অফবিট

ভারতবর্ষের কোন হিন্দু নারীর কাছে মহম্মদ ঘোরী পর্যন্ত পরাজিয় স্বীকার করেছিলেন?

ভারতবর্ষের মাটি সোনা দিয়ে মুড়োনো, বিভিন্ন কালে এই পবিত্র ভূমিতে জন্ম নিয়েছে একাধিক বীর যাদের প্রতাপ ও শৌর্য জগৎবিখ্যাত ছিল। মহারানা প্রতাপ, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ, বাপ্পা রাওয়াল, রনজিত সিং সহ কত যে বীর ও তাদের বীরত্বের কাহিনী রয়েছে তা তা লিখতে গেলে হয়ত একটি মহাকাব্য হয়ে যাবে। তবে ভারতের ইতিহাসে যে সবসময় পুরুষদেরই বিজয়গাথা রয়েছে এমন নয়, অনেক মহিয়সী বীর মহিলাও ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ঝাঁসির রানি লক্ষীবাই, রানী দুর্গাবতী সহ এমন অনেক ভারতীয় বীর নারী ছিল যারা যুদ্ধবিদ্যায় নিপুন ছিলেন। ভারতের ইতিহাসে এমনই এক বীরকন্যা হচ্ছে রানী নাইকি দেবী। মহম্মদ ঘোরীকে পর্যন্ত পরাজিত করেছিলেন নাইকি দেবী। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ভারতের ইতিহাসে এনার ব্যাপারে ততটা আলোচনা করা হয়না। আপনাদের অনেকেই হয়ত নাইকি দেবীর নামটাই হয়ত প্রথম শুনলেন। ইতিহাসের পাতা থেকে কালের প্রভাবে প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ভারতমাতার এক বীরকন্যা নাইকি দেবী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

গোয়ার কদম্বের রাজা মহা মণ্ডলেশ্বর পরমাদির কন্যা ছিলেন রানী নাইকি দেবী। ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা, তীর চালানো, ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধনীতিতে সুনিপুন ছিলেন তিনি। গুজরাটের সোলাঙ্কি রাজা অজয়পালের সাথে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। সোলাঙ্কি বংশ চালুক্য নামে প্রসিদ্ধ ছিল। ওনাদের প্রথম পুত্রের নাম মূলরাজা দ্বিতীয়। কিন্তু অজয়পাল বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেননি। ১১৭১ সালে সিংহাসনে বসার মাত্র চার বছরের মধ্যেই ১১৭৫ সালে তার মৃত্যু হয়। ফলে সেই বছরেই তাঁর ছেলে মূলরাজা দ্বিতীয়কে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু বয়সে নাবালক হওয়ায় তার অভিভাবক রূপে রাজমাতা রানী নাইকি দেবী রাজ্য পরিচালনা করতেন। নাইকি দেবীর সাথে মহম্মদ ঘোরীর যুদ্ধ কখন হয় সেব্যাপারে জানা যাক।

উত্তর ভারতে ইসলামিক শাসনের সূত্রপাত ঘটায় ১১৯২ সালে। তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের পর, ১১৯২ সালে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় যাতে দিল্লির শেষ হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে দিল্লিতে ইসলামিক শাসনের প্রতিষ্ঠা করে মহম্মদ ঘোরী এবং ১২০৬ সালে দিল্লিতে সুলতান শাসন শুরু হয়। মহম্মদ ঘোরী আফগানিস্তানের শাসক হয়ে ভারতবর্ষ আক্রমন করে দিল্লি দখল করেছিল, এই কাজ আলেকজান্ডার, পারস্যর রাজারা, আরবরা ও গজনীর সুলতান মামুদও করতে পারেনি। ১১৭৫ থেকে ১২০৬ এর মধ্যে মহম্মদ ঘোরী প্রথমে মূলতান আক্রমন করে ১১৭৫ সালে, পাঞ্জাব আক্রমন করে ১১৭৯ সালে, পেশায়ার আক্রমন করে ১১৮০ সালে, শিয়ালকোট আক্রমন করে ১১৮৫ সালে এবং সবশেষে ১১৯২ সালে দিল্লি আক্রমন করে। এই তথ্য মোটামুটি সবাই জানেন কিন্তু এরই মাঝে ১১৭৮ সালে চালুক্যান সোলাঙ্কী রানী নাইকি দেবী মহম্মদ ঘোরীকে কাশারআডা যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন সেব্যাপারে অনেকেই জানেননা। 

গুজরাটের সোলাঙ্কী রাজবংশ বা চালুক্যদের ইতিহাস বহু ঐতিহাসিকগনই লিখেছেন কিন্তু মহান রানী নাইকি দেবীর কৃতিত্ব এবং ১১৭৮ সালে মহম্মদ ঘোরীকে পরাজিত করার ঘটনা যেন তুলনামূলক ভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে। ১১৭৫ সালে মূলতান দখলের পর মহম্মদ ঘোরী ১১৭৮ সালে দক্ষিন রাজপুতানার দিকে বিশেষ করে গুজরাটের দিকে রওনা দেয়। সেসময় এখানে রাজত্ব করত চালুক্যরা। মহম্মদ ঘোরীর লক্ষ্য ছিল আনহিলওয়ারা দখল করা যা অধুনা গুজরাটের পাটন শহর। আনহিলওয়ারার ৪৫ টি এলাকা দখল করার লক্ষ্য ছিল মহম্মদ ঘোরীর। আনহিলওয়ারা ছিল চালুক্য রাজবংশের রাজধানী। অষ্টম শতকে চাপোতকাটা রাজবংশের বনরাজ আনহিলওয়ারা প্রতিষ্ঠা করেছিল। চালুক্যরাই চাপোতকাটা রাজবংশকে পরাজিত করেছিল। আমেরিকান ঐতিহাসিক টার্টিয়াস চান্দলারের তথ্য অনুযায়ী ১০০০ সালে আনহিলওয়ারা বিশ্বের দশম বৃহত্তম শহর ছিল, যার জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। এই পাটন শহর বা আনহিলওয়ারাতে একটি বিখ্যাত জলাশয় আছে যার নাম রানী কী ভাব। এগারো শতকে চালুক্যান রানী উদয়ামতী তার স্বামী ভীমাদেব-১ এর জন্য তৈরি করেছিল। তবে এটা কোন সাধারন জলাশয় নয়, বিশেষভাবে তৈরি এটা। এটি দেখতে অনেকটা মন্দিরের মতোন যা গুর্জরা আদলে তৈরি।  সাতটি স্তর বিশিষ্ট সিঁড়ি রয়েছে, সাথে ৫০০ রকমের স্থাপত্য ও এক হাজার ছোট ছোট দেওয়াল রয়েছে। ১৯৪০ সালে এটা আবিষ্কার করা হয়। ১৯৮০ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটি নতুন করে তৈরি করে। ২০১৪ সাল থেকে এটি ইউনেস্কোর সংরক্ষিত এলাকা। 

মহম্মদ ঘোরী যখন আনহিলওয়ারা আক্রমন তখন সেখানকার শাসক ছিল মূলরাজা দ্বিতীয় এবং তার অভিভাবক ছিল নাইকি দেবী। মহম্মদ ঘোরী ভেবেছিল একজন নাবালক রাজা এবং একজন মহিলাকে পরাস্ত করা খুবই সহজ সেজন্য সে আনহিলওয়ারা আক্রমন করতে এসেছিল কিন্তু এটা তার বড় ভুল ছিল। গুপ্তচর মারফত রানী নাইকি দেবী খবর পান মরুভূমি পেরিয়ে মহম্মদ ঘোরী এক বিশাল সেনা নিয়ে তার রাজধানী আনহিলওয়ারার দিকে আসছে। রানী নাইকি দেবী আশেপাশের সমস্ত রাজাদের থেকে সাহায্য চায় যার মধ্যে পৃথ্বীরাজ চৌহানও ছিল কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করেনি। নাড্ডুলা চাহামানার শাসক কেলহানদেভা, জালোর চাহামানার কীর্তিপালা এবং আরবুদা পরমারার ধারাবর্ষা ওনাকে সাহায্য করেন। আবু পর্বতের কাছে কায়দারাতে নিজের সেনা ছাউনি তৈরি করে মহম্মদ ঘোরী চালুক্যদের কাছে তার দূত পাঠায়। মহম্মদ ঘোরী প্রস্তাব পাঠায় সে গুজরাট আক্রমন করবে না বদলে রানী নাইকি দেবী ও তার পুত্রকে তার সামনে আত্মসমর্পন করতে হবে। সাথে সাথে চালুক্য সাম্রাজ্যের সমস্ত সোনা এবং মহিলা তাকে দিতে হবে। এই অপমানজনক প্রস্তাব রানী নাইকি দেবী প্রত্যাখ্যান করে এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে থাকে। নাইকি দেবী জানতেন মহম্মদ ঘোরীর বিশাল সেনাকে সরাসরি পরাজিত করা সম্ভব হবে না, সেজন্য তিনি পরিকল্পনা তৈরি করতে থাকেন। তিনি আবু পর্বের নিম্নভূমি কাশারআডা গ্রামের কাছে এক স্থানকে যুদ্ধের ভূমি হিসাবে নির্বাচন করেন যা আজ রাজস্থানের শিরোহী জেলায়। এখানের সংকীর্ণ গিরিপথের কারনে মহম্মদ ঘোরীর বিশাল সেনা খুবই অসুবিধায় পড়ে। মহম্মদ ঘোরী যখন কাশারআডা পৌঁছায়, তখন সেখানে রানী নাইকি দেবী তার সেনা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তত ছিলেন। শুরু হয় উভয়ের মধ্যে কাশারআডার যুদ্ধ। কম সংখ্যায় হওয়া সত্বেও চালুক্য সেনা মহারানী নাইকি দেবীর নেতৃত্বে অসাধারন যুদ্ধ করে, চালুক্যান যুদ্ধ হাতি গুলোর সামনে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়ে মহম্মদ ঘোরীর সেনা। শেষপর্যন্ত বেশকিছু সেনার সাথে মহম্মদ ঘোরী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। এরপর আর কোনওদিন মহম্মদ ঘোরী গুজরাট আক্রমনের চিন্তাও করেনি, বরং পরের বছর খাইবার পাস হয়ে পাঞ্জাব আক্রমন করে মহম্মদ ঘোরী। এই খাইবার পাস হয়েই বারবার ভারত আক্রমন করেছিল বিদেশী শক্তি গুলো। 

মহম্মদ ঘোরীর পর ১৩৮৩ সালে গজনির সুলতান মামুদ, ১৫২৬ সালে বাবর ভারতে আক্রমন করেছিল। আলেকজান্ডারও এই পথে ভারতে এসেছিল। গুজরাটি সাহিত্য ও চালুক্য লিপিতে রানী নাইকি দেবীর বীরত্বের কথা লেখা আছে। যেমন গুজরাটি কবি সোমেশ্বরাতে বলা হয়েছে কীভাবে রানী নাইকি দেবীর সেনা মহম্মদ ঘোরীকে পরাস্ত করেছিল। এছাড়াও একাধিক গুজরাটি কবি ও সাহিত্যিকের রচনায় এই অসাধারন যুদ্ধের কথা লেখা আছে। তেরো শতকে পারস্যের ইতিহাসবিদ মিনহাজ সিরাজের লেখাতেও চালুক্য যুদ্ধের উল্লেখ আছে। উনি লিখেছেন মহম্মদ ঘোরী তার সমস্ত সেনা কীভাবে চালুক্যান যুদ্ধ হাতিদের সামনে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। ষোলো শতকের ঐতিহাসিক বাদাউনিও লিখেছে কীভাবে কষ্ট করে যুদ্ধ থেকে পালিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছিল মহম্মদ ঘোরী ও তার সেনা। চোদ্দ শতকের জৈন লেখক মেরুতুঙ্গার রচনায় এই কাশারআডার যুদ্ধের পরিপূর্ণ বিবরন পাওয়া যায়। রানী নাইকি দেবীর বীরত্ব ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই ও মারাঠি রানী তারাবাইয়ের থেকে কোন অংশে কম ছিলনা কিন্তু তাও ইতিহাসে তার উল্লেখ অনেকটাই কম আছে। ভারতের বর্তমান প্রজন্ম অতীতের সোনালী ইতিহাস  ও এমন অসাধারন বীরকন্যাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *