটি অপারেশন শুরু করে যার নাম অপারেশন ম্যাজিক কার্পেট যাতে ইয়ামেন, সৌদিআরব, ইরাক থেকে প্রায় দেড় লাখ ইহুদি ইসরায়েলে আসে। তবে প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধ শেষ হলেও এর পরে একাধিক বার যুদ্ধ হয় আরব দেশ গুলো ও ইসরায়েলের মধ্যে, যার প্রতিটিতেই বিজয়ী হয় ইসরায়েল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *