ব্রিটেনে শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে খাঁচায় বন্দি কেন করা হত?
বরাবরই বাবা মায়েরা তাদের শিশুদের স্বাচ্ছন্ন বোধ নিয়ে সচেতন থাকেন। কোন কারনে কান্না করলে বিচলিত হয়ে পড়েন তাদের বাবা-মায়েরা। তাই বর্তমানে এমন অনেক জিনিস উদ্ভব হয়েছে যেগুলো শিশুদের আনন্দ দিয়ে থাকে। এমনকি অভিভাবকেরাও তাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য যা ভালো সেই কাজই করে থাকেন। কিন্তু উনিশ শতক নাগাদ ব্রিটেনে শিশুদের স্বাস্থ্যবান করে তোলার জন্য খাঁচায় বন্দি করে রাখা হতো। বিষয়টা শুনলে আজব মনে হতে পারে কিন্তু এই রকম ঘটনা আগে সাধারণ ছিল। তাহলে একটু ভালো করে জানা যাক বেবি কেজে শিশুদের বেড়ে ওঠার কাহিনী।
১৯৩০ সাল থেকে বেবি কেজের কাহিনী শুরু হয়েছিল। কারণ সেই সময় ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছিল ব্রিটেনে দালান বাড়ি নির্মাণের কাজ। চোখের পলকে ব্রিটেনে এত গুলি দালান বাড়ি হয়ে উঠেছিল যে নবজাত শিশুদের জন্য ঘাটতি পড়ে গিয়েছিল তাজা হাওয়া এবং আলোর। মূলত শিশুদের বৃদ্ধির জন্য এই প্রয়োজনীয় দুটো প্রাকৃতিক উপাদানের যাতে কোন ঘাটতি না পড়ে সেই কারণেই নির্মাণ হয়েছিল বেবি কেজ। যদিও আগে ব্রিটেনের মানুষ এই বেবি কেজকে The window crib বলেই বেশি চিনতেন।
এই খাচা গুলি দেখতে কিছুটা ভয়ংকর মনে হলেও তার চারিপাশ ঘেরা থাকতো নেট দিয়ে। এটি ঝোলানো থাকতো জানলার বাইরে এবং তার উপর কিছু নরম জিনিস পেতে দেওয়া হতো যেখানে শিশুরা বসে খেলতো বা ঘুমাতো। সেই সময় অবশ্য অধিকাংশ মায়েরা এই খাঁচার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন কারণ এই খাঁচাতে শিশুরা স্বাচ্ছন্ন বোধ করত এবং সেই ফাঁকে মায়েরা ঘরের কাজ করে নিতে পারতেন। সন্তানেরা যাতে তাজা হওয়া পায় তার জন্য এই ধরনের খাঁচা ব্যবহার করতেন অভিভাবকেরা।
পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে এই খাঁচার জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে সিটি কাউন্সিল এই খাঁচা তৈরি এবং ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। এমনকি সে সময়কার একটি সংস্থা দ্য চেলসি বেবি ক্লাব’ যেটি শুধুমাত্র চিলড্রেন ডে কেয়ার নামক একটি সংস্থা এই খাঁচার প্রচলন বেশি করেছিলেন এবং মায়েদের এটি ব্যবহার করার জন্য উৎসাহী করে তুলেছিলেন।
সেই সময়ে বহুতল নির্মাণ হলেও কক্ষগুলি ছিল খুবই ছোট। যার কারণে শিশুদের আলাদা ঘর তৈরি করে, তাদের চলাফেরা করার জায়গা কম থাকার কারণে মায়েরাই খাচা ব্যবহার করতেন এবং সেখানে একটি পর্দাও টানিয়ে রাখতেন। অর্থাৎ খাঁচার ভিতর শিশুরা খেলতে খেলতে মাঝে মধ্যে ঘুমিয়েও পরতো। সেই কারণে এই বেবি কেজকে মায়েরা বেশি পছন্দ করতেন। এছাড়া এই খাঁচা ব্যবহার করার আর একটা সুবিধা ছিল যে ১৮৮৪ সালে, লুথার এমমেট হল্ট নামের একজন লেখক একটি বই প্রকাশ করেছিলেন যা ছিল নবজাতক এবং মায়েদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নিয়ে। এমনকি এই বইতে একটি চ্যাপ্টার ছিল শিশু এবং তাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে। লেখক তার বইতে আরো উল্লেখ করেছিলেন যে তাজা হওয়া ও রোদের আলো একটি বাচ্চার বৃদ্ধিতে এবং রক্তের বিশুদ্ধকরণের জন্য খুবই সহায়ক। তাই লন্ডনের মায়েরা আরো আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এই খাঁচার প্রতি।
মূলত যে খাচা নিয়ে এত তোলপাড় ছিল ওই শহর সেই খাচা নির্মাণ করেছিলেন এমা রিড’ নামে একজন মহিলা। তিনি ১৯২২ সাল নাগাদ একটি বক্তব্যে বলেছিলেন যে দিন দিন বিল্ডিং বিল্ডিংয়ের উচ্চতা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই যেন অক্সিজেন ও আলোর ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আগামী দিনে বাচ্চারা বিনা বাতাস ও আলোয় কিভাবে বেড়ে উঠবে তাই নিয়েই আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। যেহেতু শিশুরা কোন বাগান দেখতে পেত না তাই এই খাচা তাদের জন্য খুবই উপযুক্ত।
সম্ভবত এই সকল কারণেই তখনকার বাবা-মায়েরা এই খাঁচাকে খারাপ মনে করতেন না। উপরন্তু তারা এটাকে ভালো চোখেই দেখতেন, যে এই খাঁচার মাধ্যমে তাদের শিশুরা পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস পাচ্ছে এবং তাদের রক্ত পরিশোধিত হচ্ছে। শিশুদের এই খাচা গুলি দেখতে অনেকটা পশুদের খাচার মতো ছিল। সেগুলো তৈরি হলো নেট দিয়ে। সেই খাচাগুলো জানালার বাইরে রাখা উচিৎ, এক কথায় আজকের দিনে যেখানে এসি রাখা হয়। শুধুমাত্র মা-বাবারাই নয় জানলায় এই খাচা তৈরি করতেন অনেক বাড়িওয়ালারাও। সেই সময়ে যেহেতু এই খাচা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাই ভালো ভারাটিয়া পেতে এই সকল সুবিধা করে রাখতেন বাড়ির মালিকেরা।
পরবর্তীকালে আনুমানিক ১৯০৬ সাল নাগাদ এক মা এলেনর রুজভেল্ট একটি খাচা কিনে এনে তার নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু এই খাঁচায় শিশু কন্যাকে রাখলেই সে এত জোরে চিৎকার করত যে অসুবিধায় পড়তে হত প্রতিবেশীদের। এই ঘটনার পর থেকেই প্রতিবেশী এবং বহু মায়েরা ভাবতে শুরু করার পাশাপাশি একটি অভিযোগও দায়ের করেছিলেন Prevention of Cruelty Towards Children এর কাছে। এই অভিযোগ করার পর থেকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই খাঁচার ব্যবহার অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। এরপর ১৯৫০ সালে একেবারেই খাঁচার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও এই খাঁচায় শিশুদের কোন আঘাতের রিপোর্ট জমা পড়েনি কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের মতামতের অভাবে ও সমাজের উন্নতির সঙ্গে মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে হ্রাস পেয়েছিল বেবি কেজ।