আমেরিকার পর ক্ষমতা হস্তান্তর কি চীনের হাতেই?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি সময়ের সাথে দ্রুত পরিবর্তনশীল। প্রত্যেক শতাব্দীতে বিশ্বে একটি সুপার পাওয়ার এর আবির্ভাব হয়েছে এবং সময়ের সাথে তার পরিবর্তনও হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে ব্রিটেন ছিল সুপার পাওয়ার, যার জন্য একটা সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয়না। বিংশ শতাব্দী আসতে আসতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে, পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে এখনও পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বে একক সুপার পাওয়ার হিসাবে রয়েছে। তবে এরই মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে আমেরিকার পর ক্ষমতা হস্তান্তর কার হাতে হবে। চীনের দ্রুত উত্থান দেখে বিশেষজ্ঞ মহলে ধারনা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে আমেরিকার হাত থেকে ক্ষমতা হয়ত চীনের অধীনে যাবে। তবে সত্যিই কী ভবিষ্যতে বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতি চীন পরিচালনা করবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যেমন একটি সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে চীনও কী অদূর ভবিষ্যতে তাই করবে।
উইলিয়াম টি বোয় তার বই চীনের শেষ সম্রাটের জন্য লিখেছেন ১৮৩৯ সালের আগে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পূর্ব এশিয়াতে চীনের আধিপত্য ছিল অর্থাৎ চীন একটি আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার ছিল। কিন্তু ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ ও চীনাদের মধ্যে হওয়া প্রথম আফিম যুদ্ধের চীনের পরাজয়ের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ব্রিটিশদের একাধিক অন্যায় শর্ত মানতে বাধ্য হয় চীন সেসময়। এরপর জাপানী সেনা চীনের উপর নারকীয় অত্যাচার করে। এই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় চীন। সেজন্য বলা হয় চীনের বৈদেশিক নীতি পূর্বের অভিজ্ঞতার উপর তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশদের এবং জাপানিদের কাছে অত্যাচারিত হবার পরই চীন ঠিক করে অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে অগ্রগতি হবার।
১৯৭০ এর দশকে চীনের রাষ্ট্রপতি হয় ডেং জিওপিং। আধুনিক চীনের স্থপতি ডেং জিওপিংকেই বলা হয়। ডেং জিওপিং সেসময় একটি নীতি নিয়েছিল নিজের শক্তি গোপন করে রাখা এবং সঠিক সময়ের অপেক্ষা করা। ডেং জিওপিং এর এই নীতি আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। ১৯৭০-৯০ এই দুই দশক আমেরিকার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় চীনের। চীন প্রথম থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘনিষ্ঠ দেশ ছিল। চীন অর্থনীতি উন্নয়নে জোর দেওয়ায় আমেরিকা ভাবে এত বড় একটা দেশকে সোভিয়েত জোট থেকে বের করা যাচ্ছে এটাই বড় ব্যাপার। আমেরিকা যার কারনে চীনে বিনিয়োগ শুরু করে। কম খরচে শ্রমিকের কারনে চীন দ্রুত উৎপাদন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু চীনে তখনও কমিউনিজম ছিল। আমেরিকা তাও চীনকে সাহায্য করে কারন আমেরিকা ভেবেছিল চীনে আর্থিক উন্নয়ন হলে কমিউনিজমের পতন হয়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে কিন্তু আমেরিকার ধারনা ভুল ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো খানিকটা বুঝতে পারে চীনের আসল উদ্দেশ্য অন্য। তবে তখনও চীনকে পুরোপুরি চিনতে পারেনি আমেরিকা।
২০০৮ সালে বিশ্বে তীব্র আর্থিক মন্দা দেখা যায় যার কারনে আমেরিকা সহ বিশ্বের উন্নত দেশ গুলো তীব্র আর্থিক সংকটে পড়ে। কিন্তু এই প্রভাব চীনের উপর পড়েনি কারন এত বছর ধরে উৎপাদন কেন্দ্র হওয়ায় চীন তাদের বৈদেশিক সঞ্চয়ে প্রচুর আমেরিকান ডলার জমা রেখেছিল। চীন এইসময় আমেরিকাকে ডলার দেয় বদলে আমেরিকার থেকে সরকারি বন্ড কিনে দেয়। সরকারি বন্ডে একটি কাগজে লেখা থাকত নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে শোধ করতে হবে। ডেং জিওপিং এর নীতি সঠিক সময়ের অপেক্ষা, ঠিক এই সময় থেকেই শুরু হয়। চীন এইসময় তাদের অর্থ সামরিক উন্নয়নে ব্যায় করতে শুরু করে। একটি নতুন শক্তির উত্থান তখনই ঘটে যখন পূর্বের শক্তির পতন হয়। আমেরিকার উত্থান হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপ আর্থিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল তখন উত্থান ঘটে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের। ঠিক তেমনি ধীরে ধীরে আর্থিক শক্তির বিচারে আমেরিকার থেকে ক্ষমতা চীনের দিকে যাচ্ছে।
১৯৭৬ সাল থেকে এখনও অবধি প্রতিবছর আমেরিকার বানিজ্যিক ঘাটতি হচ্ছে। আমেরিকান কংগ্রেসের অনুমান ২০৮০ সালের মধ্যে আমেরিকার ঋন তাদের মোট জিডিপির ৭১৬ শতাংশ হবে। অন্যদিকে চীনের বৈদেশিক সঞ্চয় ৩.১৮ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১০ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ শতাংশের বেশী হারে চীনের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা ২০৪১ এর মধ্যে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে আর্থিক দিক দিয়ে। আমেরিকার পর চীনে সবচেয়ে বেশী বৈদেশিক বিনিয়োগ আসে। বিশ্বে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ৪০ শতাংশই চীনে আসে। চীন তার মোট জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ বা ২২৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক খাতে খরচ করে। চীনের বানিজ্যিক রপ্তানি বিশ্বের বাকী দেশ গুলোর তুলনায় তিন গুন বেশী। বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বা সুপার পাওয়ার হতে গেলে শুধু আর্থিক ও সামরিক শক্তিশালী হলেই চলবেনা বরং বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বিস্তারও করতে হবে। যেমনটা আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে অর্থিক সহায়তা করেছিল। চীনও তেমন আর্থিক ভাবে দুর্বল দেশগুলোকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করে। তবে এর পেছনেও চীনের উদ্দেশ্য আছে। চীন ইচ্ছে করে দেশগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ দেয় যাতে দেশগুলো তা শোধ করতে না পারে, এর বদলে চীন সেই দেশগুলোর ভূভাগ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়ে নেয়। যেমন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সহ আফ্রিকার একাধিক দেশের জায়গা এভাবে চীনের দখলে চলে গেছে, এটা চীনের ডেব্ট ট্রাপ নীতি। এছাড়াও চীন দক্ষিন চীন সাগরে একাধিক কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে নিজের আধিপত্যের প্রমান দিচ্ছে। আজ আমেরিকা সহ ইউরোপ বুঝতে পেরেছে চীন তাদের জন্য কতটা চিন্তার কারন।
তবে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে নেতৃত্বের পার্থক্য আছে। বিশ্বে সুপার পাওয়ার হতে গেলে আর্থিক ও সামরিক ভাবে শুধু শক্তিশালী হলে চলবে না, বিশ্বের বাকী দেশ গুলোকেও তা মানতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার যখন উত্থান হয় তখন গোটা ইউরোপ সহ একাধিক এশিয়ান দেশ আমেরিকাকে সমর্থন করেছিল,আজও করে। আমেরিকা বিশ্বের বহু দেশকে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। কিন্তু চীন ছোট ছোট দেশ গুলোকে ডেব্ট ট্রাপে ফাঁসায় চড়া সুদে ঋন দিয়ে। চীনের এই নীতি সম্পর্কে সব দেশই এখন জেনে গেছে। তাছাড়া একটি সুপার পাওয়ারের উত্থান ঘটে কোন বিশাল বিশ্ব রাজনৈতিক সংকটে। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উত্থান হয়েছিল। সেরকম কোন পরিস্থিতি এখন নেই। অনেক মত অনুযায়ী করোনা মহামারী এই কারনে চীন তৈরি করেছিল তার উত্থানের জন্য। কিন্তু করোনা মহামারীতে চীনের কোন লাভ হয়নি বরং ভারত ও আমেরিকা প্রচুর ভ্যাকসিন সহ একাধিক চিকিৎসা সামগ্রী গোটা বিশ্বে সরবরাহ করেছে। বিশ্বের মাত্র ১২ শতাংশ দেশ চীনকে সুপার পাওয়ার মানে। যেসব মতবাদ আসছে ২০৪১ সাল নাগাদ চীন আমেরিকাকে অর্থনৈতিক ভাবে ছাড়িয়ে যাবে সেটা এখনই অনুমান করা সম্ভব নয় কারন এর আগেও জাপান ও জার্মানি সম্পর্কে ভাবা হয়েছিল তারা বোধ হয় আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে কিন্তু তা হয়নি। কোন দেশের সুপার পাওয়ার হতে হলে ভৌগলিক পরিস্থিতি একটি বড় প্রভাব ফেলে। আমেরিকা সুপার পাওয়ার হয়েছে কারন আমেরিকার আশেপাশে কানাডা, মেক্সিকোর মতোন দেশ রয়েছে এবং প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর রয়েছে, এখানে আমেরিকার কোথাও কোন শত্রু দেশ নেই। অন্যদিকে চীনের আশেপাশে প্রায় সব দেশের সাথেই চীনের সীমানা নিয়ে বিবাদ রয়েছে। ভারত, জাপান সহ আসিয়ান দেশ গুলোর সাথে চীনের ঝামেলা আছে। আমেরিকা সুপার পাওয়ার কারন তার আভ্যান্তরীন কোন ঝামেলা নেই। কিন্তু চীনের জিনজিয়াং এবং দখল করা তিব্বত চীনের ভূভাগের বড় অংশ। এই দুটি প্রদেশ আলাদা হয়ে গেলে চীনের আয়তন অনেক কমে যাবে, তাই চীনকে বিশেষ নজর রাখতে হয় এই দুটি প্রদেশের দিকে।
বর্তমানে চীনেও আর্থিক মন্দার প্রভাব রয়েছে যার কারনে চীনে বেকার সমস্যা বহু অংশে বেড়ে গেছে। আমেরিকা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব সহ একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে গোটা বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত যার কারনে বিশ্ব প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রন এখনও আমেরিকার হাতে রয়েছে যা ভবিষ্যতেও থাকবে। অন্যদিকে চীনে একাধিক সমাজিক মাধ্যম বন্ধ থাকে, তারা নিজস্ব মাধ্যমে যুক্ত অনেকটা বাকী বিশ্বের সাথে বিচ্ছিন ভাবে। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে সুপার পাওয়ার হওয়া চীনের পক্ষে সম্ভব নয়। চীন বরং আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে। গোটা বিশ্বে আমেরিকার যে প্রভাব রয়েছে তা কোনও দিনও চীন অর্জন করতে পারবেনা।